তরুণ্যনির্ভর দেশগুলো জনমিতির সুযোগ কতটা কাজে লাগাতে পারবে?

জনসংখ্যায় চীনকে ছাড়িয়ে গেছে ভারত
ছবি: রয়টার্স

বিশ্বের জনমিতিতে পরিবর্তন ঘটে গেছে। ইউরোপে কমছে মানুষ। চীনেও। তাকে টেক্কা দিয়ে ভারত এবার সবচেয়ে জনবহুল দেশ হয়েছে।

কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা যা দেখছি, তা জনমিতির পরিবর্তনের শুরু কেবল।

২০৫০ সালের মধ্যে পূর্ব এশিয়া ও ইউরোপের ৪০ ভাগের বেশি জনগোষ্ঠীর বয়স হবে ৬০–এর ওপরে। এই প্রক্ষেপণ জোরালো ও বিশ্বাসযোগ্য। এ সংখ্যা ফ্লোরিডার বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সংখ্যার দ্বিগুণ। বলে রাখা ভালো, ফ্লোরিডাকে বলা হয় যুক্তরাষ্ট্রের অবসরপ্রাপ্তদের রাজধানী। বিপুলসংখ্যক অবসরপ্রাপ্ত মানুষ ক্রমে কমতে থাকা কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠবে।

কোনো দেশের এভাবে বুড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা এর আগে আর ঘটেনি।

ফলে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করেন, ধনী দেশগুলো যে বিষয়গুলোর নিশ্চয়তা এত দিন পেয়ে এসেছে, যেমন অবসর ভাতা, অবসরের বয়স ও কঠোর অভিবাসন নীতি—টিকে থাকতে হলে এখন এগুলোর পরিবর্তন ঘটাতে হবে। আজকের দিনের ধনী দেশগুলো নিঃসন্দেহে বৈশ্বিক জিডিপিতে অবদান রাখছে সামান্যই। ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও অন্যান্য শীর্ষ অর্থনীতির দেশের জন্য এ এক বিশাল পরিবর্তন। কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীই এই দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটিয়েছিল।

এই দেশগুলো ইতিমধ্যেই বুড়িয়ে যেতে বসেছে। জাতিসংঘের প্রক্ষেপণ বলছে, একটি ভারসাম্যপূর্ণ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী দ্রুতই দেখা যাবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই পরিবর্তন অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও ভূরাজনৈতিক শক্তির ভারসাম্যে নতুন রূপ দিতে পারে।

নানা বিবেচনায় বলা যায়, এই বুড়িয়ে যাওয়া পৃথিবী উন্নয়নের বিজয়ের ফল। মানুষ এখন দীর্ঘ জীবন পাচ্ছে, পাচ্ছে সুস্বাস্থ্যও। ধনী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের সন্তানসংখ্যাও কমে আসছে।

অনেক দরিদ্র দেশের জন্য এই পরিস্থিতি বিরাট সুযোগ তৈরি করেছে। যখন জন্মহার কমে, তখন দেশগুলো জনমিতির লভ্যাংশ ভোগ করে। কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বাড়ে এবং তাঁদের ওপর নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যাও কমে। ছোট পরিবারে প্রাপ্তবয়স্ক সদস্যরা তাঁদের সন্তানদের শিক্ষায় বিনিয়োগ করতে পারেন। নারীরাও কাজে যোগ দেন। ফলে অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটে।

জনসংখ্যা কোনো নিয়তি নয় এবং এর লভ্যাংশও স্বয়ংক্রিয়ভাবে আসবে না। কর্মহীন তরুণেরা প্রবৃদ্ধির বদলে অস্থিতিশীলতা তৈরি করবে। যখন এই তরুণেরা বৃদ্ধ হবে, তখনো ধনী দেশগুলোর মানুষ ভালো অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সুফল পাবেন এবং আরও লম্বা সময় ভালোভাবে জীবন যাপন করবেন।

তবে বয়স নিয়ে অর্থনীতির যে যুক্তি, তা পুরোপুরি অস্বীকার করার সুযোগ নেই।

ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর ডেমোগ্রাফিক রিসার্চের পরিচালক মিক্কো মিরসকিল বলেন, ‘এই পরিবর্তনগুলোয় কারও বিস্মিত হওয়া উচিত নয়। কিন্তু সবাই বিস্মিত হয়।’

মিরসকিল বলেন, বৈশ্বিক পর্যায়ে মূল চ্যালেঞ্জ হলো বণ্টনের। কোনো কোনো জায়গায় বয়স্ক মানুষের আধিক্য থাকবে। আবার কোনো কোনো জায়গায় তরুণদের আধিক্য থাকবে। তাই যৌক্তিক হবে আরও ব্যাপকভাবে সীমান্তকে খুলে দেওয়া। আর দক্ষিণপন্থী জনতুষ্টিবাদী কার্যক্রম যেখানে আছে, সেখানে এই উদ্যোগ নেওয়া অবিশ্বাস্য রকমের কঠিন হবে।

অন্য নবীন দেশগুলোর মতো কেনিয়াতে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় জন্মহার কমেছে। ৫০ বছর আগে গড়ে একজন নারীর আটটি সন্তান জন্ম নিত। গত বছরে এই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় গড়ে তিনজনে। জনমিতি বিবেচনায় কেনিয়ার এখনকার অবস্থাকে মধ্য সত্তরে কোরিয়ার অবস্থার সঙ্গে তুলনা করা যায়। যেহেতু কেনিয়ার অর্থনীতি একটি ঐতিহাসিক উল্লম্ফন প্রত্যক্ষ করছে এখন। দেশটির জনসংখ্যার হার অবশ্য কমছে কিছুটা ধীরেই। দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকার বেশির ভাগ দেশের জনমিতির চেহারা এখন কেনিয়ার মতোই। এই পরিস্থিতি অত্যন্ত ইতিবাচক।

গত শতকের শেষভাগে আমরা এমনই উল্লম্ফন দেখেছি দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও সিঙ্গাপুরের ক্ষেত্রে। ব্যাপক প্রবৃদ্ধি ছিল দেশগুলোয়। তারা জনমিতির পরিবর্তনের এই লভ্যাংশ অনেকটাই ভোগ করে ফেলেছে। কারণ, ২০৫০ সাল পর্যন্ত যারা বেঁচে থাকবে, তাদের জন্ম হয়ে গেছে।

তবে প্রক্ষেপণ সব সময় ঠিক না–ও হতে পারে। যেমন সাব-সাহারা অঞ্চলে জন্মহার কমছে জাতিসংঘের যে প্রক্ষেপণ, তার চেয়েও দ্রুত হারে। এর অর্থ ২০৫০ সালে আফ্রিকার এই দেশগুলোর অবস্থান প্রত্যাশার চেয়েও ভালো হবে।

কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর এই বাড়বাড়ন্ত অর্থনৈতিক উন্নয়নের বদলে উল্টো ফল বয়ে আনতে পারে। এ জন্য দরকার সঠিক নীতি। যদি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক তরুণের শিক্ষার সুযোগ না থাকে, তবে বেকারত্ব দেশের স্থিতিশীলতা নষ্টের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। কারণ, হতাশ তরুণেরা ভালো সুযোগের আশায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বা সশস্ত্র গোষ্ঠীতে যোগ দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটাতে পারে।

ডেমোক্রেটিক ডিভিডেন্ড ইনিশিয়েটিভে কাজ করেন ক্যারোলাইনা কার্ডোনা। জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটির স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ ক্যারোলাইনা বলেন, ‘যারা শ্রমবাজারে ঢুকতে যাচ্ছে, তাদের জন্য যদি কাজের সুযোগ সৃষ্টি করা না যায়, তাহলে জনমিতির লভ্যাংশ পাওয়া যাবে না।’

এজিং এশিয়া রিসার্চ হাবের পরিচালক ফিলিপ ও কিফি বলেন, গত কয়েক দশকে পূর্ব এশিয়ার যে দেশগুলোয় তরুণ জনগোষ্ঠীর আধিক্য ছিল, তাদের ভালো প্রতিষ্ঠান ও নীতিমালা ছিল। বিশ্বের অন্যান্য অংশে, যেমন লাতিন আমেরিকার কিছু দেশের জনসংখ্যার প্রকৃতি পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর মতো। ও কিফি বলছেন, কিন্তু ওই দেশগুলো প্রবৃদ্ধিতে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর ধারেকাছেও নেই। জনসংখ্যা হলো কাঁচামালের মতো। কাঁচামাল যখন ভালো নীতির সঙ্গে মিলবে, তখনই লভ্যাংশ নিশ্চিত হবে।

শুধু যে তারুণ্যনির্ভর দেশগুলোই এখন এক জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি, তা নয়। ধনী দেশগুলোয় পরিবর্তন সবে শুরু হয়েছে। যদি এই দেশগুলো কমতে থাকা শ্রমশক্তির দিকে নজর না দেয়, ধীরে ধীরে তাদের ভালো থাকা বা অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে টিকে থাকার সক্ষমতা কমতে থাকবে।

জাতিসংঘের জনসংখ্যাবিষয়ক প্রক্ষেপণ বলছে, বয়োবৃদ্ধ দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে থাকা দুই দেশ দক্ষিণ কোরিয়া ও ইতালিতে ২০৫০ সাল নাগাদ যথাক্রমে ১৩ মিলিয়ন ও ১০ মিলিয়ন পর্যন্ত কর্মক্ষম জনশক্তি কমবে। চীনে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা কমবে ২০০ মিলিয়ন পর্যন্ত। অনেক দেশের জনসংখ্যাই এত নয়। এই পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে বুড়িয়ে যেতে বসা ধনী দেশগুলোকে অবসর ভাতা, অভিবাসন নীতি এবং বার্ধক্যে জীবন কেমন হতে পারে, সে নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।

পরিবর্তন সহজে আসবে না। ফ্রান্সে অবসরের বয়স ৬২ থেকে মাত্র দুই বছর বাড়িয়ে ৬৪ বছর করায় ১০ লাখের বেশি মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেন। মানিয়ে নেওয়া যে কঠিন, সে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে ওঠে এতে। পশ্চিম এবং পূর্ব এশিয়ার বুড়িয়ে যেতে বসা দেশগুলোয় অভিবাসন নিয়ে ভীতি দক্ষিণপন্থী প্রার্থীদের প্রতি মানুষের সমর্থন বাড়িয়ে দিচ্ছে।

মিরসকিল বলেন, বৈশ্বিক পর্যায়ে মূল চ্যালেঞ্জ হলো বণ্টনের। কোনো কোনো জায়গায় বয়স্ক মানুষের আধিক্য থাকবে। আবার কোনো কোনো জায়গায় তরুণদের আধিক্য থাকবে। তাই যৌক্তিক হবে আরও ব্যাপকভাবে সীমান্তকে খুলে দেওয়া। আর দক্ষিণপন্থী জনতুষ্টিবাদী কার্যক্রম যেখানে আছে, সেখানে এই উদ্যোগ নেওয়া অবিশ্বাস্য রকমের কঠিন হবে।

এশিয়ার বেশ কিছু দেশে শুধু যে জনগোষ্ঠীর গড় বয়স বাড়ছে, তা-ই নয়, তাদের কোনো কোনোটি পুরোপুরি ধনী হওয়ার আগেই বুড়িয়ে যেতে পারে। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুরে তুলনামূলকভাবে আয় বেশি। কিন্তু চীনের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মাত্র ২০ শতাংশের আয় ছিল মার্কিনদের আয়ের সমান। ভিয়েতনামে এই হার ছিল ১৪ শতাংশ।

নিম্ন আয়ের দেশগুলো অবসরকালীন ব্যবস্থাপনায়ও খুব দক্ষ নয়। ফলে ধনী দেশগুলো যেভাবে বার্ধক্যে পৌঁছানো জনগোষ্ঠীকে সামাল দিতে পেরেছে, নিম্ন আয়ের দেশগুলোর পক্ষে তা সম্ভব না–ও হতে পারে।

ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিকভাবে অনূদিত, দ্য নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া 

লরেন লেদারবি দ্য নিউইয়র্ক টাইমস–এর অন্যতম সম্পাদক