যে কারণে পুতিনের নজর এখন আফ্রিকার দিকে?

২০১৯ সালে এক সম্মেলনে আফ্রিকা মহাদেশের নেতাদের সঙ্গে পুতিনছবি : রয়টার্স

আফ্রিকার দেশগুলোতে রাশিয়ার বিনিয়োগ মোট বৈদেশিক বিনিয়োগের এক শতাংশের কম। বাস্তবে তাই মহাদেশটির জন্য রাশিয়ার অবদান একবারে নগণ্য। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ আফ্রিকা সফরে গেছেন। তাঁর এই সফর থেকে এটা স্পষ্ট যে ইউক্রেন যুদ্ধের বাস্তবতায় আফ্রিকাকে এখন কতটা প্রয়োজন রাশিয়ার।
মিসর, কঙ্গো, উগান্ডা ও ইথিওপিয়ায় লাভরভের এই সফরের পেছনে বড় একটা উদ্দেশ্য হলো, রাশিয়া বিশ্বমঞ্চে প্রমাণ করতে চায়, পশ্চিমাদের দেওয়া নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও তারা একঘরে নয়। রাশিয়া দেখাতে চায়, বড় শক্তি হিসেবে তারা এমন এক মিত্র, যারা শুধু নির্ঝঞ্ঝাটই নয়, তাদের সঙ্গে নিশ্চিন্তে ব্যবসাও করা যায়।

রাশিয়ার ভূকৌশলগত অবস্থান তুলে ধরার জন্য লাভরভের আফ্রিকা সফর গুরুত্বপূর্ণ। ইউক্রেনে রাশিয়ার সাম্রাজ্যবাদী ভূ-আগ্রাসনকে পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যকার মতাদর্শিক লড়াই হিসেবে দেখাতে চায় রাশিয়া। তাতে মস্কো অনেকটাই সফল। কেননা, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আফ্রিকা মহাদেশের অনেকগুলো দেশ সমালোচনা করেনি। মার্চ মাসে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে আগ্রাসনের জন্য রাশিয়াকে দায়ী করে করা একটা প্রস্তাবে আফ্রিকার ৫৪টি দেশের মধ্যে ২৫টি দেশ ভোটদানে বিরত ছিল, কিংবা বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিল। বিশ্বের অন্য যেকোনো অঞ্চলের চেয়ে আফ্রিকার এই অবস্থান বিপরীত।

খাদ্যশস্য রপ্তানিতে ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার চুক্তির বিষয়টিকে মানবিক উদ্যোগ হিসেবে তুলে ধরতে চায় মস্কো। যদিও আগ্রাসন চালিয়ে এবং দিনের পর দিন ইউক্রেনের বন্দর অবরুদ্ধ করে রেখে বিশ্ববাজারে খাদ্যশস্য পৌঁছাতে দেয়নি রাশিয়া। এ ছাড়া চুক্তির পর ওদেসা বন্দরে বোমা ফেলে খাদ্যকে অস্ত্র করে তুলেছে মস্কো। আর সবকিছুর জন্য উল্টো পশ্চিমকে দোষারোপ করা হয়েছে।

বিশ্বে রাশিয়া যখন একঘরে, ঠিক তখন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের সুযোগ দেওয়ার মাধ্যমে আফ্রিকার এই দেশগুলো ভবিষ্যতে পশ্চিমা বিনিয়োগের সুযোগকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিল। আফ্রিকায় বিনিয়োগকারী শীর্ষ ১০ দেশের ৯টিই পশ্চিমা, যা মোট বিনিয়োগের ৯০ শতাংশ। আফ্রিকার দেশগুলোর ভাবমূর্তির যে ক্ষতি হলো, তা পুনরুদ্ধারে বহু বছর লেগে যেতে পারে।

লাভরভের সফরসূচিতে থাকা গুরুত্বপূর্ণ দুটি দেশ—মিসর ও ইথিওপিয়া—খাদ্য সরবরাহব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত। রাশিয়ার অবরোধের কারণে এ বছর বিশ্বে খাদ্যশস্যের দাম দ্বিগুণ হয়েছে। এতে আফ্রিকাজুড়ে তীব্র সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে।

মতাদর্শিক অবস্থানের ওপর জোর দেওয়ায় আফ্রিকায় রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর এবং অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক বিনিয়োগ কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা নিয়ে অস্পষ্টতা থেকেই যায়। সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি হলো, যখন কোনো প্ররোচনা ছাড়াই রাশিয়া আফ্রিকায় আগ্রাসন চালানোর জন্য সমালোচিত হচ্ছে এবং বিশ্বের খাদ্য, জ্বালানি ও সারের বাজার অস্থিতিশীল করে তুলেছে, সেই সময়ে আফ্রিকার সরকারগুলো কেন লাভরভকে সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছে? এর সংক্ষিপ্ত উত্তর হলো, রাজনৈতিক সমর্থন চায় মস্কো।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাশিয়া নানা অনানুষ্ঠানিক উপায়ে আফ্রিকায় নিজেদের প্রভাব বাড়িয়েছে। পরামর্শক নিয়োগ, ভুল তথ্য প্রচারণা, সম্পদের বিনিময়ে অস্ত্র চুক্তি এবং মূল্যবান খনিজ পাচারের মাধ্যমে সেটা করেছে মস্কো। কম খরচ করে অধিক লাভ লুটে নেওয়ার এই প্রচলিত কৌশল বাস্তবায়ন করা হয়েছে আফ্রিকার জনসমর্থনহীন শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা করার মাধ্যমে। সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, মালি ও সুদানের নড়বড়ে শাসকেরা মস্কোর এই কৌশল বাস্তবায়নে মূল ক্রীড়নকের ভূমিকা পালন করেছেন।

