ইসলামে নাগরিকের রাজনৈতিক অধিকার

মানুষ আল্লাহর খলিফা। ইসলামি আইন অনুযায়ী রাষ্ট্র আল্লাহর খেলাফত। রাষ্ট্রপ্রধানকে বলা হয় খলিফা; খলিফা অর্থ প্রতিনিধি। রাষ্ট্রপ্রধান একদিকে আল্লাহর বিধানমতো রাষ্ট্র পরিচালনায় অঙ্গীকারবদ্ধ, তাই তিনি আল্লাহর খলিফা; অন্যদিকে তিনি জনগণের সমর্থনে দায়িত্বপ্রাপ্ত বিধায় তিনি জনতার খলিফা।

এ জন্যই ইসলামি রাষ্ট্র প্রথমত নাগরিকের কল্যাণে আল্লাহর ইচ্ছা বা বিধান দ্বারা পরিচালিত হবে; দ্বিতীয়ত, সৃজনশীলতা ও মননশীলতায় জনগণের চাওয়া-পাওয়া এবং ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাবে।

ইসলাম প্রত্যেক নাগরিকের রাজনৈতিক অধিকার স্বীকার করে। রাষ্ট্র নাগরিককে যেসব অধিকার প্রদান করে থাকে বা একজন নাগরিক রাষ্ট্রে যেসব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে, তা তাঁর নাগরিক অধিকার।

ইসলামি দর্শনে জাতি, ধর্ম, বর্ণনির্বিশেষে সব নাগরিকের অধিকার স্বীকার করে। অধিকার রাষ্ট্র কর্তৃক অনুমোদিত ও নিয়ন্ত্রিত। এ অধিকার সুরক্ষায় রাষ্ট্র দায়িত্ব পালন করে থাকে। নাগরিক অধিকার তিন প্রকার—যথা সামাজিক অধিকার, রাজনৈতিক অধিকার, অর্থনৈতিক অধিকার।

ইসলামি রাষ্ট্রে প্রত্যেক নাগরিকেরই অধিকার সমান। সব নাগরিকের মতামত ও পরামর্শের ভিত্তিতে খেলাফত রাষ্ট্র পরিচালিত হবে। সরকার শুধু এক ব্যক্তি, এক পরিবার তথা রাজতন্ত্র অথবা নির্দিষ্ট কোনো গোষ্ঠীর হবে না; বরং তা হবে গোটা জাতির।

নাগরিকের মতামত ও সমর্থন ছাড়া তাদের ওপর শাসনকার্য পরিচালনার অধিকার কারও নেই। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তাদের কাজ পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতেই স্থির করতে হবে।’ (সুরা-৪২ শূরা, আয়াত: ৩৮) ‘জরুরি প্রয়োজনে তুমি লোকদের সঙ্গে পরামর্শ করো। অতঃপর যখন তুমি সিদ্ধান্ত পৌঁছাবে, তখন আল্লাহর ওপর ভরসা করে কাজ করবে।’ (সুরা-৩ আলে ইমরান, আয়াত: ১৫৯)

রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলাম নাগরিকদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা দিয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘কোনো মানুষকে আল্লাহ কিতাব, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এবং নবুওয়াত দান করার পর সে বলবে, “তোমরা আল্লাহকে পরিহার করে আমার অনুগত হয়ে যাও” এটি সম্ভব নয়।

বরং তারা বলবে তোমরা আল্লাহওয়ালা হয়ে যাও।’ (সুরা-৩ আলে ইমরান, আয়াত: ৭৯) রাজনীতিতে স্বৈরতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ, একনায়কতন্ত্র, দলীয়করণ ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যোগ্যতা অনুসারে সরকারি সব কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করার অধিকার সব নাগরিকের রয়েছে। প্রতিনিধি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া এবং মতামত বা সমর্থন প্রদান করার অধিকার ইসলাম নাগরিকদের দিয়েছে।

নাগরিকের রাজনৈতিক অধিকারের অন্যতম হলো আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার লাভের অধিকার। সব নাগরিকই ন্যায়বিচার লাভের অধিকারী। আইনের চোখে সবাই সমান।

রাষ্ট্রের কোনো নাগরিক যাতে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত না হয়, সে জন্য মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিন কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন, ‘যখন তোমরা লোকদের মধ্যে বিচার করবে, তখন অবশ্যই সুবিচার করবে।’ (সুরা-৪ নিসা, আয়াত: ৫৮) কোনো নাগরিক যদি আদালতে বিচারপ্রার্থী হয়, সে যে মতাদর্শেরই হোক না কেন; সে ন্যায়বিচার পাবে।

হোক সে কারও শত্রু বা মিত্র। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ যেন তোমাদের তাদের প্রতি ন্যায়বিচারে অন্তরায় না হয়। অতএব তোমরা ন্যায়বিচার করো; কারণ, তা খোদাভীতির অধিক নিকটবর্তী।’ (সুরা-৫ মায়েদা, আয়াত: ৮)

নিরাপদ ও শান্তির সমাজ নির্মাণে অতীব জরুরি হলো অপরাধ দমন ও ন্যায়বিচার। বিচার হতে হবে নিরপেক্ষ, হবে না পক্ষপাতদুষ্ট। বিচারের ন্যায়দণ্ড সবার জন্য হবে সমান। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘আমার মেয়ে ফাতেমাও যদি চুরি করে, তবে তাঁর হাত কেটে দেওয়া হবে।’ (আবু দাউদ)

ইসলামি আইনে ন্যায়বিচার যেমন নিশ্চিত করা হয়েছে, তেমনি প্রত্যেক নাগরিকের মানবাধিকারও নিশ্চিত করা হয়েছে। বিচার যেন অবিচার না হয়; বিচারের নামে যেন প্রহসন না হয়; ধারণামূলক ও অজ্ঞতাপ্রসূতভাবে কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

এ জন্য প্রতিটি অভিযোগ ভালোভাবে তদন্তপূর্বক তা প্রমাণিত হলে, অপরাধের মাত্রা পরিমাণে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে ইমানদারগণ, তোমরা অধিকাংশ ধারণাপ্রসূত বিষয় থেকে বিরত থাকো; কেননা অধিকাংশ ধারণাই পাপ।’ (সুরা-৪৯ হুজুরাত, আয়াত: ১২)

  • মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী

যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম

[email protected]