অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বন্ধে ‘প্রকল্প’ চাই

পানিশূন্য সুইমিংপুলটি ২২ বছর ধরে অব্যবহৃত। সেখানে ফুটবল খেলছে দুই কিশোর। সম্প্রতি বরিশাল জেলা সুইমিংপুলে।
ছবি: প্রথম আলো

পুকুরচুরি কথাটার ব্যুৎপত্তি যা–ই হোক, এ বিষয়ে একটা কৌতুক আছে। এক এলাকায় প্রকল্প প্রস্তুত হলো, খাল কাটা হবে। অর্থ বরাদ্দ হলো। ঠিকাদার এবং রুই–কাতলারা মিলে পুরো টাকাটা আত্মসাৎ করলেন। এরপর পরিদর্শক আসছেন খাল পরিদর্শন করতে। তখন আবারও প্রকল্প প্রস্তাবিত হলো। এই খালের জন্য এলাকাবাসী সমূহ দুর্দশায় পতিত। এটা বুজতে হবে। আবার টাকা বরাদ্দ হলো। সেটাও হজম হয়ে গেল। পরিদর্শক এলেন রাজধানী থেকে। দেখলেন, প্রকল্প সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এলাকায় কখনো খাল ছিল, কেউ বুঝতেই পারবে না। এটা পুকুরচুরি নয়, খালচুরি।

সরকারের প্রকল্পপ্রণেতা, বাস্তবায়নকারী, পরিদর্শকদের মিনতি করে বলি, আপনারা পুকুরচুরি করুন, খালচুরি করুন, কিন্তু অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প হাতে নিয়ে কোটি কোটি টাকার স্থাপনা সমাপ্ত/ না করে অব্যবহৃত ফেলে রাখবেন না। ধরা যাক, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়াম। এই স্টেডিয়ামের ছবি দেখুন। এটা কি স্টেডিয়াম নাকি জলাভূমি নাকি কচুরিপানা চাষ প্রকল্প? দেখলে আপনার কান্না আসবেই। এই স্টেডিয়াম নির্মাণের জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ হয়েছে। ফলটা দাঁড়িয়েছে, এলাকায় জলাবদ্ধতা। এলাকাবাসীর স্বাস্থ্যহানি। দুর্ভোগ। যেকোনো স্থাপনা নির্মাণের একটা কুফল আছে, পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া আছে। আপনি যদি একটা টিনের ঘরও নির্মাণ করেন, সূর্যরশ্মি প্রতিফলিত হয়ে তা পৃথিবীকে উষ্ণ করবে, বৃষ্টির পানি মাটিতে ঢুকতে বাধা দেবে! ফতুল্লা স্টেডিয়াম নির্মাণ ফলেও ধরিত্রী, পরিবেশ, প্রতিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমার প্রস্তাব হলো, এ ধরনের অপ্রয়োজনীয় ক্ষতিকর প্রকল্পের প্রস্তাব হলে টাকা বরাদ্দ করুন। তারপর টাকাটা যোগ্যতা এবং ন্যায্যতা অনুসারে ভাগ–বাঁটোয়ারা করে নিন। নেতা কতটা পাবে, প্রকল্প পরিচালক কতটা পাবে, ঠিকাদার কত পাবে, এলাকার মাস্তানরা কত পাবে, যার যা পাওনা ঠিকঠাকভাবে নিয়ে নিন। শুধু প্রকল্পটা শুরু করবেন না। তাতে পরিবেশ বাঁচবে, প্রতিবেশ বাঁচবে, পৃথিবী নামের গ্রহটার ওপর একটু কম অত্যাচার হবে।

প্রতিটা অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পের পেছনে আছে গরিব দুঃখী বাংলার মানুষের অশ্রু, ঘাম, রক্ত। পোশাকশিল্পের নারীরা গনগনে আলোর নিচে তাঁদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলো নিবেদন করছেন। আমাদের অভিবাসী শ্রমিকেরা মরুভূমির দেশে খোলা আকাশের নিচে মগজগলা তাপে কাজ করছেন আর আমাদের ডলার পাঠাচ্ছেন। সেই কষ্টার্জিত অর্থের কী বিপুল অপচয়! শুধু অর্থের অপচয় তো নয়, পরিবেশ ধ্বংস।

