সম্প্রতি শারজাহতে অনুষ্ঠিত মিডল ইস্ট ইনভেস্টমেন্ট ফোরামে ভারত ও উপসাগরীয় দেশগুলোর অর্থনৈতিক সম্পর্কের গভীরতা আবার স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতি ভারতের রপ্তানিকে প্রতিযোগিতামূলক হওয়া থেকে বিরত রাখায়, ভারতীয় কোম্পানিগুলো ক্রমবর্ধমানভাবে সংযুক্ত আরব আমিরাতকে (ইউএই) ব্যবহার করছে আমেরিকান বাজারে প্রবেশের একটি মাধ্যম হিসেবে। এটি আঞ্চলিক সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করছে।
ফলে আগে যেখানে ভারতের সঙ্গে উপসাগরীয় দেশগুলোর সম্পর্ক ছিল তেল এবং শ্রম বিনিময়ের ওপর, তা এখন প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও নিরাপত্তাজুড়ে বিস্তৃত অংশীদারে পরিণত হয়েছে। উপসাগরীয় অঞ্চল এবং ভারত এখন কেবল বাণিজ্যিক অংশীদার নয়; তারা একসঙ্গে ভূ-অর্থনৈতিক সমন্বয় ঘটাচ্ছে এবং বিশ্ববাণিজ্যের মানচিত্র নতুনভাবে আঁকছে।
ভারত ও উপসাগরীয় দেশগুলোর সম্পর্কের গভীর ঐতিহাসিক ভিত্তি রয়েছে। শতাব্দী ধরে মসলা ও কাপড় বস্ত্র বহনকারী কাফেলা ও বাণিজ্যিক জাহাজ দুই অঞ্চলের মধ্যে স্থায়ী সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। ব্রিটিশ রাজত্বকালে অনেক উপসাগরীয় দেশ দিল্লি থেকে পরিচালিত হতো।
ভারত স্বাধীনতার পর কয়েক দশক ধরে সম্পর্ক মূলত লেনদেনভিত্তিক ছিল। একদিকে ছিল তেল, অন্যদিকে ছিল শ্রম আর ধন উভয় দিকে। সম্প্রতি ভারত ও উপসাগরীয় দেশগুলো তাদের ঐতিহাসিক অংশীদারত্বের কৌশলগত মূল্য পুনরায় খুঁজে পেয়েছে এবং একুশ শতকের জন্য পুনর্বিন্যাস শুরু করেছে।
২০১০-এর দশকের মাঝামাঝি এই দুই পক্ষের কৌশলগত অগ্রাধিকার মিলতে শুরু করে। ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রথমবারের মতো সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর করেন। এটি ছিল ৩৪ বছর পর কোনো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর। এই সময়ে প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান ও সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান তাঁদের অর্থনীতি তেলের বাইরে বৈচিত্র্যপূর্ণ করার পরিকল্পনা চালু করেন।
ভারতের সঙ্গে উপসাগরীয় এলাকার এই মিলন ঘটেছে অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের কারণে। উপসাগরীয় দেশগুলো তেলের ওপর নির্ভরতার ঝুঁকি বুঝতে শুরু করেছে এবং পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি, প্রযুক্তি ও পর্যটনে বিনিয়োগ করেছে। একই সময়ে ভারত দ্রুত শিল্পায়ন ও ডিজিটালাইজেশনে এগোচ্ছে এবং এমন উপসাগরীয় দেশগুলোতে উৎসাহী অংশীদার খুঁজেছে, যাদের পুঁজিও আছে এবং পরিকল্পনাও আছে। ভারত চায় বিনিয়োগ ও দক্ষতা। আর উপসাগরীয় দেশগুলো চায় বড় প্রবৃদ্ধি ও নতুন নতুন সুযোগ।
এই সম্পর্কের শুরুতেই গভীর অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সহযোগিতা গড়ে ওঠে। এর মধ্যে রয়েছে আই২ইউ২ অংশীদারি। এর মধ্যে আছে ভারত, ইসরায়েল, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও যুক্তরাষ্ট্র।
ভারত-গালফ অংশীদার থেকে বোঝা যাচ্ছে, কীভাবে ডিজিটাল প্রযুক্তি উন্নয়ন চালাতে পারে। ভারতের সাশ্রয়ী ও ওপেন-সোর্স ডিজিটাল সিস্টেমের সঙ্গে উপসাগরীয় এলাকার পুঁজির মিলন আধুনিক অবকাঠামো, অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল পরিচয় এবং পরিবেশ সচেতন প্রকল্পের মাধ্যমে ভালো মজুরির কাজ তৈরি করছে।
এ ছাড়া উপসাগরের নেতারা ভারতের জাতীয় অনুষ্ঠানে সম্মানও পেয়েছেন। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, এই বছর ভারত-ইউএই বাণিজ্য ১০০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। আর ২০২৩-২৪ সালে ভারত-সৌদি বাণিজ্য হয়েছে ৪৩ বিলিয়ন ডলার।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই পুঁজির ব্যবহার। আবুধাবির মুবাদালা ও সৌদি পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড ভারতীয় স্টার্টআপ, অবকাঠামো এবং সবুজ শক্তি প্রকল্পে বড় বিনিয়োগ করেছে। এগুলো এককালীন নয়; বরং দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনার অংশ।
এই গতিশীলতা ধরে রেখে ভারত-উপসাগরীয় সম্পর্ক এখন আফ্রিকার দিকে বিস্তার করছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত পুরো মহাদেশে ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আর সৌদি আরব ৪১ বিলিয়ন ডলার উন্নয়ন উদ্যোগ ঘোষণা করেছে। ভারত আফ্রিকায় শান্তি রক্ষা মিশন, উন্নয়ন প্রকল্প ও প্রসারিত প্রবাসী সম্প্রদায়ের মাধ্যমে গড়ে তোলা ইতিবাচক সম্পর্ক নিয়ে আসে। এটি উপসাগরীয় এলাকার পুঁজিকে সহায়তা করে এবং জোটের প্রভাব বৃদ্ধি করে।
এ ছাড়া নতুন ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগে সংযুক্ত আরব আমিরাতের পুঁজির মাধ্যমে ভারতীয় কোম্পানিগুলো আফ্রিকায় অবকাঠামো নির্মাণ করছে। এটি বড় শক্তি দেশগুলোর প্রকল্পের বিকল্প, যা প্রায়ই ঋণফাঁদ এবং রাজনৈতিক শর্তের সঙ্গে আসে।
মধ্যম আকারের দেশগুলো, যারা যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের দ্বন্দ্বের মধ্যে না পড়তে চায়, তাদের জন্য ভারত-গালফ জোট নিরাপদ অবকাঠামো, প্রযুক্তি সহযোগিতা এবং নিরাপত্তা সহায়তা দিচ্ছে।
ভারত-গালফ অংশীদার থেকে বোঝা যাচ্ছে, কীভাবে ডিজিটাল প্রযুক্তি উন্নয়ন চালাতে পারে। ভারতের সাশ্রয়ী ও ওপেন-সোর্স ডিজিটাল সিস্টেমের সঙ্গে উপসাগরীয় এলাকার পুঁজির মিলন আধুনিক অবকাঠামো, অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল পরিচয় এবং পরিবেশ সচেতন প্রকল্পের মাধ্যমে ভালো মজুরির কাজ তৈরি করছে।
কিন্তু এটি কোনো নতুন ‘নন-অ্যালাইমেন্ট’ নয়। ভারত-গালফ জোট হলো ‘মাল্টি-অ্যালাইনমেন্ট’। এটি একটি বাস্তবধর্মী কৌশল, যা যৌথ স্বার্থ, পারস্পরিক সুবিধা এবং স্বাধীনতার ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে।
অবশ্যই এই জোটের সামনে চ্যালেঞ্জ আছে। আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, অভ্যন্তরীণ বিরোধ এবং বৈশ্বিক অস্থিরতা এই জোটের সামনে প্রধান বাধা। তবু দুই পক্ষের আত্মবিশ্বাস স্পষ্ট। ভারত ও উপসাগরীয় দেশগুলো অন্যের কৌশলের ওপর নির্ভর না করে তাদের নিজস্ব পথ তৈরি করছে।
যদি এই অংশীদারি টেকসই হয়, তবে এটি কেবল দ্বিপক্ষীয় সাফল্যই হবে না। ভারত-গালফ জোট দ্রুত বহুমুখী বিশ্বে একটি নতুন শক্তিকেন্দ্র হতে পারে। এটি অন্য উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর জন্য একটি উদাহরণ হতে পারে, যেখানে কোনো রাজনৈতিক দাসত্ব ছাড়াই উন্মুক্ত প্রযুক্তি, স্থিতিশীল বাণিজ্য এবং সমৃদ্ধি সম্ভব হবে।
বিবেক আগরওয়াল টনি ব্লেয়ার ইনস্টিটিউট ফর গ্লোবাল চেঞ্জ-এ ভারতের কান্ট্রি ডিরেক্টর
আলেক্সান্ডার জর্জ টনি ব্লেয়ার একই সংস্থার সিনিয়র ডিরেক্টর