বাংলাদেশের দারিদ্র্য, আয়বৈষম্য ও মার্টিন রাভালিয়ন

অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্রের বিষয় দুটি: এক. প্রবৃদ্ধি (গ্রোথ) এবং দুই. সাম্যভাব (ইকুইটি) বা কম আয়বৈষম্য, যার সঙ্গে দারিদ্র্য ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিশ্বের অর্থনীতিবিদদের তাবৎ গবেষণা প্রবৃদ্ধি এবং প্রবৃদ্ধিসহায়ক নীতি ও বিষয় নিয়ে।

তবে সাম্যভাব, আয়বৈষম্য ও দারিদ্র্য নিয়ে গবেষণার যে ক্ষীণ ধারা অব্যাহত আছে, তার পথিকৃৎদের একজন ছিলেন মার্টিন রাভালিয়ন। অস্ট্রেলীয় এই অর্থনীতিবিদ গত ২৪ ডিসেম্বর প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর লেখা বই দ্য ইকোনমিকস অব পোভার্টি: হিস্ট্রি, মেজারমেন্ট অ্যান্ড পলিসি, আয়বৈষম্য ও দারিদ্র্য নিয়ে কর্মরত গবেষকদের জন্য আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবে।

মৃত্যুকালে তিনি জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির এডমন্ড ডি ভিলানি উদ্বোধনী চেয়ার ছিলেন। তার আগে বিশ্বব্যাংকের গবেষণা শাখার প্রধান অর্থনীতিবিদ ছিলেন। তিনি দ্য সোসাইটি ফর দ্য স্টাডি অব ইকোনমিক ইনইকুয়ালিটির সভাপতি ছিলেন। অন্য আরও কয়েকটি পুরস্কার ছাড়া তিনি ২০১২ সালে মার্কিন কৃষি ও প্রায়োগিক অর্থনীতি সমিতির ‘গালব্রেইথ পুরস্কার’ও লাভ করেন।

দারিদ্র্য গবেষণায় অবদান

মার্টিন রাভালিয়ন অস্ট্রেলিয়ার এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। অভিজ্ঞতা থেকে সিদ্ধান্ত নেন, তিনি নিজে দরিদ্র থাকবেন না। পরবর্তীকালে পেশাগত জীবনে তিনি এই গ্রহবাসীকে দারিদ্র্যমুক্ত করার ব্রত গ্রহণ করেন।

তিনি জানতেন, বেশির ভাগ অর্থনীতিবিদ তাঁর এই জীবনদৃষ্টি সমর্থন করেন না। তিনি ইতিহাসবিদ ম্যাক্স হার্টওয়েলকে উদ্ধৃত করে একসময় বলেছিলেন, ‘অর্থনীতির মূল বিষয় দারিদ্র্য অধ্যয়ন’। তাই তিনি উন্নয়নশীল দেশে দারিদ্র্য ও দারিদ্র্য দূরীকরণের বিষয়ে ব্যাপক গবেষণা করেন। ১৯৯০ সালে তিনি দৈনিক এক মার্কিন ডলার (বর্তমানে ১ দশমিক ৯ মার্কিন ডলার, ২০১১ সালের মূল্য ভিত্তিতে) দারিদ্র্যরেখা প্রস্তাব করেন। তিনি এবং বিশ্বব্যাংকে তাঁর সহকর্মীরা এ ভিত্তিতে দরিদ্রের সংখ্যা ও অর্জিত অগ্রগতি পরিমাপ করেন। ২০০৮ সালে অন্যদের সঙ্গে প্রধান সহলেখক হিসেবে এক প্রতিবেদনে তিনি দেখান যে চরম দারিদ্র্যে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ১৯৮১ সালে ১ দশমিক ৯ বিলিয়ন (দুইজনে একজন) থেকে ২০০৫ সালে ১ দশমিক ৪ বিলিয়নে (চারজনে একজন) নেমে এসেছে, যা বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণ বলে তিনি জানান। তবে একই সঙ্গে তিনি বলেন, দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য কেবল প্রবৃদ্ধিই যথেষ্ট নয়।

তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে জয়ী হতে হলে মানব উন্নয়নে বৈষম্য (প্রাথমিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা) দূর ও বিনিয়োগের জন্য দরিদ্রদের ঋণ প্রাপ্তির সুযোগ অবারিত করতে হবে। তাই দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে বিজয় দাবি না করে তিনি সতর্ক করেছেন, বর্তমান আয়বৈষম্য অব্যাহত থাকলে, আগামী ১৫ বছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও, বিশ্বের এক বিলিয়ন মানুষ দারিদ্র্যের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে পারবে না। স্বামী থেকে বিচ্ছিন্ন মায়ের ঘরে বেড়ে ওঠা রাভালিয়ন তাঁর নিজের জীবনে প্রগতিশীল সামাজিক নীতির প্রভাব, বিশেষত দরিদ্রদের জন্য শিক্ষাসহায়তার কথা উল্লেখ করেন। এসব সহায়তা না থাকলে তিনি নিজে পড়াশোনা করতে পারতেন না বলে জানান।

২০১২ সালে রাভালিয়নের লেখা এক গবেষণাপত্র বিশ্বব্যাংক ও পরবর্তীকালে জাতিসংঘের ২০৩০ সালের মধ্যে ‘চরম দারিদ্র্য’ দূরীকরণের লক্ষ্য নির্ধারণের ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়।

বাংলাদেশেও মহামারির ফলে দারিদ্র্য বেড়েছে। করোনা পরিস্থিতির আগে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) জরিপ করে দেখেছে, করোনাকালে এই হার বেড়ে হয়েছে ৪২ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে অতি দারিদ্র্য। তিন গুণ বেড়ে এটি এখন হয়েছে ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ।

বাংলাদেশের দারিদ্র্য নিয়ে গবেষণা

মার্টিন রাভালিয়ন বাংলাদেশের দারিদ্র্য নিয়েও গবেষণা করেছেন। তিনি (সহলেখক বিনায়ক সেন) ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কালচারাল চেঞ্জ পত্রিকায় ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত ‘হোয়েন মেথড ম্যাটারস: মনিটরিং পোভার্টি ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক নিবন্ধে বাংলাদেশে দারিদ্র্য পরিমাপের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ও এর সংশোধনের পথনির্দেশ করেন।

তাঁরা দেখান যে আশির দশকে দারিদ্র্য পরিস্থিতির কথিত উন্নতি কেবল ভ্রান্ত পরিমাপপদ্ধতি ও জরিপ নকশার ফলশ্রুতি। ভ্রান্ত পরিমাপ পদ্ধতি সংশোধন করে তাঁরা দেখান যে আশির দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত দারিদ্র্যের আপতন, গভীরতা ও নির্মমতা কমলেও তা পরবর্তী সময়ে টেকসই হয়নি। তাঁরা আরও দেখতে পান যে বিভিন্ন সমীক্ষায় শহুরে দারিদ্র্যের আপতন গ্রামীণ দারিদ্র্যের তুলনায় বেড়েছে—এমন দাবি ধোপে টেকে না। তাঁদের সব পরিমাপেই গ্রামীণ দারিদ্র্য শহুরে দারিদ্র্যের তুলনায় বেশি এবং তা অপরিবর্তিত আছে। আশির দশকে দারিদ্র্য পরিস্থিতির যে সামান্য উন্নতি হয়েছে, তার ফলে শহুরে দরিদ্ররাই কেবল উপকৃত হয়েছে।

দারিদ্র্য পরিমাপ ছাড়া রাভালিয়ন ও বিনায়ক সেনের লেখায় বাংলাদেশে পরিসংখ্যানব্যবস্থার ত্রুটিও উঠে এসেছে। বর্তমানে রাজনৈতিক চাপে তা আরও দুর্বল হয়েছে। দারিদ্র্য পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে হলে প্রথমেই পরিসংখ্যানব্যবস্থার ত্রুটি নিরাময় এবং এ বিভাগকে অযাচিত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত করতে হবে।

কোভিড-১৯–পরবর্তী দারিদ্র্য পরিস্থিতির অবনতি

কোভিড-১৯–এর ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস, এমনকি ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি ও সৃষ্ট বেকারত্বের কারণে বিশ্বব্যাপী এবং বাংলাদেশে দারিদ্র্য বেড়েছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, কেবল ২০২০ সালেই কোভিড-১৯ মহামারির ফলে বিশ্বব্যাপী ৯ কোটি ৭০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, কোভিড-১৯ মহামারির কারণে চরম দারিদ্র্য পরিস্থিতির অগ্রগতি তিন থেকে চার বছর পিছিয়ে গেছে।

বাংলাদেশেও মহামারির ফলে দারিদ্র্য বেড়েছে। করোনা পরিস্থিতির আগে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) জরিপ করে দেখেছে, করোনাকালে এই হার বেড়ে হয়েছে ৪২ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে অতি দারিদ্র্য। তিন গুণ বেড়ে এটি এখন হয়েছে ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ।

আরও পড়ুন

দারিদ্র্য গবেষণার ভবিষ্যৎ

ওপরেই উল্লেখ করা হয়েছে, কোভিড-১৯ মহামারি দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে অভিযানে ভাটা এনেছে। নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমেছে শতসহস্র মানুষ। দারিদ্র্য নিয়ে গবেষণার জন্য অমর্ত্য সেন, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, এস্তার দুফলো ও মাইকেল ক্রেমার নোবেল পুরস্কার পেলেও অর্থনীতির অন্যান্য শাখার তুলনায় আয়বৈষম্য ও দারিদ্র্য নিয়ে গবেষণা অনেক পিছিয়ে আছে।

কারণ, লগ্নি করা পুঁজির কর্ণধারেরা কেবল প্রবৃদ্ধির জয়গান করা গবেষণাকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে থাকেন। অথচ দারিদ্র্য নিয়ে যেমন দুর্নীতি ও দারিদ্র্য, স্বৈরাচার ও দারিদ্র্য—এমন সব বিষয় নিয়ে আরও ব্যাপক গবেষণা প্রয়োজন। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে পরিসংখ্যান সংগ্রহ ও নকশা সঠিক ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে।

এ ছাড়া দারিদ্র্য নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করাকে বিশ্বব্যাপী ও বাংলাদেশে উন্নয়ন প্রচেষ্টার কেন্দ্রবিন্দুতে আনতে হবে এবং তা করা হলেই মার্টিন রাভালিয়নের স্মৃতির প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হবে।

  • মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাবেক সচিব ও অর্থনীতিবিদ