বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে কোটা নিয়ে নতুন করে ভাবা দরকার

বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য ছয় ধরনের কোটা রয়েছে। ভর্তি বিজ্ঞপ্তির ক্রম অনুযায়ী এগুলো হলো ১. ওয়ার্ড বা পোষ্য কোটা, ২. উপজাতি বা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী কোটা, ৩. হরিজন ও দলিত সম্প্রদায় কোটা, ৪, প্রতিবন্ধী কোটা, ৫. মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বা মুক্তিযোদ্ধার নাতি–নাতনি কোটা এবং ৬. খেলোয়াড় কোটা। এসব কোটা নিয়ে পক্ষে–বিপক্ষে নানা রকমের আলোচনা রয়েছে।

ওয়ার্ড বা পোষ্য কোটায় সেসব শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পায়, যাদের মা কিংবা বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক বা কর্মচারী হিসেবে কর্মরত। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীদের সন্তান কেন বাড়তি সুবিধা পাবে, বাইরে থেকে অনেকেই এ রকম অভিযোগ করে থাকেন। 

মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনি কোটায় প্রতিবছর ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। অন্য কোটাগুলোয় শিক্ষার্থীর ঘাটতি দেখা গেলেও এই কোটায় সে ধরনের সমস্যা হয় না।

অবাক করা ব্যাপার হলো, একটি ক্রিকেট বা ফুটবল ক্লাবও এক বছরে এতসংখ্যক জাতীয় দলের বা জাতীয় মানের খেলোয়াড় নেয় না, যতসংখ্যক খেলোয়াড় গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নেওয়া হয়েছে। 

উপজাতি বা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী কোটার জন্য অবশ্য কোনো রকম প্রশ্ন ওঠে না। কারণ, এই সুবিধা পায় মাত্র ১ শতাংশ শিক্ষার্থী। আর প্রতিবন্ধী কোটার ক্ষেত্রেও কেউ আপত্তি করেন না। সাধারণত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী, বাক্প্রতিবন্ধী, শ্রবণপ্রতিবন্ধী, শারীরিক প্রতিবন্ধী, স্নায়বিক সমস্যাজনিত প্রতিবন্ধী এবং ট্রান্সজেন্ডার ও হিজড়াদের ক্ষেত্রে এ সুবিধা দেওয়া হয়। এভাবে আরও ১ শতাংশ শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়।

অনগ্রসর হরিজন ও দলিত সম্প্রদায়ের জন্যও কোটা আছে, যদিও খুব কমসংখ্যক শিক্ষার্থীই এই সুবিধা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায়। 

ছয়টি কোটার মধ্যে নতুন করে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে খেলোয়াড় কোটা। খেলোয়াড় কোটায় আবেদন করার জন্য বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি) থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউনিটভিত্তিক ন্যূনতম জিপিএ থাকতে হয়।

দেখা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় এ ধরনের শিক্ষার্থীরা প্রায় ক্ষেত্রেই পাস নম্বর তুলতে পারে না। এ ক্ষেত্রে গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি অভূতপূর্ব সিদ্ধান্ত নেয়। কোনো রকম ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াই এই কোটায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়।

বিভিন্ন ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার পর আলাদা করে তাদের ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে শর্ত ছিল, ভর্তি-ইচ্ছুক প্রার্থীদের জাতীয় দলের খেলোয়াড় হতে হবে। এ ছাড়া গত তিন বছরের মধ্যে জাতীয় দল, ‘এ’ দল এবং বয়সভিত্তিক বিভিন্ন দলের সদস্য হয়ে যাঁরা জাতীয় বা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছেন, তাঁরাও আবেদন করতে পারবেন।

অ্যাথলেটিকস, ব্যাডমিন্টন, টেবিল টেনিস, সাঁতার, টেনিস, দাবা, ক্যারমসহ বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় জাতীয় র‍্যাঙ্কিংয়ে থাকা প্রার্থীদের জন্যও এ সুযোগ রাখা হয়। এসব প্রার্থীর জন্য বয়সের শিথিলতা ছিল—বয়স সর্বোচ্চ ২৩ বছর হলেও আবেদন করা যাবে। 

এই ব্যতিক্রমী সুবিধায় গত বছর ৬০ জন প্রার্থীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ দেওয়া হয়। এ বছরও জাতীয় পর্যায়ের খেলোয়াড়দের জন্য একই সুবিধায় ভর্তির সুযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এখন প্রশ্ন, কোনো রকম ভর্তি পরীক্ষা ছাড়া কেন ভর্তির এ সুযোগ রাখা হচ্ছে? 

আরও পড়ুন

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মনে করে, খেলাধুলার মানোন্নয়ন, মানসম্মত খেলোয়াড় তৈরি এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য দক্ষ ক্রীড়াবিদ তৈরির লক্ষ্যে খেলোয়াড় কোটায় এভাবে শিক্ষার্থী ভর্তি করা প্রয়োজন।

আগে থেকেই জাতীয় দলের খেলোয়াড় যারা, তাদের আবার ‘মানসম্মত’ করে তোলার উপায় হিসেবে কী করা হবে, তার কোনো ধারণাপত্র তৈরি করা হয়নি। তা ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোনো পেশাদারি ‘ক্লাব’ বা ‘দল’ও নয়; যেখানে এভাবে ভর্তি পরীক্ষা ছাড়া শিক্ষার্থী নিতে হবে। অবাক করা ব্যাপার হলো, একটি ক্রিকেট বা ফুটবল ক্লাবও এক বছরে এতসংখ্যক জাতীয় দলের বা জাতীয় মানের খেলোয়াড় নেয় না, যতসংখ্যক খেলোয়াড় গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নেওয়া হয়েছে। 

এটা মানতে হবে, ভর্তির ক্ষেত্রে সব ধরনের প্রক্রিয়া অনলাইনভিত্তিক হওয়ায় অনিয়ম কমেছে। ভর্তির আবেদনপত্র জমা দেওয়া, মেধাক্রম অনুযায়ী পছন্দসই বিভাগে ভর্তি হওয়া কিংবা ভর্তির পর মাইগ্রেশনের সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে ডিজিটাল পদ্ধতি পুরো কাজে শৃঙ্খলা এনেছে।

তবে বিভিন্ন ধরনের কোটার সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে নতুন করে ভাবা দরকার। বিশেষ করে কোটাগুলোর স্পষ্ট ও বিস্তারিত সংজ্ঞায়ন জরুরি, যাতে কোনো রকম অনিয়মের সুযোগ না থাকে। বাংলাদেশের মতো জায়গায় একটা সার্টিফিকেট জোগাড় করা অনেক ক্ষেত্রে অসম্ভব নয়। ভর্তি পরীক্ষার ন্যূনতম পাস নম্বর ছাড়া কোনো শিক্ষার্থীকে কোটার সুবিধা দেওয়া ঠিক হবে না।

তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক