ফুরিয়ে যাচ্ছে কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক, এখন উপায় কী

বাজারে যেসব অ্যান্টিবায়োটিক প্রচলিত আছে, তার বেশির ভাগই এখন অকার্যকর হয়ে পড়েছে।ছবি : রয়টার্স

গত ১৩ অক্টোবর যুক্তরাজ্যের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা ‘শার্প গ্লোবাল রেইজ ইন অ্যান্টিবায়োটিক-রেজিস্ট্যান্ট ইনফেকশন ইন হসপিটালস, ডব্লিউএইচও ফাইন্ডস’ (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এক অনুসন্ধানে দেখতে পেয়েছে, বিশ্বব্যাপী হাসপাতালগুলোতে অ্যান্টিবায়োটিক-রেজিস্ট্যান্ট সংক্রামক রোগ তীব্রভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে) শীর্ষক এক উদ্বেগজনক সংবাদ প্রচার করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী যেসব সাধারণ সংক্রামক রোগ প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিকে সহজে সারানো যেত, তা এখন আর সারানো যাচ্ছে না। চিকিৎসকেরা আতঙ্কের সঙ্গে বলছেন, সামনের দিনগুলোতে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বৃদ্ধির ফলে সাধারণ সংক্রামক রোগের চিকিৎসায় মারাত্মক সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে।

২০২৩ সালের এক জরিপে বলা হয়, পরীক্ষাগারে নিশ্চিত হওয়া ছয়টির মধ্যে একটি সংক্রামক রোগ অ্যান্টিবায়োটিকে সারানো যাচ্ছে না। রক্ত, অন্ত্র, মূত্রনালি এবং যৌন সংক্রমণের মতো সাধারণ সংক্রামক রোগে ৪০ শতাংশ অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর। সবচেয়ে উদ্বেগের কারণ হলো, গ্রাম নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে বেশির ভাগ অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকারিতা দেখাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ২০৫০ সাল নাগাদ অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স ৭০ শতাংশে পৌঁছাবে।

২০১৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর অ্যান্টিবায়োটিক সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একইভাবে উদ্বেগজনক সংবাদ প্রচার করেছিল। ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ রানিং আউট অব অ্যান্টিবায়োটিকস’ শিরোনামের খবরে বলা হয়, অতি দ্রুত পৃথিবী থেকে কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক নিঃশেষ হচ্ছে। ‘অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এজেন্টস ইন ক্লিনিক্যাল ডেভেলপমেন্ট পাইপলাইন ইনক্লুডিং টিউবারকিউলোসিস’ শীর্ষক বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক রিপোর্টে বলা হয়, বাজারে নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আসা স্থবির হয়ে গেছে।

বাজারে যেসব অ্যান্টিবায়োটিক প্রচলিত আছে, তার বেশির ভাগই এখন অকার্যকর হয়ে পড়েছে। যে হারে জীবাণুর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট হচ্ছে, সে হারে নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কৃত হচ্ছে না। যে গতিতে পৃথিবী থেকে কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক নিঃশেষ হচ্ছে, তাতে অচিরেই চিকিৎসকদের সংক্রামক রোগ চিকিৎসায় হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হবে।

রেজিস্ট্যান্ট জীবাণু সংক্রমণের ভয়ে অতি ছোট সার্জারি করতেও চিকিৎসকেরা সাহস পাবেন না। বর্তমানে বাজারে যেসব অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া যাচ্ছে, তা পুরোনো বা প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিকের সংক্ষিপ্ত রাসায়নিক রূপান্তরমাত্র। এসব অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে সাময়িক সুবিধা পাওয়া গেলেও দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা সমাধানে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারছে না বা পারবে না।

অ্যান্টিবায়োটিক-সম্পর্কিত সংকট নিয়ে মানুষ এখনো পুরোপুরি অবহিত ও সচেতন হচ্ছে না। যখন অবহিত হবে, তখন সম্ভবত অনেক দেরি হয়ে যাবে। অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট সংক্রামক রোগ মানবসভ্যতার জন্য এক ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে যাচ্ছে। এই বিপর্যয়ের মাত্রা অনিশ্চিত, ভেদাভেদ অনির্ধারিত, ধনী-গরিব, শিশু-বয়স্ক, সুস্থ, প্রতিরোধক্ষমতাবিহীন রোগী—কেউই এই বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাবে না। তখন বুক চাপড়ানো ছাড়া আমাদের আর কোনো গত্যন্তর থাকবে না।

বর্তমান বিশ্বে কয়েকটি জীবাণু ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। এসব জীবাণুর মধ্যে রয়েছে ই. কোলাই ও মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকিউলোসিস। মূত্রনালি সংক্রমণ ও যক্ষ্মার জন্য এই দুটো জীবাণু দায়ী। মাল্টিড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিউবারকিউলোসিসের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১২ প্রজাতির জীবাণু শনাক্ত করেছে। এর কয়েকটি অতি সাধারণ নিউমোনিয়া ও মূত্রনালি সংক্রমণের জন্য দায়ী। এসব জীবাণুর বিরুদ্ধে ইদানীং কোনো অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না।

অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বিশ্বব্যাপী এক মহাসংকট সৃষ্টি করেছে, যা আধুনিক ওষুধ ও চিকিৎসাব্যবস্থাকে বিপন্ন করে তুলছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক জানান, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স ঠেকানোর জন্য নতুন নতুন কার্যকর ওষুধ আবিষ্কারে পর্যাপ্ত অর্থ বিনিয়োগ জরুরি হয়ে পড়েছে। নয়তো নতুন নতুন জীবাণু সংক্রমণ থেকে মানবসভ্যতাকে রক্ষা করা দুরূহ হয়ে পড়বে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ৫১টি পরীক্ষাধীন অ্যান্টিবায়োটিক চিহ্নিত করেছে, যা অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স ও যক্ষ্মার বিরুদ্ধে কার্যকর হবে বলে দাবি করা হচ্ছে। এর মধ্যে মাত্র আটটি সংক্রামক রোগ চিকিৎসায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে বলে মনে করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। মাল্টিড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকিউলোসিস, গ্রাম নেগেটিভ প্যাথেজেন ক্লেবসিলা ও ই. কোলাই চিকিৎসায় কার্যকর কোনো অপশন চিকিৎসকদের হাতে নেই।

এসব জীবাণু সংক্রমণ অনেক সময় হাসপাতাল ও নার্সিং হোমগুলোতে মানুষের মৃত্যু ডেকে আনতে পারে। পাইপলাইনে খুব বেশি ওরাল বা মুখে খাওয়ার অ্যান্টিবায়োটিক নেই। ওষুধ কোম্পানি ও গবেষকদের প্রাণঘাতী সংক্রামক রোগ চিকিৎসায় নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের আহ্বান জানিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ বিভাগের পরিচালক ড. সুজান হিল। তিনি বলেন, ‘এসব ভয়াবহ সংক্রামক রোগের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করার মতো আমাদের তেমন কোনো প্রতিরক্ষাব্যূহ নেই।’

যক্ষ্মার গবেষণায় খুব বেশি বিনিয়োগ হচ্ছে না। ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট যক্ষ্মার চিকিৎসায় গত ৭০ বছরে মাত্র দুটো ওষুধ বাজারে এসেছে। যক্ষ্মাকে সমূল বিনাশ করার জন্য এবং যক্ষ্মার চিকিৎসার ওষুধ উদ্ভাবনে অন্তত ৮০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ দরকার। অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট মোকাবিলায় নতুন ওষুধ বা চিকিৎসা এককভাবে কার্যকর হবে না। চিকিৎসার সঙ্গে সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। তারপর রয়েছে অ্যান্টিবায়োটিকের যুক্তিসংগত ব্যবহার। যুক্তিসংগত ব্যবহার শুধু মানুষের ক্ষেত্রে নয়, এটি পশু ও কৃষিক্ষেত্রেও নিশ্চিত করতে হবে।

বিশ্বখ্যাত ল্যানসেট জার্নালে ‘অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স—নিড ফর গ্লোবাল সলিউশন’ শীর্ষক একটি বিশ্লেষণধর্মী দীর্ঘ বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ ছাপা হয় কিছুদিন আগে। বিশ্বের ২৬ জন বিজ্ঞানী, চিকিৎসক ও ওষুধবিশেষজ্ঞ প্রবন্ধে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স যে হারে বাড়ছে, তাতে হয়তো দুই থেকে তিন দশকের মধ্যে মানুষ সংক্রামক রোগে অসহায় মৃত্যুবরণ করবে।

ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণজনিত মৃত্যুহার বিংশ শতাব্দীর পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, সে সময় কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক ছিল না। কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিকের অভাবে অতি সাধারণ অস্ত্রোপচার অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। প্রবন্ধটি প্রকাশের পর বিশ্বব্যাপী চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হলেও অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স ঠেকানোর ব্যাপারে বিশ্বে, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি।

কিছুদিন আগে আমার হাতে একটি নামকরা হাসপাতালের জীবাণু কালচারের একটি রিপোর্ট আসে। এক বছরের এক শিশুর ঘায়ের পুঁজ কালচার করে ই. কোলাইয়ের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। জীবাণু কালচারে দেখা গেছে, ই. কোলাইয়ের বিরুদ্ধে বহুল ব্যবহৃত সব অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট। যার মধ্যে রয়েছে অ্যামোক্সিসিলিন, সেপ্টাজিডিম, জেন্টামাইসিন, কোট্রাইমোক্সাজল, অ্যামিকাসিন, ন্যালিডিক্সিক অ্যাসিড, সেফুরক্সিম, সেফোটেক্সামিন, সিপ্রোফ্লক্সাসিন, অ্যাজট্রিওনাম, নেটিলমাইসিন ও সেফট্রিয়াক্সন।

শুধু একটিমাত্র অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকর বলে পরীক্ষায় দেখা গেছে আর তা হলো মেরোপেনেম। আমি রিপোর্টটি দেখে বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেছি। ১৩টি অ্যান্টিবায়োটিকের মধ্যে শুধু একটি অ্যান্টিবায়োটিক ই. কোলাই জীবাণুর বিরুদ্ধে কার্যকর, বাকি সব রেজিস্ট্যান্ট। এই রিপোর্ট থেকে বোঝা যাচ্ছে, আমরা বিপদে আছি, যে বিপদের ভয়াবহতা কল্পনাশক্তিরও বাইরে।

এখনই বিশ্বের প্রতিটি দেশের প্রতিটি অঞ্চলে সব বয়সের সব মানুষ অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের শিকার হওয়ার প্রবল হুমকির মধ্যে রয়েছে।
ছবি : রয়টার্স

প্রথমত, বিশেষ কোনো এনজাইম অ্যান্টিবায়োটিকের গাঠনিক সংকেতে এমন কোনো রাসায়নিক পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে, যার কারণে অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হয়ে পড়ে। দ্বিতীয়ত, অনেক সময় জীবাণু এমন সব এনজাইম তৈরি করে, যা অ্যান্টিবায়োটিকের গাঠনিক সংকেতকে ভেঙে দিতে সক্ষম। এই গাঠনিক সংকেত ভেঙে গেলে অ্যান্টিবায়োটিক নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। তৃতীয়ত, কোনো কোনো জীবাণু আছে, যেগুলো জন্মগতভাবে অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতি সংবেদনশীল নয়। যেমন গ্রাম নেগেটিভ জীবাণুগুলোর কোষপ্রাচীর এমন জটিলভাবে তৈরি, যার প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে অসংখ্য অ্যান্টিবায়োটিক কোনোভাবেই কার্যকর প্রভাব ফেলতে পারে না।

চতুর্থত, জেনেটিক মিউটেশনের (জিনের রাসায়নিক পরিবর্তন) মাধ্যমে অনেক জীবাণু অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক্ষমতা অর্জন করে ফেলে। কোটি কোটি জীবাণুর মধ্যে যেকোনো একটি যদি মিউটেশনের মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়ে যায়, সেই জীবাণু পরে বংশবৃদ্ধি ও বিস্তারের মাধ্যমে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এসব জীবাণু পরিবর্তিত জিনকে অন্য জীবাণুতে ট্রান্সফার করার মাধ্যমে রেজিস্ট্যান্ট জীবাণুর ব্যাপক বিস্তার ঘটায়। এসব জীবাণুতে আক্রান্ত রোগী তখন কোনো অ্যান্টিবায়োটিকে সংক্রমণমুক্ত হতে পারে না। ফলে রোগীর ভোগান্তি বাড়ে কিংবা কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিকের অভাবে অসহায়ভাবে মৃত্যুবরণ করে।

জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব মেডিসিন বিভাগের ক্লিনিক্যাল ডিরেক্টর ড. পাউল আউওয়েটার প্রতিদিন এই সংকটের মুখোমুখি হচ্ছেন। বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘রোগীরা দিন দিন আরও বেশি রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ছে। এ কারণে আমাদের ব্যাপকভাবে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করতে হচ্ছে। ফলে জীবাণু নিজেদের কাঠামো পরিবর্তন করছে। অন্যদিকে আমরা এসব জীবাণু মোকাবিলায় নতুন অ্যান্টিবায়োটিক উদ্ভাবনের উৎসাহ ও উদ্দীপনা হারিয়ে ফেলছি।

সাধারণ মানুষের মধ্যে এ নিয়ে তেমন প্রতিক্রিয়া বা দুশ্চিন্তা নেই। তারা মনে করে, অতীতের মতো চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা পর্যাপ্ত কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার করে সংকট মোকাবিলায় ব্যবস্থা নেবেন। ওষুধ কোম্পানিগুলো তাদের স্বার্থে এ ধরনের আবিষ্কারে এগিয়ে আসবে, যেমনটা অতীতে এসেছে। কিন্তু আমরা বুঝতে পারছি না অ্যান্টিবায়োটিকের ক্ষেত্রে এই পটভূমি ভিন্ন।’

গ্রেফেন স্কুল অব মেডিসিনের জেনারেল ইন্টারনাল মেডিসিনের সহযোগী অধ্যাপক স্পেনবার্গ বলেন, ‘আমাদের বুঝতে হবে, অ্যান্টিবায়োটিকের এমন কতগুলো অনন্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা অন্যান্য ওষুধের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। আজ যে অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকারিতা প্রদর্শন করছে, তা ১০-১৫ বছর পর অকার্যকর হতে পারে, অন্য ওষুধের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটে না। তাই জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে সংক্রামক রোগ মোকাবিলায় নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার অব্যাহত রাখতে হবে।

অর্থনৈতিক মন্দা আর কঠোর নিয়ন্ত্রণের কারণে পরিস্থিতি এমনভাবে পরিবর্তিত হয়েছে যে ওষুধ কোম্পানিগুলো নতুন অ্যান্টিবায়োটিক উদ্ভাবনে আগ্রহ হারাচ্ছে। ইতিমধ্যে আমরা প্রায় সব অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়ার উৎপত্তি লক্ষ করছি। কিন্তু সে হারে নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আসছে না।

রেজিস্ট্যান্ট সংক্রামক ব্যাধির সংখ্যা আগামী পাঁচ বছরে জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাবে। আমরা যে একদম অ্যান্টিবায়োটিক পাচ্ছি না, তা নয়; কিছু কিছু অ্যান্টিবায়োটিক বাজারে আসছে। কিন্তু সেসব অ্যান্টিবায়োটিক গ্রাম নেগেটিভ সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে কার্যকর হচ্ছে না। আমাদের অভাব হলো গ্রাম নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিকের।’

নতুন অ্যান্টিবায়োটিক উদ্ভাবনে ওষুধ কোম্পানিগুলোর অনীহার কারণও রয়েছে। একটি অ্যান্টিবায়োটিক উদ্ভাবনে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে হয়। কিন্তু সে তুলনায় মুনাফা করা যায় না। কোম্পানিগুলোর মতে, মানুষ অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করে অল্প কয়েক দিনের জন্য। ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপের মতো রোগের ক্ষেত্রে যেমন রোগীকে আজীবন ওষুধ গ্রহণ করতে হয়, অ্যান্টিবায়োটিকের ক্ষেত্রে তেমন হয় না। দ্বিতীয়ত, একটি অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কৃত হওয়ার পর অল্প কয়েক বছরে রেজিস্ট্যান্ট হয়ে গেলে মুনাফা তো দূর, পুঁজিও ফেরত আসে না। উদ্ভাবনের পর অ্যান্টিবায়োটিকের অনুমোদন পেতেও অনেক ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে অনুমোদনও পাওয়া যায় না। ফলে ওষুধ কোম্পানিগুলো অ্যান্টিবায়োটিক উদ্ভাবনে বিনিয়োগে আজকাল আর আগ্রহ দেখাচ্ছে না। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রোগী, জয়ী হচ্ছে রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া। এই অশনিসংকেত বারবার উচ্চারিত হলেও সবাই নির্বিকার। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের কথা বাদই দিলাম, ওষুধ কোম্পানির মালিকেরা কি জানেন, কোনো না কোনো সময় তাঁরাও রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়ার শিকার হতে পারেন এবং কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিকের অভাবে তাঁদেরও করুণ পরিণতি হতে পারে!

২০১৪ সালের ৩০ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পৃথিবীর ১১৪টি দেশে পরিচালিত গবেষণার ভিত্তিতে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স সম্পর্কে তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে উদ্বেগের সঙ্গে বলা হয়েছে, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স থেকে সৃষ্ট মহাবিপর্যয় এখন ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার ব্যাপার নয়।

এখনই বিশ্বের প্রতিটি দেশের প্রতিটি অঞ্চলে সব বয়সের সব মানুষ অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের শিকার হওয়ার প্রবল হুমকির মধ্যে রয়েছে। ‘অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স: গ্লোবাল রিপোর্ট অন সার্ভেইলেন্স’ (জীবাণুর প্রতিরোধক্ষমতা অর্জন: কড়া নজরদারির ওপর বিশ্ব প্রতিবেদন) শীর্ষক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সংক্রামক রোগ সৃষ্টিকারী অসংখ্য জীবাণু বেশির ভাগ অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক্ষমতা অর্জন করে ফেলেছে।

প্রতিবেদনে ডায়রিয়া, কলেরা, নিউমোনিয়া, মূত্রনালির সংক্রমণ, গনোরিয়া, সেপসিসের (রক্তের সংক্রমণ) মতো সাধারণ থেকে শুরু করে খুব মারাত্মক সংক্রামক রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর ওপর অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের ফলাফল প্রকাশ করা হয়, যা খুব উদ্বেগজনক। কারণ, প্রতিরোধক্ষমতা অর্জনকারী বহু জীবাণুর বিরুদ্ধে শেষ অবলম্বন হিসেবে বিবেচিত খুব কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিকগুলোও এখন কার্যকারিতা হারাতে বসেছে। কার্বাপেনেমকে এত দিন একমাত্র নন-রেজিস্ট্যান্ট শতভাগ কার্যকর শেষ অবলম্বন অ্যান্টিবায়োটিক হিসেবে গণ্য করা হতো।

জীবন বিপন্নকারী অন্ত্রের জীবাণু ক্লেবসিলা নিউমোনি কার্বাপেনেমের কার্যকারিতাকে ব্যর্থ করে দিয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। ক্লেবসিলা নিউমোনি হাসপাতালে নিউমোনিয়া, সেপসিস, নবজাতকের সংক্রমণ এবং জরুরি বিভাগে চিকিৎসারত বিপন্ন রোগীদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়ানোর মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বহু দেশে রেজিস্ট্যান্সের কারণে কার্বাপেনেম ক্লেবসিলা নিউমোনিতে আক্রান্ত ৫০ শতাংশ রোগীকে সুস্থ করে তুলতে ব্যর্থ হচ্ছে। মূত্রনালির সংক্রমণের জন্য দায়ী গ্রাম নেগেটিভ জীবাণু ই. কোলাইয়ের বিরুদ্ধে বহুল পরিচিত সিপ্রোগ্রুপের (ফ্লোরোকুনোলন) অ্যান্টিবায়োটিকগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এখন আর কাজ করছে না।

১৯৮০ সালে বাজারে আসা সিপ্রোগ্রুপের ওষুধগুলোর বিরুদ্ধে জীবাণুর প্রতিরোধক্ষমতা অর্জনের পরিমাণ ছিল শূন্য। এখন পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই সংক্রামক রোগ চিকিৎসায় সিপ্রোগ্রুপের ওষুধগুলোর কার্যকারিতা ৪০ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। গনোরিয়া চিকিৎসায় শেষ অবলম্বন হিসেবে পরিচিত তৃতীয় প্রজন্মের সেফালোস্পোরিন গ্রুপের ওষুধগুলো এখন অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রিয়া, কানাডা, ফ্রান্স, জাপান, নরওয়ে, স্লোভেনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, সুইডেন ও যুক্তরাজ্যের গনোরিয়ায় আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে। প্রতিদিন সারা বিশ্বে ১০ লাখ মানুষ গনোরিয়ায় আক্রান্ত হয়।

অ্যান্টিবায়োটিক-সম্পর্কিত সংকট নিয়ে মানুষ এখনো পুরোপুরি অবহিত ও সচেতন হচ্ছে না। যখন অবহিত হবে, তখন সম্ভবত অনেক দেরি হয়ে যাবে। অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট সংক্রামক রোগ মানবসভ্যতার জন্য এক ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে যাচ্ছে। এই বিপর্যয়ের মাত্রা অনিশ্চিত, ভেদাভেদ অনির্ধারিত, ধনী-গরিব, শিশু-বয়স্ক, সুস্থ, প্রতিরোধক্ষমতাবিহীন রোগী—কেউই এই বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাবে না। তখন বুক চাপড়ানো ছাড়া আমাদের আর কোনো গত্যন্তর থাকবে না।

ড. মুনীরউদ্দিন আহমদ অধ্যাপক, সাবেক ডিন, ফার্মেসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

[email protected]

(মতামত লেখকের নিজস্ব)