ধরুন কোনো এক সন্ধ্যায় আপনি পরিবারের সবার সঙ্গে বসে আড্ডা দিচ্ছেন। টেলিভিশনে বসে আলোচনা অনুষ্ঠান শুনছেন। সেই আলোচনা অনুষ্ঠানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ পুলিশের কোনো বড় কর্মকর্তা হয়তো দেশের মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলছেন।
তিনি হয়তো বলছেন, বাংলাদেশ পুলিশ দেশের মানুষের নিরাপত্তার জন্য সব রকম কাজ করে চলেছে। কারও ভয়ের কিছু নেই। আপনিও হয়তো সেই অনুষ্ঠান দেখে আশ্বস্ত হলেন, যাক নিরাপত্তা নিয়ে হয়তো ভাবতে হবে না। অন্তত চোর-ডাকাত-ছিনতাইকারীর হাত থেকে তো বাঁচা যাবে। এর খানিক বাদেই হঠাৎ অচেনা একটা নম্বর থেকে আপনার কাছে ফোন এসেছে।
আপনি হয়তো ভাবছেন, এই সন্ধ্যায় অচেনা নম্বর থেকে ফোন দেবে কে? পরিবারের সঙ্গে ভালো সময় কাটাচ্ছেন। এমন মুহূর্তে অচেনা নম্বর থেকে আসা ফোন ধরার ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও ফোনটি ধরলেন। ওপাশ থেকে কেউ একজন বলছেন, ‘আমি সিআইডির অমুক, আপনার নাম কি তমুক? আগামীকাল দুপুরের মধ্যে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কার্যালয়ে এসে দেখা করবেন।’
পরের দিন সিআইডি পরিচয়ে আপনাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো। এরপর একটা জায়গায় আটকে রেখে নির্যাতন করে আপনার কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হলো।
যেই আপনি টেলিভিশনের টক শো দেখে ভাবছিলেন, যাক পুলিশের বড় অফিসার যখন বলছেন দেশের আইনশৃঙ্খলা ভালো আছে। পুলিশ সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। অন্তত চোর-ডাকাত-ছিনতাইকারীর ভয়ে থাকা লাগবে না। সেই আপনাকেই কিনা পুলিশ বাহিনীর কিছু সদস্য অপহরণ করেছেন। আপনার কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
এমন পরিস্থিতিতে আপনি যদি বেঁচেও ফেরেন—এ দেশ, এ সমাজ কিংবা এ দেশের পুলিশ বাহিনীর ওপর আপনার কি আদৌ আস্থা থাকবে? কিংবা এই খবর অন্য যাঁরা পড়বেন, মানে দেশের সাধারণ মানুষ কি আদৌ পুলিশ বাহিনীকে নিঃসংকোচে বিশ্বাস করতে পারবেন?
এমন ঘটনাই বাস্তবে ঘটেছে। প্রথম আলোয় খবরের শিরোনাম হয়েছে—‘সিআইডির এসআইয়ের নেতৃত্বে অপহরণকারী চক্র।’
এই খবরে বলা হয়েছে, সিআইডির একজন এসআই ও কনস্টেবল মিলে দিনের পর দিন ঢাকা শহরের অনেক মানুষকে এভাবে অপহরণ করে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। একজন ব্যবসায়ী সাহস করে এরপর অভিযোগ করলে পুরো ঘটনা সামনে আসে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কতজন মানুষের সাহস হবে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা? সেই অভিযোগ তো পুলিশ বিভাগেই করতে হয়। বেশির ভাগ মানুষই হয়তো সাহস করবেন না।
ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা এত শুনছি। এসব ‘ডিজিটাল’ ব্যাপার কি কেবল মুখে বলার জন্যই, নাকি বাস্তবে কাজের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য? এই যে পুলিশের এসআই ফোন করে মানুষকে বলছেন সিআইডি অফিসে দেখে করতে। কোন অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশের একজন সদস্য সাধারণ মানুষকে এভাবে সিআইডি অফিসে যেতে বলেন? একজন মানুষকে যদি পুলিশের তুলে নিয়ে যেতেই হয় কিংবা তাঁকে যদি পুলিশ অফিসে যেতে হয়, তাঁর জন্য কি কোনো ইউনিক ব্যবস্থা নেওয়া যায় না? যাতে পুলিশ বাহিনীর ভেতরকার মানুষ এমন চাঁদাবাজি আর অপহরণের সঙ্গে নিজেরাই জড়িয়ে না যান।
রাস্তায় মানুষকে থামিয়ে ইয়াবা পকেটে দিয়ে কিংবা অন্যান্য মাদক দিয়ে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা তো প্রায়ই সামনে আসে। কেন বাংলাদেশ পুলিশ এত দিনেও এসব থেকে মুক্ত হতে পারছে না? তাদের কি ইচ্ছার অভাব আছে? এই নিয়ে তো প্রশ্ন তোলাই যায়।
কাউকে যদি আপনার অফিসে যাওয়ার কথা বলতেই হয়, তাঁর বিরুদ্ধে আগে অভিযোগ করুন। সেই অভিযোগ এরপর কোনো একটা ওয়েবসাইট কিংবা ডেটাবেজে সঙ্গে সঙ্গে দাখিল করুন। এতে যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, সেও যেন সঙ্গে সঙ্গে জানতে পারেন কোন ওয়েবসাইট কিংবা অ্যাপে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, অথবা কোনো ইউনিক নম্বর রাখুন, যেখানে তিনি ফোন করে সঙ্গে সঙ্গে জানতে পারবেন, তাঁর বিরুদ্ধে আদৌ কোনো অভিযোগ আছে কি না।
সে ক্ষেত্রে যেকোনো পুলিশ অফিসার চাইলেই যে কাউকে ফোন করে অফিসে যেতে বলতে পারবেন না। অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করতে পারবেন না। এটা তো খুব কঠিন কিছু নয়। চাইলেই এটি সম্ভব। কিংবা অন্য আরও পদ্ধতি খুঁজে বের করতে হবে।
এভাবে তো দিনের পর দিন চলতে পারে না। পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা যাতে এমন কাজে জড়িত না হন। এর ব্যবস্থা তো বাংলাদেশ পুলিশকেই নিতে হবে।
দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা ধারণা প্রচলিত আছে, পুলিশ মানুষের বন্ধু নয়। মানুষ পুলিশ দেখলে ভয় পায়। অথচ হওয়ার তো কথা ছিল উল্টো। পুলিশের কাজ তো মানুষের নিরাপত্তা দেওয়া। তাহলে কেন মানুষ পুলিশ দেখলে ভয় পাবে? কোথায় চোর-ডাকাত কিংবা অপরাধীদের উচিত পুলিশকে ভয় পাওয়া। এই যে দেশ থেকে কোটি কোটি টাকা অপরাধীরা পাচার করে দিচ্ছে। তারা কি পুলিশকে ভয় পায়? দেখা যাবে উল্টো তাদের সঙ্গে পুলিশের অনেক সদস্যের গলায়-গলায় ভাব! আর সাধারণ মানুষ, যারা নিরাপরাধ। যারা কোনো কিছুর আগে-পিছে নেই।
সেই মানুষগুলো উল্টো পুলিশকে ভয় পায়! কেন পায়? এই প্রশ্ন কি বাংলাদেশ পুলিশ কখনো নিজেরা করেছে? কখনো কি তারা চেষ্টা করেছে মানুষের এই ভয়টা যাতে ভেঙে যায়? যাতে পুলিশ মানুষের বন্ধু হতে পারে। নাকি উল্টো তারা চায়—মানুষ তাদের ভয় পাক?
ড. আমিনুল ইসলাম জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, এস্তোনিয়ান এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ইউনিভার্সিটি
ই-মেইল: [email protected]