ট্রাম্পের পরিপূরক শুল্ক নিয়ে সারা বিশ্ব নাকানিচুবানি খাচ্ছে। কেউ কেউ ট্রাম্পের সঙ্গে বিভিন্ন চুক্তি করে কিছুটা হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে, তার মধ্যে বাংলাদেশও আছে। তবে নিশ্চিন্ত হওয়ার উপায় নেই, ট্রাম্প আবার নতুন করে কখন কী চেয়ে বসবেন, তার কোনো ঠিক নেই। বড্ড বিপদে ভারত ও ব্রাজিল। তাদের গলায় এখনো ৫০ শতাংশের শুল্ক ঝুলে আছে।
এর মধ্যে একটা ভালো খবর এসেছে খোদ যুক্তরাষ্ট্র থেকে। আগস্টের ২৯ তারিখ যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল আপিল আদালত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত বাতিল করে দিয়েছে। এর ফলে বাড়তি শুল্ক প্রয়োগ বন্ধ হওয়ার এবং ট্রাম্প প্রশাসন বিভিন্ন আমদানি থেকে যে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বাড়তি শুল্ক আদায় করেছে, তা ফিরিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
এর আগে মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের এক নিম্ন আদালত ট্রাম্পের নতুন শুল্কনীতি বাতিল করে দিয়েছিলেন। তখন ধারণা করা হয়েছিল, ফেডারেল কোর্ট নিম্ন আদালতের রায় বাতিল করে দেবেন এবং ট্রাম্পের শুল্ক হুংকার থামানোর কোনো উপায় থাকবে না। কিন্তু ফেডারেল কোর্টের রায় এখন ট্রাম্পের পরিপূরক শুল্ককে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এবং যদি সুপ্রিম কোর্ট ফেডারেল কোর্টের রায় বহাল রাখেন, ট্রাম্পের শুল্কনীতি পুরোপুরি বাতিল হয়ে যাবে।
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সার্কিটের আপিল আদালত ৭-৪ ভোটে নিম্ন আদালতের এই সিদ্ধান্ত বহাল রেখেছেন যে ট্রাম্প ১৯৭৭ সালের আইন, আন্তর্জাতিক জরুরি অর্থনৈতিক ক্ষমতা আইন (আইইইপিএ) ব্যবহার করে যে বর্ধিত শুল্ক আরোপ করেছেন, তা তাঁর ক্ষমতার বাইরে। তিনি তাঁর কর্তৃত্ব লঙ্ঘন করেছেন।
ঐতিহাসিকভাবে শুধু দেশের বিরুদ্ধে হুমকির ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য জরুরি আইন ব্যবহার করা যায়। তাই পরিপূরক শুল্ক বৃদ্ধি জরুরি আইনের আওতায় পড়ে না।
ফেডারেল কোর্টের রায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠরা লিখেছেন, ‘আমরা উপসংহারে পৌঁছেছি যে ট্রাম্প তাঁর ব্যাপক নির্বাহী আদেশে যে ধরনের শুল্ক আরোপ করেছিলেন, সেই ধরনের শুল্ক আরোপের জন্য কংগ্রেস প্রেসিডেন্টকে বিস্তৃত ক্ষমতা দেয়নি।’
ফেডারেল বিচারকেরা আন্তর্জাতিক জরুরি অর্থনৈতিক ক্ষমতা আইনের বরাত দিয়ে আরও লিখেছেন, ‘এই আইন রাষ্ট্রপতিকে ঘোষিত জাতীয় জরুরি অবস্থার প্রতিক্রিয়ায় বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য উল্লেখযোগ্য ক্ষমতা প্রদান করে, কিন্তু এই পদক্ষেপগুলোর কোনোটিতেই স্পষ্টভাবে শুল্ক বা অনুরূপ কর আরোপের ক্ষমতা অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।’
যারা অতিরিক্ত শুল্ক দিয়ে আসছিল যেমন কানাডা, মেক্সিকো—তারা কি তাদের বাড়তি শুল্ক ফেরত পাবে? যেসব দেশকে ট্রাম্পের চাপে পড়ে অনিচ্ছাকৃতভাবে অনেক চুক্তি করতে হয়েছিল এবং অনেক ছাড় দিতে হয়েছিল, সেগুলোর কী হবে? বাংলাদেশও তাদের দলে। অনেকে বলবেন, এসব চুক্তির থেকে বের হওয়ার কোনো সহজ উপায় নেই।
মজার ব্যাপার হলো, আপিল আদালত মামলার কিছু অংশ নিম্ন আদালতে ফেরত পাঠিয়েছে। যাতে পুনর্বিবেচনা করা হবে যে সরকার কি ইতিমধ্যেই বাড়তি শুল্ক পরিশোধ করা সব কোম্পানিকে ট্যারিফ ফেরত দেবে, নাকি শুধু সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করা পক্ষগুলোকেই ট্যারিফ ফেরত দেবে?
ট্রাম্পও ছাড়ার লোক নন। ট্রাম্পের লোকেরা এর মধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, তাঁরা সুপ্রিম কোর্টে আপিল করবেন। রায়ের পরপরই ট্রাম্প ট্রুথ সোশ্যালে এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে পোস্ট করেছেন। লিখেছেন, ‘একটি অত্যন্ত পক্ষপাতদুষ্ট, আপিল আদালত ভুল বলেছে যে আমাদের শুল্ক অপসারণ করা উচিত, কিন্তু তারা জানে যে শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রই জিতবে। যদি এই শুল্ক কখনো চলে যায়, তবে এটি দেশের জন্য সম্পূর্ণ বিপর্যয় হবে।’
এখন কী হবে? এটা এখন অবধারিতভাবে সুপ্রিম কোর্টে যাবে। সুপ্রিম কোর্টের বেশির ভাগ বিচারক রক্ষণশীল, তাঁরা অনেক ক্ষেত্রেই ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থন করে থাকেন। ৯ জন বিচারপতির মধ্যে ৬ জনকে রিপাবলিকান রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করেছিলেন। এর মধ্যে তিনজনকে ট্রাম্প তাঁর প্রথম মেয়াদে নিয়োগ দিয়েছিলেন।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারকেরা যে সব সময় তাঁদের নিয়োগকর্তাদের সমর্থন করে রায় দেন, তা অবশ্যই নয়। তাঁরা যদি মনে করেন প্রেসিডেন্ট তাঁকে দেওয়া ক্ষমতা অতিক্রম করেছেন, তাহলে তাঁরা প্রেসিডেন্টের বিপক্ষে যাবেন। শুল্কের ক্ষেত্রে যেহেতু ফেডারেল কোর্টসহ দুটি আদালত প্রেসিডেন্টের বিপক্ষে রায় দিয়েছেন, সে ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টও এর বিরুদ্ধে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তা ছাড়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘আন্তর্জাতিক জরুরি অর্থনৈতিক ক্ষমতা আইন’ খুব সুনির্দিষ্ট, একে সম্প্রসারিত করার সুযোগ নেই।
সুপ্রিম কোর্ট কীভাবে রায় দেবেন, তা দেখতে শুধু আমেরিকায় নয়, বিশ্বের সাতটি দেশের জনগণ আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করবে। সুপ্রিম কোর্টের রায় না আসা পর্যন্ত ট্রাম্পের পরিপূরক শুল্ক বহাল থাকবে।
ট্রাম্পের শুল্কনীতি যদি সুপ্রিম কোর্ট নাকচ করে দেন, তাহলে কী হবে? ট্রাম্পের বাড়তি শুল্ক উঠে যাবে, বিশ্বের দেশগুলো হাঁপ ছেড়ে বাঁচবে। কিন্তু এরপরও অনেক বিষয়ের সুরাহা কীভাবে হবে, তা নিশ্চিত নয়।
যারা অতিরিক্ত শুল্ক দিয়ে আসছিল যেমন কানাডা, মেক্সিকো—তারা কি তাদের বাড়তি শুল্ক ফেরত পাবে? যেসব দেশকে ট্রাম্পের চাপে পড়ে অনিচ্ছাকৃতভাবে অনেক চুক্তি করতে হয়েছিল এবং অনেক ছাড় দিতে হয়েছিল, সেগুলোর কী হবে? বাংলাদেশও তাদের দলে। অনেকে বলবেন, এসব চুক্তির থেকে বের হওয়ার কোনো সহজ উপায় নেই।
সুপ্রিম কোর্টে হারলে ট্রাম্প কি বসে থাকবেন? তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করবেন পরিপূরক শুল্ককে বাঁচিয়ে রাখতে—বাড়তি ডলারের চেয়েও এটা তাঁর মান–ইজ্জতের ব্যাপার। তিনি সম্ভবত চেষ্টা করবেন, কংগ্রেসকে চাপ দিয়ে নতুন আইন করতে। এখন যদিও কংগ্রেসে ট্রাম্পের দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে, নভেম্বরে মিডটার্ম নির্বাচনে ট্রাম্পের দলের আসন কমে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি, রিপাবলিকান দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাতে পারে। তা ছাড়া আছে নতুন আইন প্রণয়নে সিনেটের খবরদারি। নতুন আইন করা ট্রাম্পের জন্য খুব সহজ হবে না।
স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সির বাকি তিন বছর সম্ভবত কাটবে পরিপূরক শুল্ক নিয়ে তাঁর মান–ইজ্জত রাখার লড়াইয়ে।
সালেহ উদ্দিন আহমদ লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
ই-মেইল: [email protected]
*মতামত লেখকের নিজস্ব