সংরক্ষিত নারী আসন: তাঁরা কেন বাদ পড়লেন

গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকেই সংরক্ষিত নারী আসনে কারা আসবেন, তা নিয়ে জল্পনা চলছিল। আওয়ামী লীগের অফিস ও নেতাদের বাড়িতে মনোনয়নপ্রত্যাশী অনেকে ধরনা দিয়েছেন।

প্রশ্ন উঠেছিল, এই সংসদে নৌকার বাইরে যে ৬২ জন স্বতন্ত্র সদস্য নির্বাচিত হলেন, তাঁদের প্রাপ্য ১০টি সংরক্ষিত আসনের বিষয়ে কে সিদ্ধান্ত নেবেন? স্বতন্ত্র সদস্যরা কোনো মোর্চা করে কি ১০ নারী সংসদ সদস্যকে বেছে নেবেন?

না, স্বতন্ত্র সদস্যরা সেটি করেননি। দলের মনোনয়ন না পেলেও দলীয় নেতৃত্বের প্রতি তাঁদের আনুগত্যে চিড় ধরেনি। স্বতন্ত্র সদস্যরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে তাঁর ওপরই ১০ জন সদস্য বাছাই করার দায়িত্ব দিয়েছেন। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে তাঁদের যে সাংবিধানিক এখতিয়ার, সেটি প্রধানমন্ত্রী তথা দলীয় সভানেত্রীর কাছে ন্যস্ত করেছেন।

আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় সব স্বতন্ত্র সদস্যকে আমন্ত্রণ জানানোয় দলীয় সদস্যদের সঙ্গে তাঁদের শেষ বিভাজনটুকুও মুছে গেল। নির্বাচনের সময় নৌকা ও স্বতন্ত্রের মধ্যে যত মারামারি-কাটাকাটি হোক না কেন, সংসদে তাঁরা মিলেমিশেই কাজ করবেন। এ বিষয়ে নৌকাধারী একজন সংসদ সদস্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, কোনো কোনো স্বতন্ত্র সদস্যের বক্তৃতায় মনে হয়, তাঁরা তোয়াজ-স্তুতিতে আমাদেরও ছাড়িয়ে যাবেন।

বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনসংখ্যা ৫০। সাধারণ আসন ৩০০। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে সাধারণ আসন ২৬৪। সংরক্ষিত নারী আসন ৬০। সে ক্ষেত্রে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে পাকিস্তান না বাংলাদেশ এগিয়ে, সেটা পাঠকই বিচার করবেন। মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তানেই প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন।

মহিলা পরিষদসহ অনেক নারী সংগঠন সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনসংখ্যা ১০০ এবং সরাসরি নির্বাচনের প্রস্তাব দিয়েছিল। তারা কয়েক দফা স্পিকারের সঙ্গে দেনদরবারও করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কোনো দলই সরাসরি নির্বাচনে রাজি হয়নি। অথচ ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি ভোট হয়েছিল।

১৯৫৪ থেকে ২০২৪। গত সত্তর বছরে আমরা নারীর ক্ষমতায়নে অনেক এগিয়েছি। নারী শিক্ষার হার বেড়েছে। কর্মক্ষেত্রেও তাঁদের পদচারণ বেড়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন বলতে যা বোঝায়, সেটা বাড়েনি তিন দশক দেশে নারী প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী থাকার পরও। এর পেছনে পুরুষতান্ত্রিক মনস্তত্ত্ব কাজ করেছে।

১৯৫৪ থেকে ২০২৪। গত সত্তর বছরে আমরা নারীর ক্ষমতায়নে অনেক এগিয়েছি। নারী শিক্ষার হার বেড়েছে। কর্মক্ষেত্রেও তাঁদের পদচারণ বেড়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন বলতে যা বোঝায়, সেটা বাড়েনি তিন দশক দেশে নারী প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী থাকার পরও। এর পেছনে পুরুষতান্ত্রিক মনস্তত্ত্ব কাজ করেছে।

শামসুল হুদা কমিশন ২০২০ সালের মধ্যে রাজনৈতিক দলের সব স্তরে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধি রাখার বিধি জারি করেছিল। রাজনৈতিক দলগুলোও সেই বিধি মেনে নেওয়ার শর্তে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন নিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে সেটি কার্যকর হয়নি।
বর্তমানে স্থানীয় সরকার সংস্থায় সংরক্ষিত আসনে নারীরা সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন।

গত বুধবার প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের সভায় দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়। মনোনয়ন বোর্ডের সভা শেষে গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে দলীয় প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। দ্বাদশ জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনে নতুন মুখ বেশি আসছে। আওয়ামী লীগের ৪৮ সংরক্ষিত আসনের মধ্যে বেশির ভাগই নতুন মুখ।

৭ জানুয়ারির নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে গেছেন এবং মনোনয়ন বাতিল হয়েছে, এ রকম অন্তত তিনজন সংরক্ষিত নারী আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন। প্রতিমন্ত্রী ছিলেন এমন নারীরাও সংসদে আসার সুযোগ পেয়েছেন।

আওয়ামী লীগের ৪৮টি সংরক্ষিত আসনে প্রার্থী হতে এবার ১ হাজার ৫৪৯ জন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম কিনেছিলেন। মনোনয়ন ফরমের প্রতিটির মূল্য ছিল ৫০ হাজার টাকা। এতে আওয়ামী লীগের তহবিল স্ফীত হয়েছে। জাতীয় সংসদে মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যা ছিল সাড়ে তিন হাজারের বেশি।

আওয়ামী লীগের ঘোষিত তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাধারণ আসনে প্রার্থী করার পর হেরে গেছেন—এমন দুজনকে সংরক্ষিত আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এই দুজনের মধ্যে ঢাকা-৪ আসনে সানজিদা খানম ও গাজীপুর-৫ আসনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ছিলেন মেহের আফরোজ চুমকি। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে মেহের আফরোজকে হারিয়ে জয় পান স্বতন্ত্র প্রার্থী ও আওয়ামী লীগ নেতা আকতারুজ্জামান।

আরও পড়ুন

নৌকা ও স্বতন্ত্র সদস্যের দ্বৈরথ না হলে হয়তো এই দুজন নৌকা নিয়েই জয়ী হতেন। নৌকা নিয়ে হরে সংরক্ষিত আসনে এমপি হওয়াকে অনেকে সান্ত্বনা পুরস্কার বলে অভিহিত করেছেন।

পুরোনো তালিকার চেয়ে নতুন তালিকাটি বেশ দীর্ঘ। এর অর্থ, আগের সংসদে যাঁরা সংরক্ষিত আসনে নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাঁরা ভালো পারফরম্যান্স দেখাতে পারেননি। গত সংসদে ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদকে দুটি আসন দিয়েছিল। তখন সাধারণ আসনে ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদের সদস্য সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ছয় ও চার। এবারে তাদের আসন কমে হয়েছে ১ ‍+১। বামের ভুবন ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে এবারে তাঁরা বাদ পড়েছেন এবার শুধু গণতন্ত্রী পার্টি পেল একটি আসন।

এবার আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ৩০০ সাধারণ আসনের জন্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। প্রতি আসনে নৌকা মনোনীত প্রার্থীর পাশাপাশি স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও ছিলেন (কোথাও কোথাও একাধিক)। নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখাতেই নাকি এটা করা হয়েছিল। একই পদ্ধতি আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব সংরক্ষিত নারী আসনে অনুসরণ করলে সাধারণ আসনের ৩০০ জন সংসদ সদস্য মনোনয়নপ্রত্যাশী ১ হাজার ৫৪৯ জনের মধ্য থেকে প্রার্থী বাছাই করার বিরল সৌভাগ্য অর্জন করতেন। কিন্তু এখানে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব তাঁদের সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছেন।

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি