মাথা কুটলেও ডিসি হিলে টিয়ের ঝাঁক দেখা যাবে না

‘ডিসি পাহাড় ঘিরে ১০ থেকে ১২ বছর আগেও যে জীব আর উদ্ভিদবৈচিত্র্য ছিল, তা-ও পাওয়া যায় না।’

সপ্তদশ শতকের ঐতিহাসিক ও পর্যটক শিহাবউদ্দিন তালিশ তাঁর ‘ফতিয়া ই ইব্রিয়া’ বইতে চট্টগ্রামের প্রকৃতি ও পাহাড়কে আলেকজান্ডারের দুর্গের মতোই দুর্ভেদ্য বলে বর্ণনা করেছেন। সেই দুর্ভেদ্য পাহাড়শ্রেণি আর তার পাদদেশে সমতল ছিল নিবিড় গাছপালায় ঢাকা। আর তা ছিল বিপুল জীববৈচিত্র্যে ভরা এক জনপদ। কিন্তু কালে কালে সেই পাহাড়, অরণ্য, জলাভূমি নিশ্চিহ্ন হয়েছে। আর এই প্রকৃতিকে ঘিরে বিকশিত প্রাণিকুলের সমাজটাও সংকুচিত হয়েছে। একসময় এরা মানুষের নিকটাত্মীয়র মতোই মানুষের আশপাশে বসবাস করত। প্রকৃতির সবকিছুই কমেছে, বেড়েছে শুধু মানুষের জঞ্জাল।

১৯২০ সালে চৌধুরী পূর্ণচন্দ্র দেববর্ম্মা তত্ত্বনিধি প্রণীত গ্রন্থ ‘চট্টগ্রামের ইতিহাস’-এ লেখা আছে, চট্টগ্রামের প্রায় সবখানে ‘বন্য হাতি, নানা প্রকারের হরিণ, বানর, হনুমান, বন্য বরাহ, শজারু, বাগডাশ, কাঠবিড়ালি, বন বিড়াল, খান্ডাস, গোরখোদা, শৃগাল, রামকুত্তা’ চোখে পড়ত। মাঝেমধ্যে গন্ডার, ভালুক ও উল্লুকও পাওয়া যেত। উল্লুক সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘চট্টগ্রামের কোনো কোনো পাহাড়ে ‍‍উল্লুক নামের একপ্রকার জন্তু আছে। উহারা শীতকালে এমন একপ্রকার অব্যক্ত চিৎকার করে যে ২-১ মাইলের মধ্যে লোক টিকা কঠিন হয়। ওই অব্যক্ত শব্দ “রঘুরে রঘুরে” বলিয়া ধারণা করা হয়। এই জন্যই ছেলেরা ইহাকে রঘুরে বলিয়া থাকে।’

পূর্ণচন্দ্রের এই বর্ণনা ১০০ বছর আগের ইংরেজ আমলের। তারও আগে ওই ব্রিটিশ শাসনেই চট্টগ্রামে কালেক্টরের দায়িত্ব পালন করেছিলেন, এ এল ক্লে। তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই ‘ফ্রম আ ডায়েরি ইন লোয়ার বেঙ্গল’-এ তিনি চট্টগ্রামের প্রকৃতি ও এর জীববৈচিত্র্যের কথা উল্লেখ করেছেন। সে সময় চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন পাহাড়ি বনাঞ্চলে বাঘের বিচরণ ছিল। পাশ দিয়ে বাঘ হেঁটে যেত বলে ইংরেজরা একটি এলাকার নাম দিয়েছে টাইগারপাস। পূর্ণচন্দ্রের বইতে নানা প্রকার পাখি, জলজ প্রাণীর নাম আছে, যেগুলোর নামও এই প্রজন্মের কেউ শোনেনি। তিনি চট্টগ্রাম অঞ্চলের ৮৪ রকমের মাছের নাম উল্লেখ করেছেন।

এ তো গেল ব্রিটিশ আমলের কথা। আমাদের কৈশোরে আশির দশকে যেসব পশুপাখি আমরা দেখেছি, সেগুলোও এখন চোখে পড়ে না। চট্টগ্রাম শহরের নন্দনকাননে আমাদের বাড়ি। এখানে ডিসি পাহাড় ঘিরে ১০ থেকে ১২ বছর আগেও যে জীব আর উদ্ভিদবৈচিত্র্য ছিল, তা-ও পাওয়া যায় না। দুই বছর আগেও এখানে রাতে শিয়ালের ডাক শুনতাম। ডিসি পাহাড়ের শিরীষগাছে ছিল অগুনতি টিয়া পাখির বাসা। ঝাঁকে ঝাঁকে টিয়া পাখি নন্দনকাননের নীল আকাশটি ছেয়ে ফেলত তাদের সবুজ ডানায়। টিয়া ছাড়াও এই ডিসি পাহাড়ে কত রকমের পাখি দেখেছি। দেখেছি শজারু, সাপ, শামুক।

আরও পড়ুন

চট্টগ্রামের প্রবর্তক পাহাড়, জিলিপি পাহাড়, সদরঘাট নদীর তীরে দেখেছি অনেক বানর। বিশ্বযুদ্ধের স্মারক চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রির চারপাশে যে নিবিড় গাছপালাসহ সংলগ্ন পাহাড়গুলোতে ছোটবেলায় হাঁড়িকুঁড়ি, ময়না, ধনেশসহ নানা জাতের বুনো পাখি দেখেছি। এরা আমাদের শহরে আমাদেরই নিকট প্রতিবেশী। এদের নির্বিঘ্ন বসবাস এবং প্রাণরক্ষার জন্য আমরা কিছুই করিনি। নিজেরা উন্নয়নের নামে প্রাকৃতিক সব সম্পদকে ডাকাতের মতো গ্রাস করেছি। একবারও পরিণতির কথা ভাবিনি।

এখন চট্টগ্রামের প্রাণিকুলের কী অবস্থা, তার কোনো হিসাব-নিকাশ বন কর্মকর্তাদের নেই। ২০১৮ সালে সিটি করপোরেশনের সব কটি ওয়ার্ডে জীববৈচিত্র্য চিহ্নিত করতে বিআরজিবির (বায়ো ডাইভার্সিটি রিসার্চ গ্রুপ অব বাংলাদেশের) সঙ্গে সমঝোতা স্বাক্ষর করে। এই জরিপে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বিআরজিবির চেয়ারম্যান মরহুম অধ্যাপক বদরুল আমিন ভূঁইয়া। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুরো নগরের জরিপ সম্পন্ন হয়নি। ৮ নম্বর শুলকবহর ওয়ার্ডে এই জরিপ সম্পন্ন হওয়ার পর বদরুল আমিন ভুইয়া জীববৈচিত্র্যের চিত্র তুলে ধরেন।

গবেষণার দলটি শুলকবহরে ৩৭০ প্রজাতির প্রাণী শনাক্ত করেছে। এর মধ্যে রয়েছে তেলাপোকার মতো ৫ প্রজাতির ক্রাস্টাসিয়া, ৫ রকমের শামুক, ২০৫ রকমের পোকা, ১২ রকমের মাকড়সা, ১৬ প্রজাতির মাছ, ৫ ধরনের উভচর প্রাণী, ৫ প্রজাতির সাপ, ৫৯ প্রজাতির পাখি ও ১৩ রকমের বন্য প্রাণী। এই জরিপে গৃহপালিত কিছু পশুপাখির তালিকাও অন্তর্ভুক্ত হয়।

প্রায় দেড় হাজার বছরের এই চট্টগ্রাম কেমন ছিল, তা ভাবতে গেলে গৌরব বোধের সঙ্গে যে হাহাকারের যে আগুন জ্বলে ওঠে, তা কোনো রকম সান্ত্বনা বাক্যে নেভানো যাবে না। আমরা যেমন হারানো পাহাড়, জলাঙ্গি, ফিরে পাব না, তেমনি মাথা কুটলেও আর কোনো দিন ডিসি পাহাড়ে, প্রবর্তক পাহাড়ে টিয়ের ঝাঁক দেখব না। সদরঘাটে নদীর কিনারে বটগাছের শাখায় শাখামৃগদের দেখব না। যেতে যেতে যে সামান্য অবশিষ্ট রয়েছে, এখন সেটিকে রক্ষা করতে হবে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য।

পরিবেশ ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণ এবং প্রতিবেশে সুসম অবস্থা বিরাজ রাখতে এ ধরনের জরিপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সিটি করপোরেশন ২০১৮ সালে একটি ওয়ার্ডে এ-সংক্রান্ত জরিপটি শুধু একটি ওয়ার্ডে সম্পন্ন করে কেন যে আর এগোতে পারল না, সেটি অস্পষ্ট। পুরো শহরের জীববৈচিত্র্যের একটা চিত্র পাওয়া গেলে সেগুলো সংরক্ষণ কিংবা প্রসারণের পরিকল্পনা নেওয়া সহজ হতো।

২০১০-১১ সালের দিকে ষোলশহর বন গবেষণা ইনস্টিটিউট ক্যাম্পাসে একটি গবেষণা চালানো হয়েছিল বন গবেষণাগারের সিনিয়র গবেষক মোহাম্মদ আনিসুর রহমান, মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম ও মোহাম্মদ মাঈনুদ্দিনের নেতৃত্বে। সে সময় এই এলাকায় মোট ৯৮ প্রজাতির বন্য প্রাণীর অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৮ ধরনের উভচর, ১৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ৫৯ প্রজাতির পাখি ও ১৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী চিহ্নিত করা হয়। তবে এটি ছিল ক্ষুদ্র একটি এলাকা।

গাছপালাবেষ্টিত এমন সবুজ সুপরিবেশের জায়গা চট্টগ্রামে দিন দিন কমে আসছে। পরিবেশের দিক থেকে এটি একটি আদর্শ জায়গা। পরিকল্পনা করে এ রকম পরিবেশবান্ধব, প্রাণিবান্ধব এলাকার পরিসর ও সংখ্যা বাড়াতে না পারলে চট্টগ্রাম বাসের অযোগ্য শহরে রূপান্তরিত হবে।

হারানো ঐতিহ্য নিয়ে গৌরব করতে পারি, কিন্তু তা দিয়ে জীবন চলে না। প্রায় দেড় হাজার বছরের এই চট্টগ্রাম কেমন ছিল, তা ভাবতে গেলে গৌরব বোধের সঙ্গে যে হাহাকারের যে আগুন জ্বলে ওঠে, তা কোনো রকম সান্ত্বনা বাক্যে নেভানো যাবে না। আমরা যেমন হারানো পাহাড়, জলাঙ্গি, ফিরে পাব না, তেমনি মাথা কুটলেও আর কোনো দিন ডিসি পাহাড়ে, প্রবর্তক পাহাড়ে টিয়ের ঝাঁক দেখব না। সদরঘাটে নদীর কিনারে বটগাছের শাখায় শাখামৃগদের দেখব না। যেতে যেতে যে সামান্য অবশিষ্ট রয়েছে, এখন সেটিকে রক্ষা করতে হবে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বন বিভাগ, পরিবেশ অধিদপ্তর যৌথভাবে সমন্বয়ের মাধ্যমে উদ্ভিদ ও প্রাণিকুল এ শহরে টিকিয়ে রাখতে একসঙ্গে কাজ করার এখনই সময়। পরিবেশবাদী সংগঠন, ব্যক্তিসহ চট্টগ্রামের মানুষ এই কাজকে সবার আগে সমর্থন ও সহযোগিতা দেব।

  • ওমর কায়সার প্রথম আলোর চট্টগ্রাম অফিসের বার্তা সম্পাদক ও কবি