আফ্রিকায় প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে অসামঞ্জস্যপূর্ণ দিকটি হলো, রাশিয়া পায়ের নিচে মাটি না থাকা নেতাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের ওপর ভিত্তিতে ‘অংশীদারত্ব’ তৈরি করেছে, দেশগুলোর জনগণের ওপর নির্ভর করেনি। প্রথাগত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এটা নয়, বরং অভিজাতদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার সম্পর্ক।

মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি লিবিয়াতে রাশিয়ার প্রচেষ্টায় একটা প্রক্সি সরকার গঠনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন। এ ঘটনা দক্ষিণ ভূমধ্যসাগরে রাশিয়ার নৌবাহিনীর প্রতিষ্ঠাকে নিশ্চিত করেছে। একই সঙ্গে লিবিয়ার তেল নিজেদের আয়ত্তে নিতে পেরেছে মস্কো। সুদান ও তিউনিশিয়ায় গণতান্ত্রিক সরকার সরানোর ক্ষেত্রেও রাশিয়ার প্রধান সঙ্গী ছিলেন সিসি।

আরও পড়ুন

এ ছাড়া মিসরের সবচেয়ে বড় অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ রাশিয়া। কায়রোতে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য রাশিয়া ২ হাজার ৫০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে। এ প্রকল্পের অর্থনৈতিক মূল্য সামান্য। কিন্তু সিসি ও পুতিনের মধ্যে যে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক, তারই বহিঃপ্রকাশ।

লাভরভের এই সফর থেকে এটা স্পষ্ট যে আফ্রিকার নেতারা বিশ্বমঞ্চে রাশিয়ার গ্রহণযোগ্যতা তলানিতে নামা সত্ত্বেও মস্কোর সঙ্গে সম্পর্কের মধ্য দিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক মূল্য খুঁজে পেতে চান। উল্লেখ্য, লাভরভ যে দেশগুলোতে সফর করছেন, সেগুলোর বেশির ভাগই পশ্চিমের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখে চলে। পশ্চিমের সঙ্গে আফ্রিকার সম্পর্ক ধসিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য থেকে লাভরভের এই সফর নয়; বরং নিজেদের উদ্দেশ্য আরও বেশি হাসিল করে নিতে চায় মস্কো।

কিন্তু এটা আফ্রিকার নেতাদের জন্য বিপজ্জনক একটা খেলা। রাশিয়ার অর্থনীতির আকার স্পেনের সমান। আফ্রিকার সঙ্গে বাণিজ্য করার কিংবা বিনিয়োগের মতো টাকা মস্কোর নেই। এ ছাড়া বৈদেশিক বিনিয়োগের সঙ্গে খুব শক্তভাবেই আইনের শাসনের বিষয়টি যুক্ত। বিশ্বে রাশিয়া যখন একঘরে, ঠিক তখন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের সুযোগ দেওয়ার মাধ্যমে আফ্রিকার এই দেশগুলো ভবিষ্যতে পশ্চিমা বিনিয়োগের সুযোগকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিল। আফ্রিকায় বিনিয়োগকারী শীর্ষ ১০ দেশের ৯টিই পশ্চিমা, যা মোট বিনিয়োগের ৯০ শতাংশ। আফ্রিকার দেশগুলোর ভাবমূর্তির যে ক্ষতি হলো, তা পুনরুদ্ধারে বহু বছর লেগে যেতে পারে।

লাভরভের আফ্রিকা সফর কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। মস্কো আফ্রিকা মহাদেশে কোনো ধরনের বিনিয়োগ ছাড়াই প্রভাব তৈরি করতে চায়। এই কৌশল তখনই বাস্তবায়নযোগ্য, যখন আফ্রিকা মহাদেশের কতিপয় সরকারপ্রধান রাশিয়াকে তাদের ক্ষমতা রক্ষার অবলম্বন হিসেবে ব্যবহার করবে। মস্কোর সঙ্গে আফ্রিকার নেতাদের অভিযাত্রার উদ্দেশ্য স্পষ্ট। কিন্তু আফ্রিকার সাধারণ মানুষের জন্য এতে তেমন কিছু পাওয়ার নেই।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মনোজ দে
জোসেফ সিগেল ম্যারিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আফ্রিকা সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের গবেষণা পরিচালক