রোজার মাসে যানজট: ‘হাইব্রিড অফিস’ ব্যবস্থা কেন নয়

সরাসরি যদি কথাটা বলতে হয়, তবে বলতে হবে, মানুষের কষ্ট হচ্ছে। এই রোজার মাসে, রাজধানী ঢাকার বাসিন্দারা, নিত্য যাঁদের ঘরের বাইরে বের হতে হয় রুটিরুজির প্রয়োজনে, তাঁরা মোটেও সুখে নেই। অবর্ণনীয় যানজটে পড়ে তাঁদের কষ্টের সীমা নেই। বিশেষ করে দুপুরের পর থেকে, তিনটা বাজলে যেন গাড়ি আর নড়ে না। রমজান মাসে রোজাদারদের ইচ্ছা থাকে ইফতারের আগে ঘরে ফেরা এবং পরিবারের সঙ্গে ইফতার করা। কিন্তু এ শহরে যানজটের যে অবস্থা, তাতে অনেকেরই ইফতার সারতে হয় পথে। মনে কষ্ট আর হতাশা নিয়ে তারা বাসায় ফেরেন ইফতারের পর!

এখন নগরবাসী যানজটের জন্য আর কাউকে বা কোনো সংস্থাকে দায়ী করেন না। সে পরিবেশও এখন নেই। এখন তাঁরা দায়ী করেন কেবল নিজেদের ভাগ্যকে!

দুই সিটি করপোরেশন মিলিয়ে রাজধানী ঢাকার লোকসংখ্যা কত? সর্বশেষ শুমারিতে এসেছে এক কোটি দুই লাখ। আর ঢাকা মহানগরে বাস করে দুই কোটির ওপরে মানুষ।
পদ্মা সেতু চালু হয়েছে। যোগাযোগ সহজ হয়েছে দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে। এখন ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ঢাকার আরও কাছে এসেছে। বলা যায়, এই তিন জেলা এখন ঢাকার ‘সই’। পদ্মা সেতু চালু হলে এসব জেলার যেসব কর্মজীবী মানুষ রাজধানীতে বাস করেন, তাঁরা নিজ নিজ জেলায় ফিরে যাবেন, এমন আলাপ-আলোচনা আমরা শুনেছিলাম। বাস্তবে কতজন ফিরে গেছেন, এ বিষয়ে একটা গবেষণা হতে পারে। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের এক বছর হতে যাচ্ছে আগামী ২৫ জুন। এর আগে গবেষণাটা হলে মন্দ হয় না। লোক ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে আমার মনে হয়, সংখ্যাটা অতি নগণ্য হবে। অনেকেই বলছেন, পদ্মা সেতু হওয়ার পর যোগাযোগ সহজ হওয়ায় এসব জেলার লোকদের রাজধানী অভিমুখে গমন উল্টো আরও বেড়েছে!

এখন সামনে চালু হবে বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট বা বিআরটি প্রকল্প। এ বছরের মে থেকে জুনের মধ্যে বিআরটি প্রকল্পের ২০ দশমিক ৫০ কিলোমিটার সড়কটি চালু হওয়ার কথা। এটি চালু হলে গাজীপুর, ময়মনসিংহের সঙ্গে রাজধানীর দূরত্ব আরও কমবে, চলাচল সহজ হবে। তবে চালু হলেই বোঝা যাবে পরিস্থিতি।

মূল বিষয় হলো, কর্মসংস্থানের সুযোগ। ভালো-মন্দ, ছোট-বড়-মাঝারি, নগদ-বাকি, সব ধরনের কর্মসংস্থানের কেন্দ্রবিন্দু এই ছোট্ট ঢাকা শহর। তা না হলে এই শহরে এমন কোনো মধু নেই যে দলে দলে পতঙ্গের মতো মানুষ উড়ে আসবে।

২.

কিছুতেই যখন যানজট পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে না, তখন খুব দরকার ছিল ওয়ার্ক ফ্রম হোম (ডব্লিউএফএইচ) বা বাসা থেকে অফিস ব্যবস্থা চালু করা। বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের একটা অংশ যদি বাসা থেকে অফিস করার সুযোগ পেত, মন্দ হতো না। বিশেষ করে রোজার মাসে এটা খুব কাজে লাগত। করোনাকালে ওয়ার্ক ফ্রম হোম, যার অন্য নাম হাইব্রিড অফিস ব্যবস্থা, চালু না করে উপায় ছিল না। সে ব্যবস্থাকে কোনোভাবেই অকার্যকর বলা যাবে না। হাইব্রিড বা রিমোট অফিস ব্যবস্থায় উৎপাদন কম হয়েছে, সে কথাও কেউ বলেনি বা বলছে না। তাহলে বর্তমান নতুন বাস্তবতায় হাইব্রিড ব্যবস্থা চালু করতে বাধা কোথায়?

এমন ব্যবস্থায় কর্মীদের একটা অংশ অফিসে থাকে। আরেকটি অংশ বাসায় বসে কাজ করে। যারা বাসায় অবস্থান করে কাজ করেন, তাঁরা অনলাইনের মাধ্যমে অফিসের কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। এসব কর্মী আবার প্রয়োজনে দুই বা তিন দিন পর অফিসে গিয়ে কাজের সমন্বয় করে আসেন। এ ব্যবস্থায় টিমের অদলবদলও হয়। যে টিম অফিসে কাজ করছে, একটা সময় পরে তারা হোম অফিসে যেতে পারে। একইভাবে যারা বাসায় কাজ করে, তারা অফিসে গিয়ে বসতে পারে।

পাশ্চাত্যের কিছু দেশে এমন হাইব্রিড অফিস ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে, যেখানে কর্মীরা দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অফিসে যান, বাকি সময়ে বাসা থেকেই কাজ করেন।

প্রসঙ্গত, হাইব্রিড ব্যবস্থা কোনো নতুন ধারণা নয়। কোভিড পরিস্থিতির আগেও বিশ্বের অনেক দেশে তা চালু হয়েছিল। হাইব্রিড তত্ত্ব ঘিঞ্জি অফিসের ধারণাকে সমর্থন করে না। ধরা যাক, একটি ফ্লোরে ১০০ কর্মীর বসার ব্যবস্থা আছে। ৫০ জন যদি বাসায় থেকে কাজ করেন, তবে অফিসে থাকা কর্মীরা আরেকটু আলো-হাওয়া নিয়ে মুক্তভাবে বসতে পারেন। তবে এটা নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট দেশের অফিস-সংস্কৃতি এবং প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সামর্থ্যের ওপর।

ঢাকার মতো মহানগরে, যেখানে দুই কোটির ওপরে লোকের বসবাস, সেখানে সারা বছরই হাইব্রিড অফিস ব্যবস্থা চালু থাকা বাঞ্ছনীয়। এতে কর্মীর খরচ সাশ্রয় হবে, মানসিক চাপ কমবে আবার উৎপাদনও ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। রক্ষণশীল অনুমানসিদ্ধ ধারণা থেকে বলতে পারি, তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক কিছু প্রতিষ্ঠানের কাজ বাসায় বসে করা আর অফিস বসে করার মধ্যে কোনো রকমফের নেই।

আমাদের এই ঢাকা শহরে রোজার মাসে এই হাইব্রিড ব্যবস্থা চালু করা সড়কে চাপ কমত, যানজটও কমত। নগরবাসী, বিশেষ করে যাঁরা রোজা রাখেন, তাঁরা কিছুটা স্বস্তি পেতেন। যানজটের কারণে প্রতিদিন এ শহরে চার মিলিয়ন কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে।
সবকিছু সরকার করে দেবে না। সিটি করপোরেশনের মাথা থেকেই যে সব সময় ইনোভেটিভ আইডিয়া আসবে, তা-ও নয়। তারা আমাদের মতোই মানুষ! ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মালিককেই বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। ভাবা দরকার।

রমজান মাস শেষ হতে এখনো দুই সপ্তাহ বাকি। সম্ভবত ভয়াবহ যানজটের দিনগুলো সামনে পড়ে আছে। এখন এ ধরনের কিছু করা যায় কিনা তা সংশ্লিষ্টরা ভেবে দেখতে পারে। কারণ, ঈদের কেনাকাটা শুরু হয়ে যাবে। এবার যদি সম্ভব নাও হয়, আগামী বছর থেকে রোজার মাসে হাইব্রিড অফিস কার্যকর করার বিষয়টি যেন গুরুত্বে সঙ্গে নেওয়া হয়।

তবে আমার মনে হয়, ঢাকার মতো মহানগরে, যেখানে দুই কোটির ওপরে লোকের বসবাস, সেখানে সারা বছরই হাইব্রিড অফিস ব্যবস্থা চালু থাকা বাঞ্ছনীয়। এতে কর্মীর খরচ সাশ্রয় হবে, মানসিক চাপ কমবে আবার উৎপাদনও ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। রক্ষণশীল অনুমানসিদ্ধ ধারণা থেকে বলতে পারি, তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক কিছু প্রতিষ্ঠানের কাজ বাসায় বসে করা আর অফিস বসে করার মধ্যে কোনো রকমফের নেই। গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের কিছু কাজ নিয়মিতই বাসায় বসে করা সম্ভব। যত দূর জানি, ঢাকার কিছু গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে এ রকম কর্মী আছেন, যাঁরা যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপে অবস্থান করে স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গেই কাজ করছেন।

তবে এ ব্যবস্থার কিছু সমস্যা একই সঙ্গে আছে। সাইবার নিরাপত্তা একটা ঝুঁকি হতে পারে। আর একটা সমস্যা হলো, দুর্বল ইন্টারনেটের ব্যবস্থা। হোম অফিসে ঠিকমতো কাজের ক্ষেত্রে এটা বড় সমস্যা। আবার কোনো কর্মী যদি দীর্ঘদিন হোম অফিস করেন, একপর্যায়ে তিনি নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর মধ্যে হতাশাও আসতে পারে।

এ ক্ষেত্রে উত্তম সমাধান হলো, প্রথমে হাইব্রিড অফিস পরিচালনা বিষয়ে একটি গাইডলাইন তৈরি করা। এর আওতায় অফিসের যাঁরা ব্যবস্থাপক, তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, কীভাবে তাঁরা রিমোট অফিস বা হোম অফিস সামলাবেন। পাশাপাশি একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর টিমের অদলবদল ঘটানো জরুরি। এর চেয়েও জরুরি হলো, শক্তিশালী ইন্টারনেট ব্যবস্থা চালু ও সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিনিয়োগ করা। কাজটি কি খুব কঠিন?

আমাদের কোনো প্রতিষ্ঠান রমজান মাসে বা এরপরে প্রকৃত অর্থে হাইব্রিড অফিস চালুর উদ্যোগ নেয় কি না, লক্ষ রাখব। তাদের কথাও তুলে ধরব পরবর্তী কোনো লেখায়।

  • কাজী আলিম-উজ-জামান প্রথম আলোর উপবার্তা সম্পাদক
    [email protected]