একনায়কত্ব বা গণতন্ত্র, ইউরোপের ভবিষ্যৎ কোন পথে

ইইউ নেতাদের উচিত সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তি নিয়ে ইউক্রেনের সঙ্গে আলোচনা শুরু করাফাইল ছবি

ইউরোপীয় কাউন্সিলে এখন উদারবাদ ও জনতুষ্টিবাদের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছে। সামনের বছরগুলো কেমন যাবে, তা নির্ভর করছে যুদ্ধের জয়-পরাজয়ের ওপর।

চলতি বছর ইউরোপের ২০টি দেশ ভ্রমণের সুযোগে আমি দুই ধরনের ইউরোপ দেখেছি। এ মহাদেশের বড় অংশ এখনো ইউরোপ। বিদ্যুৎগতির ট্রেনে চেপে আপনি একটির পর একটি সীমান্ত পেরিয়ে যাবেন, খেয়ালও করবেন না। এসব দেশ মূলত উদার গণতান্ত্রিক দেশ, যারা নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধান করে নিয়েছে।

কিন্তু একটা পুরোনো ধীরগতির ট্রেনে চেপে পূর্ব দিকের দেশগুলোর উদ্দেশে কয়েক ঘণ্টার একটা ভ্রমণ করুন। বোমা হামলা থেকে বাঁচতে আশ্রয়শিবিরে জায়গা নেওয়া মানুষের দেখা পাবেন। সেখানে মারাত্মক আহত সৈন্যদের কাছ থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের গল্প শুনতে পাবেন।

আমি আমার ফোনে ‘এয়ার অ্যালার্ম ইউক্রেন’ অ্যাপ রেখেছি। প্রতিদিন এই অ্যাপে যখন ইউক্রেনে বোমা হামলার সংকেত বেজে ওঠে, তখন তা আমাকে অন্য ইউরোপের কথা মনে করিয়ে দেয়।

আরও পড়ুন

আমাদের রাজনীতিতে পরস্পরবিরোধী নানা উপাদান আছে। এদের কোনো কোনোটি সম্পর্কযুক্ত, আবার কোনো কোনোটি স্বতন্ত্র।

ইউরোপীয় অনেক দেশের সরকার আছে যেগুলো কেন্দ্র-বাম বা কেন্দ্র-ডানপন্থী। কখনো কখনো সরকারগুলো আবার বিপরীত ধ্যান–ধারণার দলের সঙ্গে জোট বেঁধেছে। কিন্তু তারপরও তারা সবাই চায় উদারবাদী গণতন্ত্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন কার্যকর থাকুক।

এই তো সেদিন পোল্যান্ডে আমরা ডোনাল্ড টাস্কের নেতৃত্বে এমন একটি সরকারকে দায়িত্ব নিতে দেখলাম। উদারবাদী গণতন্ত্রকে ধ্বংসকারী একটি জনতুষ্টিবাদের সরকারকে সরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে তারা। অন্যদিকে, অতি ডানপন্থী জনতুষ্টি ও জাতীয়তাবাদী দলগুলোও উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে।

গত বছর জর্জিয়া মেলোনির উত্থান ঘটেছে ইতালিতে, আঞ্চলিক নির্বাচনগুলোয় ভালো ফল করেছে জার্মানির অলটারনেটিভ ফর ডয়েচেল্যান্ড (এএফডি), নেদারল্যান্ডে জিতেছেন খেয়ার্ট ভিল্ডার্স।

হাঙ্গেরীয় নেতা ভিক্টর ওরবান এখন আগের চেয়ে বেশি আগ্রাসী। তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হিসেবে সব সুযোগ-সুবিধা নিয়ে ইইউর স্বার্থ ও মূল্যবোধবিরোধী কাজ করে চলেছেন। (ব্রেক্সিটাররা অন্তত যে ক্লাবকে ঘৃণা করে, সে ক্লাব থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মতো সততা দেখিয়েছে)

এই দুই ইউরোপ ইইউ সম্মেলনে একটি রাজনৈতিক যুদ্ধে লিপ্ত হতে যাচ্ছে। এই সম্মেলনের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে ইউরোপ কি যুদ্ধের দিকে এগোবে, নাকি শান্তির দিকে, তারা কি একনায়কতন্ত্রের পক্ষে থাকবে, নাকি গণতন্ত্রের পক্ষে? তারা কি বিচ্ছিন্নতা চায়, নাকি ঐক্য।

গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে ভ্লাদিমির পুতিনের সামগ্রিক অভিযান শুরুর মধ্য দিয়ে প্রাচীর-পরবর্তী যুগের সমাপ্তি ঘটে। এই পর্বের সূচনা হয়েছিল ৯ নভেম্বর, ১৯৮৯ সালে বার্লিন প্রাচীরের পতনের মধ্য দিয়ে।

এখন আমরা যে সময়কাল অতিক্রম করছি, তার কোনো নাম বা চরিত্র আমরা এখনো জানি না। রাজনীতিতে অন্য যেকোনো সম্পর্কের মতো সূচনাটা গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৪৫ সালের পরবর্তী কয়েক বছরে ইউরোপ কীভাবে পরিচালিত হবে, তার একটি মানদণ্ড ঠিক করে দেওয়া হয়েছিল। এই মানদণ্ড কয়েক দশক অক্ষুণ্নও ছিল, ঠিক যেমনটি আমরা দেখলাম ১৯৮৯ সালের পর থেকে কয়েক দশক অবধি।

বিচক্ষণ ইউরোপীয় নেতারা এ কথা জানেন। হাজারো রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিবৃত্তিক সংগঠনগুলো এসব নিয়ে ওয়েবিনারে কথা বলছে। জার্মানি ও ডেনমার্কের মতো দেশগুলোর রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ইস্যুতে যে দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, তা পাল্টে গেছে। ন্যাটো থেকে নিরপেক্ষ দূরত্ব বজায় রাখার মনোভাব থেকে ফিনল্যান্ড ও সুইডেন সরে গেছে। কিন্তু বৃহত্তর সমাজে এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন স্পষ্ট নয়।

আরও পড়ুন

এ বছরের শুরুতে গটিঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্র আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ১৯৪৫ সালের পর ইউরোপে সবচেয়ে বড় যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ‘টুয়েন্টিটুআরস’ নামে কোনো নতুন ইউরোপীয় প্রজন্ম তৈরি হবে কি না, যারা উন্নততর ইউরোপ নির্মাণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হবে?

এরপর এ মহাদেশের যেখানেই আমি গিয়েছি, সেখানেই আমি এই প্রশ্ন করেছি। যে জবাব এসেছে, তা মোটেই উৎসাহব্যঞ্জক না। এমনকি চেক রিপাবলিক ও স্লোভাকিয়াতেও মানুষ মাথা নেড়ে বলেছেন, তাঁরা এমন কিছুর সম্ভাবনা দেখছেন না। আরও পশ্চিমের দেশগুলো যেমন ইতালি, স্পেন, পর্তুগাল অথবা আয়ারল্যান্ডে এই জবাব সুদৃঢ় ‘না’।

এর পেছনে একটা কারণ হলো, ১৯৪৫ সালের পর ইউরোপীয় ব্যবস্থার ব্যাপকতা, যা ১৯৮৯ সালের পর আরও ব্যাপক ও গভীর হয়। ন্যাটো ও ইইউভুক্ত দেশগুলো এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না যে যুদ্ধ তাদের সদর দরজায় এসে পৌঁছতে পারে।

দেশের অভ্যন্তরে সমস্যার পাহাড়, মূল্যস্ফীতির কারণে কল্যাণরাষ্ট্রগুলোয় প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই—এসব কারণে দেশগুলো আমাদের চারপাশের বিকট চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হতে চাইছে না। হোক তা পূর্ব দিকে চলমান যুদ্ধ, দক্ষিণে অভিবাসনের চাপ, উত্তরের বরফ গলা থেকে শুরু করে পশ্চিমে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্থান। তাদের রাজনীতিকেরাও এ নিয়ে সরাসরি কিছু বলতে চান না, পাছে নির্বাচনী জয় হাতছাড়া হয়ে যায়!

এই দুই ইউরোপের দ্বন্দ্বের মধ্যে এই বড়দিনের আগেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন কিছু সমস্যার সমাধান করতে চায়। এ সপ্তাহের ইউরোপিয়ান কাউন্সিলে ইইউ নেতাদের উচিত সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তি নিয়ে ইউক্রেনের সঙ্গে আলোচনা শুরু করা, দেশটিকে সামরিক ও আর্থিক সহযোগিতা দেওয়া (বিশেষ করে, যখন ওয়াশিংটন বিপদে পড়েছে)। কিন্তু ওরবান এ সবকিছুতেই ভেটো দিয়ে বসবেন।

তাদের ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ নিয়েও আলোচনায় বসতে হবে। এই ইস্যুতেও ইইউ দ্বিধাবিভক্ত এবং এখন পর্যন্ত অকার্যকর। যদিও এই দ্বন্দ্ব আমাদের নিজ নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যকার সম্পর্ককে হুমকিতে ফেলেছে। তা ছাড়া প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পুনর্নির্বাচিত হলে আমাদের সাড়ে সর্বনাশ হওয়ার আশঙ্কা আছে। এই প্রেক্ষাপটে আমাদের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষানীতিও জোরদার করা প্রয়োজন।

এই দুই ইউরোপের মধ্যে আসলে কোনটি টিকে থকবে? বছরজুড়ে এ প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি আমি। কারণ, ঐতিহাসিকদের তো নিশ্চয়ই এসব খবর জানার কথা। কিন্তু আসলে এর জবাব অপরিহার্যভাবে শুধু ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার মধ্যেই নিহিত আছে, এমন নয়। পুরোটাই নির্ভর করছে আমাদের ওপর।

নিবন্ধটি গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া ও ঈষৎ সংক্ষেপিত অনুবাদ। টিমোথি গার্টন অ্যাশ গার্ডিয়ানের কলাম লেখক। তাঁর সর্বসাম্প্রতিক বই হোমল্যান্ডস: আ পারসোনাল হিস্ট্রি অব ইউরোপ ইউরোপের ২০টি ভাষায় ভাষান্তরিত হয়েছে।

টিমোথি গার্টন অ্যাশ গার্ডিয়ান–এর কলাম লেখক। তাঁর সর্বসাম্প্রতিক বই হোমল্যান্ডস: আ পারসোনাল হিস্ট্রি অব ইউরোপ ইউরোপের ২০টি ভাষায় ভাষান্তরিত হয়েছে।


গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া ও সংক্ষেপিত অনুবাদ