যে কারণে পশ্চিমে ডানপন্থীদের উত্থান হচ্ছে

পশ্চিমা দুনিয়ার রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন চলে আসছে। ইউরোপের অনেক দেশে অতি–ডানপন্থীদের উত্থানে সেটিই প্রমাণ করে। ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রেও শক্ত অবস্থানে অতি–ডানপন্থীরা
ছবি: রয়টার্স

খুব বেশি দিন হয়নি, যখন ইউরোপের অতি ডানপন্থীরা সেই সব স্মৃতি রোমন্থনবিলাসী বুড়োদের ধ্যানধারণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যাঁরা পুরোনো দিনের নিয়মকানুন ও সামাজিক রীতিনীতি সুখস্মৃতিতে বুঁদ হয়ে থাকাতেই আনন্দ পেতেন।

কিন্তু আজ মনে হচ্ছে তেমনই দিন ফিরে আসতে চলেছে। ফ্রান্স ও ইতালির বর্তমানে নারীদের নেতৃত্বে থাকা অতি-ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো মূলত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন হিটলারের নাৎসি বাহিনী এসএসের সাবেক অফিসাররা, ফ্রান্সের তৎকালীন স্বৈরাচারী সরকারের সহযোগীরা এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ছায়া থেকে উদ্ভূত অন্য প্রাচীনপন্থী ব্যক্তিত্বরা।

সুইডেনে সম্প্রতি ২০ দশমিক ৬ শতাংশ ভোট পেয়ে যে ডেমোক্র্যাট দল জিতেছে, তার ক্ষেত্রেও সেই একই কথা প্রযোজ্য।

স্পষ্টতই ইউরোপের ফ্যাসিবাদী-উত্তর আকাশে অনেক কিছু পরিবর্তিত হয়েছে। ইতালির ডানপন্থী ব্রাদার্স অব ইতালি পার্টির নেতা জর্জিয়া মেলোনি ইতালির প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন।

মারিঁ লো পেনের ন্যাশনাল র‍্যালি পার্টি ফরাসি পার্লামেন্টে ৮৯টি আসন জিতেছে। আর সুইডেনের ডেমোক্র্যাটরা সরকারের বাইরে থাকলেও জাতীয় রাজনীতিতে তারা শক্তিশালী কণ্ঠস্বর হিসেবে থাকছে। শুধু নারীরাই নয়, স্যুট–বুট পরা চৌকস অল্প বয়সী পুরুষেরাও এখন ইউরোপিয়ান চরম দক্ষিণপন্থার দিকে ঝুঁকছেন। ইউরোপের মধ্যপন্থী রক্ষণশীল দলগুলো এখনো চরমপন্থীদের দখলে যায়নি, যেমনটি যুক্তরাষ্ট্রে রিপাবলিকান পার্টির ক্ষেত্রে হয়েছে। কিন্তু ভোট হারানোর ভয় তাদেরও সেদিকে ধাবিত করছে।

এর মানে এই নয় যে আমরা ১৯৩৩ সালে ফিরে যাচ্ছি। ইতিহাস কখনো একইভাবে ফিরে আসে না। আমাদের মনে রাখতে হবে, মেলোনি কিন্তু মুসোলিনি নয়, আর হিটলারও আজ নেই। তবে যেকোনো ক্ষেত্রেই ডানপন্থী চরমপন্থার অনেকগুলো সংস্করণ থাকে।

যুদ্ধপূর্ব ফ্যাসিবাদের ক্ষেত্রেও তাই ছিল। প্রতিটি দেশের নিজস্ব ইতিহাস আছে এবং জনগণকে উন্মাতাল করার ক্ষেত্রে জনতুষ্টিবাদীদের নিজস্ব ব্র্যান্ড রয়েছে। অবশ্য এটিও সত্য, ডানপন্থী জনমোহিনীবাদের সব রূপের মধ্যে কিছু বিষয়ে সাধারণ মিল রয়েছে। জন–অসন্তোষকে পুঁজি করা রাজনীতি এমন লোকদের কাছে নিজেদের নিবেদন করে থাকে, যারা পিছিয়ে পড়া এবং নিজেদের বঞ্চিত ও উপেক্ষিত বোধ করে। বেশির ভাগ দেশে আপনি জনমনের যত গভীরে যাবেন, তত বেশি তথাকথিত অভিজাতদের প্রতি তাদের খারাপ ধারণা দেখতে পাবেন।

বর্ণবাদ যুক্তরাষ্ট্রে তার স্বাভাবিক বিধ্বংসী ভূমিকা পালন করে থাকে। সেখানে বিশেষত গ্রামপ্রধান অঞ্চলের অনেক সাদা মানুষ জনজীবনে কালো মানুষের উত্থানকে মেনে নিতে পারে না এবং সর্বত্র অভিবাসীদের প্রতি তাদের ভয় ও ঈর্ষা শেষ পর্যন্ত তাদের শত্রুতার দিকে নিয়ে যায়। এসব সমাজে এমন কিছু লোক আছে, যারা তাদের সমাজ থেকে স্বীকৃতি না পেয়ে কিংবা সাফল্যের অভাবের কারণে অপমানিত বোধ করে। এদের মধ্যে আছে ব্যর্থ লেখক, তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষাবিদ, ক্রমবর্ধমানভাবে উন্নতি করা পরিবারের কিছু তরুণ-তরুণী যারা তাদের প্রতিভা অনুযায়ী সমাজে মূল্য পায় না। এ অনুভূতি নিয়ে বেড়ে ওঠা মানুষের সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ইউরোপে এখন অনেক বেশি।

যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টি বা যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাটদের মতো মূলধারার দলগুলো কিসের পক্ষে দাঁড়িয়েছে তা বেশ স্পষ্ট। তারা যেসবের পক্ষে কথা বলে সেগুলো হলো: আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববাণিজ্য, নমনীয় ও উদার অভিবাসন নীতি ইত্যাদি। সমস্যা হলো এটি তাদের মধ্যপন্থী রক্ষণশীল দলগুলো থেকে খুব কমই আলাদা করে।

অতি–ডানপন্থী দলগুলোর সাম্প্রতিক নির্বাচনী সাফল্যগুলোকে প্রায়ই তাদের মূলধারার প্রতিদ্বন্দ্বীদের ব্যর্থতার ফল হিসেবে দেখা হয়। তাদের মূলধারার প্রতিপক্ষগুলোকে সমন্বয় করার ক্ষমতার অভাবের জন্য ব্যাপকভাবে দায়ী করা হয়। অনেকে বলে থাকেন, উদারপন্থী কিংবা বামপন্থী বা মধ্য বামপন্থীরা যে কাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে, সেটা তারাই ভালো করে তুলে ধরতে পারছে না।

অবশ্য এটা যে সর্বাংশে সত্য, তা–ও নয়। যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টি বা যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাটদের মতো মূলধারার দলগুলো কিসের পক্ষে দাঁড়িয়েছে তা বেশ স্পষ্ট। তারা যেসবের পক্ষে কথা বলে সেগুলো হলো: আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববাণিজ্য, নমনীয় ও উদার অভিবাসন নীতি ইত্যাদি। সমস্যা হলো এটি তাদের মধ্যপন্থী রক্ষণশীল দলগুলো থেকে খুব কমই আলাদা করে।

প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের রাজনীতি মৌলিক দিক থেকে তার পূর্বসূরি জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশের চেয়ে আলাদা কিছু ছিল না। একই কথা যুক্তরাজ্যে টনি ব্লেয়ার ও ডেভিড ক্যামেরন এবং জার্মানিতে গেরহার্ড শ্রোয়েডার ও আঙ্গেলা ম্যার্কেলের ক্ষেত্রেও সত্য।

ইউরোপে ১৯৯০ এবং ২০০০ এর দশকে অনেক ইউরোপীয় সরকার গঠিত হয়েছিল মধ্য-বাম এবং মধ্য-ডান দলগুলোর সমন্বয়ে গঠিত জোট দিয়ে। তখন টেকনোক্র্যাট বা রাজনৈতিক ম্যানেজারদের শাসন রীতি হয়ে উঠেছিল। ফলস্বরূপ, ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো ডানপন্থী জনতুষ্টিবাদীরা শুধু বামদের প্রতি মানুষের ঘৃণাকে নয়, বরং রক্ষণশীল প্রতিষ্ঠানের প্রতি থাকা জনঘৃণাকেও কাজে লাগিয়েছেন।

কিন্তু প্রগতিশীলেরা রক্ষণশীলদের চেয়েও বেশি বিরক্তির কারণ হওয়ার পেছনে একটি জোরালো কারণ আছে। সেটি হলো মানুষ ভণ্ডামিকে ঘৃণা করে। এটা অবশ্যই স্বীকার্য যে একটি মুক্ত সমাজে একটি মাত্রা পর্যন্ত ভণ্ডামি থাকাটা অস্বাভাবিক নয়।

রাজনীতিবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে দেখলে বলা যায়, নৈতিক বা আদর্শগত নির্জলা বিশুদ্ধতা উদার গণতন্ত্রের শত্রু। ঠিক যেমনটি সব সময় আপনি যা মনে মনে ভাবেন কিন্তু তা প্রকাশ করা ভালো আচরণের লক্ষণ নয়, তেমনি আদর্শগত বিশুদ্ধতা মেনে চলা গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতি ডেকে আনে।

কিন্তু একটি বিশেষ ধরনের বামপন্থী ভণ্ডামি রয়েছে, যা অনেকের কাছে বিশেষভাবে বিরক্তিকর বলে মনে হয়।

ইতালিসহ ইউরোপে ডানপন্থীদের উত্থানের পেছনে এটি একটি বড় কারণ।

 স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে অনূদিত

  •  ইয়ান বুরুমা দ্য চার্চিল কমপ্লেক্স: দ্য কার্স অব বিয়িং স্পেশাল এবং উইনস্টন অ্যান্ড এফডিআর টু ট্রাম্প অ্যান্ড ব্রেক্সিট বইয়ের লেখক