প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠার খবরগুলো দেখে নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছা করছিল। ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২-এর খবর: ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়: পড়ে আছে ১৬ কোটি টাকার হল।’ হল নির্মিত হয়েছে, উদ্বোধন হয়ে গেছে, আসবাব-সরঞ্জাম কেনা শেষ; ছাত্রীরা আবাসিক হল না পেয়ে কষ্টেও আছে; এক বছর হয়ে গেল, হলে ছাত্রীদের ওঠানো হয় না। কেন? কোন বিভাগের ছাত্রীরা থাকবে, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছে না। ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ প্রকাশিত হয়েছে সুইমিং পুল কাহিনি, ‘পুল আছে, সাঁতার নেই: রাজবাড়ী, ফেনী, গোপালগঞ্জ, খুলনা ও চাঁদপুরের সুইমিংপুলের মতোই করুণ অবস্থা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ নির্মিত সারা দেশের বেশির ভাগ সুইমিংপুলের। ছবির পুলগুলোর মতোই কোথাও সাঁতার কাটার পানি নেই, কোথাও জমে আছে বৃষ্টির পানি। কোথাওবা পানিতে ভাসছে শেওলা। সারা দেশের সুইমিংপুলগুলোর দুরবস্থা নিয়েই আমাদের এই বিশেষ আয়োজন।’ (https://www.prothomalo.com/sports/vx6y5zwt3t) দেশের অনেকগুলো স্টেডিয়ামে গরু চরে। ২০০৮ সালে প্রথম আলো বের করেছিল এক ঐতিহাসিক ক্রোড়পত্র, চার পৃষ্ঠার মলাট, শিরোনাম: ‘পৌনে তিন হাজার সেতু কোনো কাজে আসছে না।’ এরপর তিস্তায় আরও চর পড়েছে, অনেক দূষিত বর্জ্য মিশেছে বুড়িগঙ্গায়। অপ্রয়োজনীয় অব্যবহার্য সেতুর সংখ্যা নিশ্চয়ই বেড়েছে। সেতু আছে, সংযোগ সড়ক নেই, খালের ওপর দিয়ে না বানিয়ে সেতু বানানো হয়েছে খালের সমান্তরাল করে, কত বিচিত্র অব্যবহার্য সেতু যে আছে এই বাংলায়। সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ! এই খবরটি পড়ুন, আর সঙ্গের ছবিটা দেখুন:
‘খালের ওপর আরসিসি গার্ডার সেতুর মূল কাঠামোর নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে এক বছর আগে। কিন্তু সরকারি জমির সীমানা নির্ধারণ জটিলতার কারণে সংযোগ সড়ক নির্মাণকাজ শুরু হয়নি। এই পরিস্থিতি পটুয়াখালীর দশমিনা সদর ইউনিয়নের আরজবেগী খালের ওপর নির্মাণাধীন সেতুর।’ (প্রথম আলো, ১৯ জুলাই ২০২২) (লিংক: https://www.prothomalo.com/bangladesh/district/be9n113lck)

পটুয়াখালীর দশমিনা সদর ইউনিয়নের আরজবেগী খালের ওপর নির্মাণাধীন সেতুর
ছবি: প্রথম আলো

একই রকমভাবে অগণিত অপ্রয়োজনীয় ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। মাঝেমধ্যে ঢাকার বাইরে গেলে দেখতে পাই, বিশাল প্রশিক্ষণকেন্দ্র কিংবা সংস্কৃতিকেন্দ্র; কিন্তু ওই সব ভবনে প্রশিক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই; প্রশিক্ষক নেই, পাঠ্যসূচি নেই, পরিকল্পনা নেই, প্রশিক্ষণার্থী নেই; পড়ে আছে ভবনটি; পড়ে আছে সংস্কৃতিকেন্দ্র; কেউ কোনো দিন তা ব্যবহার করতেই কেবল এগিয়ে এল না।

এই প্রতিটা অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পের পেছনে আছে গরিব দুঃখী বাংলার মানুষের অশ্রু, ঘাম, রক্ত। পোশাকশিল্পের নারীরা গনগনে আলোর নিচে তাঁদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলো নিবেদন করছেন। আমাদের অভিবাসী শ্রমিকেরা মরুভূমির দেশে খোলা আকাশের নিচে মগজগলা তাপে কাজ করছেন আর আমাদের ডলার পাঠাচ্ছেন। সেই কষ্টার্জিত অর্থের কী বিপুল অপচয়! শুধু অর্থের অপচয় তো নয়, পরিবেশ ধ্বংস। এলাকার রাস্তাঘাট নষ্ট করা, যানজট পাকানো।

বেগম রোকেয়া তাঁর স্কুলের ছাত্রীদের বলেছিলেন, ‘এই স্কুলভবনের জন্য বহু শামুক নিজেকে পুড়িয়ে চুন হয়েছে, বহু গাছ করাতের নিচে কাটা পড়ে তক্তা হয়েছে, বহু মাটি নিজেকে পুড়িয়ে ইট হয়েছে।’ আমাদের হাজার হাজার অসমাপ্ত অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পের পেছনে আছে বহু মাটির নিজেকে পোড়ানোর কষ্ট, বহু গাছের নিজেকে কেটে ফেলার আর্তনাদ! বহু ডিজেল–পেট্রল পুড়িয়ে দেশের ডলার উড়িয়ে কার্বন দূষণ ঘটিয়ে এই সব নির্মাণ সামগ্রী সাইটে পৌঁছেছে! কাজেই আমার মিনতি, করজোড় আকুল মিনতি, প্রকল্পের বরাদ্দের টাকাটা শুরুতেই মেরে দিন। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প হাতে নিয়ে দেশের–দশের পৃথিবীর ক্ষতি করা থেকে নিরত থাকুন।

আরও পড়ুন

এই দেশের প্রধান সমস্যা লুণ্ঠন। যে যেভাবে পারছে, লুটে নিচ্ছে। দুই হাজার টাকার পর্দা চার লাখ টাকা, দুই শ টাকার বালিশ চার হাজার টাকা—এসব নির্লজ্জ চুরি তো আছেই। আরেকটা সমস্যা, প্রকল্প জনগণের ইচ্ছায় বিশেষজ্ঞদের মত নিয়ে অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত যাচাইয়ের মাধ্যমে হাতে নেওয়া হয় না; আগে হয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, তারপর কর্তার ইচ্ছানুসারে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়! তারই পরিণতি এই সব অব্যবহার্য স্থাপনা। পৌনে তিন হাজার আজারে সেতু। ফ্লাইওভার নির্মাণের পর দেখা গেল, যানবাহন সেটায় উঠতে চায় না। বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র বানানোর পর দেখা গেল, বিদ্যুৎ আসা-যাওয়ার সংযোগ লাইনই নেই। এসব দেখে কাজী নজরুল ইসলামের মতো বলে উঠতে ইচ্ছা করে, ‘বন্ধু গো, আর বলিতে পারি না, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে! দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে।’
এবার আরেকটা প্রকল্প নিন। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বন্ধকরণ প্রকল্প। দেশটাকে বাঁচান। আমাদের বলা হচ্ছে, কৃচ্ছ্র সাধন করতে। সংযম করতে। তা তো আমরা করছিই। চালের দাম, ডিমের দাম বেড়ে গেছে। তার আগে বাসভাড়া, বাড়িভাড়া বাড়ায় চাল খাওয়া, ডিম খাওয়া কমিয়ে দিয়েছি। চিকন আলীরা আরও চিকন হচ্ছে। মোটা আলীরা কি তাদের হা কমাবে? নাকি এটা চিরকাল চলতেই থাকবে: ‘এ জগতে হায় সেই বেশি চায়, আছে যার ভূরি ভূরি/ রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।’

  • আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক