জীবপ্রযুক্তিবিদদের অন্তর্ভুক্তিকরণ: স্বাস্থ্যক্ষেত্রে আর কত উপেক্ষা আর বৈষম্য?

একটি দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা অনেক মানুষের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে; কিন্তু এখানেই যখন বৈষম্য চলে, তখনই শুরু হয় স্বাস্থ্যক্ষেত্রে নৈরাজ্য। আর এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ বাংলাদেশ। দেশে অন্তত তিন শতাধিক আরটিপিসিআর বিশেষজ্ঞ বসে আছেন, অথচ কোভিডের সময় প্রথম এক মাস আরটিপিসিআর করা নিয়ে চলেছে নাটক। একবার বলা হলো, দেশে এই কাজের লোক নেই, পরে বলা হলো সক্ষমতা নেই, আবার বলা হলো, এই কাজের কাঁচামাল তথা কিট নেই। কিন্তু সবগুলোই ছিল ভুল তথ্য।

দেশে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, বায়োটেকনোলজি, মলিকুলার বায়োলজি, মাইক্রোবায়োলজি বিষয়ে বিদেশ থেকে এই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পিএইচডি, পোস্ট–ডক্টরেট করে আসা অসংখ্য গবেষক থাকা সত্ত্বেও তাঁদের ডাকা হলো না শুরুতে, তাঁদের পরামর্শও নেওয়া হলো না। স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সব পরামর্শক কমিটিতেই অন্তর্ভুক্ত করা হয় কেবলমাত্র চিকিৎসকদের। আর কেন জানি স্বাস্থ্যক্ষেত্রের সব উচ্চপদস্থ কমিটিগুলো, চাকরিক্ষেত্র, এমনকি গবেষণাক্ষেত্রেও অচ্ছুত হিসেবে বিবেচনা করা হয় চিকিৎসক ছাড়া অন্য পেশার লোকদের (বিশেষজ্ঞদের)।

এখন প্রশ্ন হলো, আধুনিক সমাজে স্বাস্থ্যব্যবস্থা কি কেবল একতরফাভাবে চিকিৎসকদের ওপর নির্ভরশীল? উত্তর হলো, চিকিৎসকেরা এর প্রাণকেন্দ্র, তাঁরা চিকিৎসা দেবেন, রোগীর জন্য নীতি নির্ধারণ করবেন, মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিশ্চিত করবেন। কিন্তু রোগনির্ণয়, বিস্তার রোধ, জীবাণুর বিবর্তন নির্ণয় এবং এ–সংক্রান্ত গবেষণা কে করবে? এর উত্তর হলো, অবশ্যই চিকিৎসক নয় বরং এখানে আরও অনেক পেশার মানুষের অবদানের সুযোগ আছে এবং তাঁদের মতামত ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।

স্বাস্থ্যক্ষেত্রে জীবপ্রযুক্তিবিদ, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার বা মলিকুলার বায়োলজিস্টদের উপেক্ষা করার ফলে কী কী সর্বনাশ হতে পারে তার খুব বড় একটা চিত্র পাওয়া যাবে কোভিডের সময়কার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে। আমরা মার্চ মাসেই প্রথম আলোয় অন্তত দুটি লেখায় আহ্বান করেছিলাম, দেশে ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় একদম প্রস্তুত কাজ করার জন্য, তাদের গবেষণাগারকে ব্যবহার করা হোক। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত নিতে লেগেছিল দুই থেকে তিন মাস, তা–ও শুরু করা হলো মাত্র তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়ে।

এদিকে প্রতিদিন একেকটি ল্যাবে জমে যাচ্ছে সাত থেকে আট শ নমুনা, রিপোর্ট দিতে লেগে যাচ্ছে এক সপ্তাহের অধিক সময়, রোগী ততক্ষণে সুস্থ হয়ে গেছে কিংবা আইসিইউতে ভর্তি হতে না পেরে আরও গুরুতর অবস্থায়! এই অবস্থার কারণ একটাই, নীতিনির্ধারকেরা খুব সহজে স্বাস্থ্যক্ষেত্রের এই জায়গাগুলোতে চিকিৎসক ছাড়া অন্যদের স্থান দিতে চান না, ভরসা করতে চান না এবং অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের আধিপত্য কমে যাবে, এমনটাই ভাবেন।

মেডিকেলের পাঠ্যসূচিতে কখনোই পিসিআর, আরটিপিসিআর, জিনোটাইপিং বা জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের প্রারম্ভিক ব্যবহার ব্যতীত বিস্তারিত নেই। এসব বিষয়ে যাঁরা পাঁচ বছর অনার্স আর মাস্টার্সে পড়ে আসছেন, কেন তাঁদের মূল্যায়ন করা হয় না? কেন তাঁদের দক্ষতা কাজে লাগানো হচ্ছে না? কেন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, মলিকুলার বায়োলজি, মাইক্রোবায়োলজি, বায়োটেকনোলজির বিশেষজ্ঞদের ব্যবহার করা হচ্ছে না? কী উদ্দেশ্যে তাঁদের পরামর্শ উপেক্ষা করা হচ্ছে?

সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের কখনোই নীতিনির্ধারণী কমিটি, পরামর্শক প্যানেল এমনকি ল্যাবরেটরিগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এভাবে অদৃশ্য একটা দেয়াল তুলে রেখে পিছিয়ে যাচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা, অনেক সমস্যার সমাধান হচ্ছে না, অনেক সমস্যাকে অনুধাবন করা হচ্ছে না এবং অনেক জায়গায় নতুনত্ব আনা যাচ্ছে না।

কোভিড এবং বিভিন্ন পরিস্থিতিতে দেশে বিশেষজ্ঞরা নিজেরাই বিভিন্ন পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে চেয়েছেন বা বিকল্প পদ্ধতি ব্যবহার করতে চেয়েছেন দ্রুততম সময়ে রোগ নির্ণয়ের জন্য। ল্যাম্প নামক একটি পদ্ধতিতে খুব দ্রুত পিসিআর করা হয় পুরো বিশ্বেই। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বেশ কয়েক জায়গার জীবপ্রযুক্তিবিদেরা কোভিড টেস্টের সময় আট-দশ ঘণ্টা থেকে কমিয়ে এক ঘণ্টায় নামিয়ে আনার জন্য এই পদ্ধতিতে কাজ করার আবেদন করা সত্ত্বেও তা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। বরং তাঁদের করা হয়েছে অপমান, উপেক্ষা এবং কটাক্ষ।

এখন প্রশ্ন হলো, কার স্বার্থে দেশে রোগনির্ণয়ের ক্ষেত্রটিতে পুরোপুরি বিদেশি কোম্পানির কথায় আমরা চলছি? কে লাভবান হচ্ছে? জীবপ্রযুক্তিবিদ, অণুজীববিজ্ঞানী, মলিকুলার বায়োলজিস্ট—এসব বিশেষজ্ঞকে উপেক্ষা করে নমুনা পরীক্ষাকে দীর্ঘায়িত করে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে কি দুর্নীতি আর নৈরাজ্যকে উৎসাহিত করা হচ্ছে না? চায়নিজ এক কিট জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হলো দেশের সবগুলো কোভিড ল্যাবে, যা যথেষ্ট সমালোচিত এবং অনেক ‘ফলস নেগেটিভ’ বা ভুল রোগ নির্ণয় করে। একাধিক ল্যাবের জীবপ্রযুক্তিবিদেরা এটি বলা সত্ত্বেও কার স্বার্থে এই কিট জোর করে ব্যবহার করে সরকারি অর্থের অপচয় করা হলো?

দেশে প্রতিবছর ডেঙ্গু হচ্ছে। ডেঙ্গু নির্ণয়ের ক্ষেত্রেও একই সমস্যা দেখা যায়। তারপরেও কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। কেন ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রকৃতি, জিনোম বিন্যাস, ডিএনএ বারকোডিং এসব নিয়ে পরামর্শগুলো শোনা হচ্ছে না? কেন জিনোমিক্স বিশেষজ্ঞ, ভাইরোলজিস্ট, বায়োইনফরমেটিকস বিশেষজ্ঞদের কাজে লাগানো হয় না? জিন বিন্যাস পর্যালোচনা করে বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধি বা নতুন ভাইরাসের আগমনের শুরুতেই তার উৎপত্তিস্থল নির্ণয় করা যায়। এভাবেই কিন্তু নিউজিল্যান্ড মহামারি নিয়ন্ত্রণ করেছিল। এমনকি এয়ারপোর্টে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছিল উৎপত্তিস্থল দেশের ওপর। কিন্তু আমাদের দেশে তা মনিটরিং বা পর্যবেক্ষণকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না।

এ দেশেই এই মুহূর্তে হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড, কেমব্রিজসহ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও জাপান থেকে প্রশিক্ষিত অসংখ্য জীবপ্রযুক্তিবিদ তথা বায়টেকনোলজিস্ট আছেন, কিন্তু তাঁদের কোনোভাবেই স্বাস্থ্যক্ষেত্রে কাজে লাগাচ্ছে হচ্ছে না। দেশে জীবপ্রযুক্তিতে বিশেষায়িত একটি প্রতিষ্ঠান আছে ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি (এনআইবি)’। অথচ কোনো মহামারি বা সংক্রমণের সময় তাদেরকে প্রথম ধাপে কাজে লাগানো হয় না, মূল্যায়ন করা হয় না, কোনো পরামর্শক প্যানেলে তাদের বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। দেশ যদি নিজের জন্য কাজে না লাগায় তাহলে এ রকম গবেষণাপ্রতিষ্ঠান তৈরির অর্থ কী?

দেশে বসেই ক্যানসারের জিনগত পরিবর্তন পর্যবেক্ষণভিত্তিক রোগ শনাক্তকরণ এবং চিকিৎসাপদ্ধতি নির্ণয়, বিভিন্ন জেনেটিক রোগ শনাক্তকরণ, গর্ভধারণ করার আগে জিনগত ত্রুটি থাকা দম্পতিদের জেনেটিক কাউন্সেলিং, বন্ধ্যত্ব নিয়ে জেনেটিক পদ্ধতিতে চিকিৎসা শনাক্তকরণ। এসব স্বাস্থ্য সমস্যা নির্ণয়ের বাজার দুই শ কোটি টাকার অধিক। নীতিনির্ধারক পর্যায়ে অজ্ঞানতা ও উদাসীনতার কারণে সক্ষমতা ও দক্ষতা থাকার পরও নিজেদের নমুনা নিজেরা সরকারি ও কম খরচে কিংবা বেসরকারি উদ্যোগে করার ব্যবস্থা নিচ্ছে না, অনুমতি দিচ্ছে না। ফলে ভারতীয় একটি কোম্পানি একাই করছে শতকোটি টাকার বাণিজ্য, যা বাড়াচ্ছে রোগীদের ভোগান্তি এবং ব্যয়।

স্বাস্থ্য গবেষণায় চলে আরও বৈষম্য। যুক্তরাষ্ট্রের মূল স্বাস্থ্য সংস্থা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ এবং ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউটে ৬০ শতাংশ গবেষকই কিন্তু চিকিৎসক নন, তাঁরা জীবপ্রযুক্তিবিদ, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার, অণুজীববিজ্ঞানী, মলিকুলার বায়োলজিস্ট কিংবা ফার্মাসিস্ট। শতাধিক বাংলাদেশি বিজ্ঞানী এখানে কাজ করেন।

একই অবস্থা জার্মানির ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইনস্টিটিউট, যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের রোগনির্ণয় ও গবেষণা কেন্দ্রগুলোতে। আর আমাদের দেশে? ২০১৯ এবং ২০২১ সালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বিশেষ গবেষণা অনুদান প্রদানের বাছাইয়ের সময় স্বাস্থ্য গবেষণার অনুদান থেকে অধিকাংশ গবেষককে বাদ দেওয়া হয়েছিল, তাঁরা চিকিৎসক নন এই অপরাধে। জিনোম ওয়াইড অ্যাসোসিয়েশন স্টাডি, ভ্যাকসিন বা টিকার নকশা প্রস্তুতকরণ, ওষুধের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য কোষীয় প্রতিক্রিয়া তথা সেল সিগন্যালিং দেখা—এসব কাজ আসলে চিকিৎসকের পক্ষে বিভিন্ন কারণে সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাহলে কেন স্থানীয় জীবপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের উপেক্ষা করা হচ্ছে?

এই দেশটা আমার, আপনার, আমাদের সবার। অনেক স্বপ্ন নিয়ে অনেকে দেশে ফিরে এসেছে নিজেকে দেশের জন্য উজাড় করে দেওয়ার জন্য। অনেক তরুণ ছেলেমেয়ে দেশের প্রয়োজনে নিজের সব জ্ঞান আর দক্ষতা কাজে লাগানোর জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। ‘ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ, স্মৃতি দিয়ে ঘেরা’—স্বপ্নের এই দেশটাতে বৈষম্য না করে সবাইকে তার কাজটা করার সুযোগ দিন। দেখবেন নজরুলের ‘বন্ধনহীন জন্ম স্বাধীন, চিত্তমুক্ত শতদল’ এই প্রজন্ম স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বাংলাদেশে বয়ে আনবে নতুন দিন।

লেখকবৃন্দ চট্টগ্রাম, ঢাকা, জগন্নাথ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষক