মিশেল ওবামা নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিষেক অনুষ্ঠান কেন বর্জন করছেন, তা নিয়ে খুব বেশি ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে না। স্পষ্টতই এই সাবেক ফার্স্ট লেডি ট্রাম্পকে পছন্দ করেন না। কারণ, ট্রাম্প একজন বর্ণবাদী ও নারীবিদ্বেষী। ইউরোপের অনেক মার্কিন মিত্রদেশও যদি পারত, তাহলে ট্রাম্পকে বর্জন করত। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আগামী চার বছর তাদের ট্রাম্পকে নিয়েই চলতে হবে।
তবে কথা হলো, সবাই কিন্তু ট্রাম্পকে একইভাবে দেখে না। ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস-এর জরিপে দেখা গেছে, চীন, ভারত, রাশিয়া, সৌদি আরব, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলে ট্রাম্পের ফিরে আসাকে স্বাগত জানানো মানুষের সংখ্যা তাঁকে প্রত্যাখ্যানকারীদের চেয়ে বেশি। তার বিপরীতে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি এবং অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে ট্রাম্পের ফিরে আসাটা রীতিমতো আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে বাস্তব অবস্থার কারণেই মিশেল ওবামার মতো ট্রাম্পকে প্রত্যাখ্যান করা বেশির ভাগের জন্য বিলাসিতা ছাড়া কিছু নয়। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা ও প্রভাব কমে গেলেও একজন মার্কিন প্রেসিডেন্টকে একেবারে অগ্রাহ্য করা বাস্তবসম্মত নয়; সম্ভবও নয়। আর অনেক বড় দেশই মনে করে, ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ তাদের জন্য লাভজনক হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ইউরোপের দেশগুলো ভিন্ন অবস্থানে রয়েছে। তারা ট্রাম্পকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তবে তারা যদি ট্রাম্পের কাছ থেকে একেবারে দূরে সরে দাঁড়ায়, তাহলে বিশ্বরাজনীতিতে তাদের গুরুত্ব হারানোর ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
উদীয়মান শক্তিধর দেশগুলো মনে করছে, ট্রাম্পের আদর্শহীন, জাতীয়তাবাদী, লেনদেনকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর দৃষ্টিভঙ্গি বর্তমান সময়ের জন্য বেশি উপযোগী। আসলে এটি তাদের নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিফলন। তাদের কাছে ট্রাম্প এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের প্রতীক।
কিন্তু ট্রাম্প ইস্যুতে এটি কি তাদের ভুল সিদ্ধান্ত হবে, যা কিনা পরে তাদের জন্য আফসোসের কারণ হয়ে দাঁড়াবে? জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চার্লস কাপচান মনে করেন, ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতি কোনো নির্দিষ্ট নীতি বা আদর্শের ধার ধারে না। ফলে তাঁর পররাষ্ট্রনীতি ভালো বা খারাপ, যেকোনো দিকেই যেতে পারে। এ অবস্থায় ট্রাম্পকে সঠিক পথে চালিত করা, তাঁর সঙ্গে কৌশলে কাজ করা এবং তাঁর খারাপ সিদ্ধান্তগুলোর প্রভাব কমানোটাই বিদেশি নেতাদের জন্য আসল কাজ হবে।
আসলে এ মুহূর্তে ইউরোপের নেতারা ও ট্রাম্পবিরোধীরা শুধু দর্শকের ভূমিকায় আছেন। যদি সবকিছু খারাপের দিকে যায়, তাহলে ‘খারাপ ট্রাম্প’ বিজয়ী হবেন। আর তা হলে তিনি হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতে থাকবেন, পুরোনো মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবেন, দেশে-বিদেশে গণতন্ত্রকে অবহেলা করবেন এবং স্বৈরশাসকদের প্রশ্রয় দেবেন। যদি তাই হয়, তাহলে কে তাঁকে সামলাবে? এ প্রশ্নের উত্তর খুব দ্রুত প্রয়োজন।
ট্রাম্পের কাজকারবার ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের কথা মনে করিয়ে দেয়। থ্যাচার পুরোনো ব্যবস্থা ভেঙে ফেলেছিলেন; কিন্তু নতুন করে কিছু তৈরি করতে পারেননি। সেই দিকটার ওপর জোর দিয়ে কাপচান সতর্ক করে বলেছেন, ‘ট্রাম্প একজন ধ্বংসাত্মক নেতা, তিনি ভাঙতে জানেন, কিন্তু গড়তে জানেন না। সম্ভবত তিনি নতুন ও উন্নত আন্তর্জাতিক শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলতে সহায়তা করবেন না, উল্টো পুরোনো ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়ে আমেরিকা ও বিশ্বকে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে ফেলে রেখে যাবেন।’
এ কারণেই ‘কে ট্রাম্পের লাগাম টানতে পারবে’—ব্রাসেলসে এখন এ আলোচনা চলছে। এ ক্ষেত্রে ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি, হাঙ্গেরির ভিক্তর ওরবান ও ন্যাটোপ্রধান মার্ক রুটের নাম শোনা গেলেও তাঁদের কারও একার পক্ষে ট্রাম্পের মতো পাগলা ঘোড়াকে সামলানোর ক্ষমতা নেই। তাই ‘ট্রাম্পকে সামলানোর নেতা’ এখন বিশ্বের জন্য খুব জরুরি হয়ে পড়েছে।
আসলে এখন এই ‘ভালো ট্রাম্প, খারাপ ট্রাম্প’ ধারণার একটি বড় পরীক্ষা হিসেবে ইউক্রেন যুদ্ধ আমাদের সামনে রয়েছে। ট্রাম্প ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তার খরচ দেওয়া নিয়ে আপত্তি তুলেছেন। তিনি বলেছেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনকে কেন ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে বাধা দেন, তা তিনি বোঝেন। ট্রাম্প দাবি করে আসছেন, তিনি ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধ থামিয়ে দিতে পারেন; তবে এর জন্য ইউক্রেনকে হয়তো কিছু অঞ্চল রাশিয়ার হাতে ছেড়ে দিতে হবে এবং রাশিয়াকেও তার আগ্রাসনের পুরস্কার হিসেবে সেটি মেনে নিতে হবে।
তবে ট্রাম্প সম্ভবত জানেন, বাইডেন যে ভুল করে আফগানিস্তানে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করেছেন, সেটি করা যাবে না। তিনি রাশিয়া, চীন, ইরান ও উত্তর কোরিয়াকে (অনেকে যাকে ‘শয়তানের নতুন জোট’ বলছে) বড় জয় পেতে দিতে চান না। তাই অনেকে বলছেন, ট্রাম্প হয়তো উল্টো ইউক্রেনকে সহায়তা দেওয়া বন্ধ করার বদলে তা আরও বাড়িয়ে দিতে পারেন, যাতে কিয়েভ ভবিষ্যৎ আলোচনায় শক্ত অবস্থানে থাকতে পারে।
আসলে এ মুহূর্তে ইউরোপের নেতারা ও ট্রাম্পবিরোধীরা শুধু দর্শকের ভূমিকায় আছেন। যদি সবকিছু খারাপের দিকে যায়, তাহলে ‘খারাপ ট্রাম্প’ বিজয়ী হবেন। আর তা হলে তিনি হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতে থাকবেন, পুরোনো মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবেন, দেশে-বিদেশে গণতন্ত্রকে অবহেলা করবেন এবং স্বৈরশাসকদের প্রশ্রয় দেবেন। যদি তাই হয়, তাহলে কে তাঁকে সামলাবে? এ প্রশ্নের উত্তর খুব দ্রুত প্রয়োজন।
● সাইমন টিসডাল দ্য অবজারভার-এর পররাষ্ট্রবিষয়ক বিশ্লেষক
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত