ডিম নেই পাতে, ডিম গেছে হিমাগারে

ডিমপ্রতীকী ছবি

এ মাসের প্রথম সপ্তাহে ডিমের দাম প্রতি ডজন যেখানে ১২০-১২৫ টাকা ছিল, সেখানে দ্বিতীয় সপ্তাহে গিয়ে দাম বেড়ে ১৫০-১৬০ টাকা হয়ে যায়। কয়েক বছর ধরেই আমরা ডিমের বাজারে হঠাৎ করেই দামের এ রকম ‘হাই জাম্প’ দেখে আসছি।

ডিম, মুরগির বাচ্চা থেকে পোলট্রি ফুড উৎপাদনে বাজারে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের একচেটিয়া প্রভাব, ডিমের পাইকারি পর্যায়ে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারসাজি—এ দুটি বিষয় ডিমের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে বারবার সামনে এসেছে।

ডিম গরিবের প্রোটিন, সে কারণে দাম বাড়লে চারদিকে হইচই পড়ে যায়। ভোক্তা অধিকার তাদের সীমিত সাধ্য নিয়ে অভিযান চালায়। দেখা যায়, ডজনে ৩০-৪০ টাকা বেড়ে যাওয়া ডিম ৫ বা ১০ টাকা কমেও যায়। শুধু ডিম নয়, অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রেও দাম বাড়িয়ে কিছুটা কমিয়ে উচ্চমূল্যে স্থিতিশীল রাখার কৌশল প্রয়োগ করতে দেখা যায়।

এবারও যে ডিমের বাজারে কিছুটা সংকট তৈরি হতে পারে, তার আঁচ গত মাসেই পাওয়া যাচ্ছিল। টানা তাপপ্রবাহের কারণে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের কোথাও কোথাও মুরগি মারা যাওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছিল। কিন্তু মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যে সেটা আমলে নেয়নি, সেটা বোঝাই যাচ্ছে।

ডিমের দাম এমন সময়ে বাড়ল, যখন সরকারি হিসাবেই খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি আবারও ১০ শতাংশের ওপরে। সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, কোনো পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী হলে সরকার সেটার দাম বেঁধে দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু বাজারে পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক না করে, বাজার ব্যবস্থাপনাকে সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত না করে, দাম বেঁধে দেওয়ার উদ্যোগটি হাস্যকর ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। একদিকে খোলাবাজার অর্থনীতি, অন্যদিকে দাম বেঁধে দেওয়ার মতো জনতুষ্টিবাদী সিদ্ধান্ত। বাস্তবে বাজারে দাম কমে না।

ডিমের বাজারে যখন আগুন, তখন একের পর এক হিমাগার থেকে মিলছে লাখ লাখ ডিম। ১৫ মে প্রথম আলোর প্রতিবেদন জানাচ্ছে, বগুড়ায় আলুর হিমাগারে পাওয়া গেল পৌনে পাঁচ লাখ ডিম। পরদিন ১৬ মে, প্রথম আলোর আরেকটি খবর জানাচ্ছে, কুমিল্লায় আলুর হিমাগারে ২১ লাখ ডিম।

কিশোরগঞ্জ, নরসিংদী, মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জসহ আরও কয়েকটি জেলার হিমাগার থেকে অর্ধকোটি ডিমের মজুত পায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।

ডিমের দাম বাড়ার প্রভাব অবধারিতভাবে দেশের গরিব মানুষের প্রোটিনের অন্যান্য উৎসের ওপর গিয়ে পড়ে। ডিমের সঙ্গে ব্রয়লার মুরগির দামও বেড়েছে। অথচ গরিবদের আয়ের বেশির ভাগটাই ব্যয় করতে হয় খাবার কিনতে। পরিস্থিতি এখন এমন যে বিশ্বব্যাংকের জরিপ বলছে, এ দেশের ৭১ শতাংশ মানুষ এখন খাবার কেনা নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছে।

বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে হিমাগারে ডিম সংরক্ষণ অবৈধ নয়। কিন্তু বাজার অস্থিতিশীল করার উদ্দেশ্য থেকে যদি মজুত করে, তাহলে সেটা অপরাধ। একই সময়ে দেশের বেশ কয়েকটি জেলার হিমাগার থেকে যখন ডিম উদ্ধার হয়, সেটা সংরক্ষণ না মজুত, সেটা নিয়ে প্রশ্ন থাকার অবকাশ খুব কম। হাতে গোনা কয়েকটি বড় উৎপাদকের সঙ্গে বাংলাদেশে ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে মধ্যস্বত্বভোগীরা। ছোট খামারিদের কাছ থেকে মধ্যস্বত্বভোগীরা ডিম কিনে সেই ডিম হিমাগারে রেখেছে, পরে বাড়তি দামে বিক্রি করছে। প্রশ্ন হচ্ছে, হিমাগারগুলোতে তারা কীভাবে ডিম মজুত করতে পেরেছে?

ডিমের দাম বাড়ার প্রভাব অবধারিতভাবে দেশের গরিব মানুষের প্রোটিনের অন্যান্য উৎসের ওপর গিয়ে পড়ে। ডিমের সঙ্গে ব্রয়লার মুরগির দামও বেড়েছে। অথচ গরিবদের আয়ের বেশির ভাগটাই ব্যয় করতে হয় খাবার কিনতে। পরিস্থিতি এখন এমন যে বিশ্বব্যাংকের জরিপ বলছে, এ দেশের ৭১ শতাংশ মানুষ এখন খাবার কেনা নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছে।

আর বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) সাম্প্রতিক প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, দুই বছর আগের চেয়ে গরিব মানুষের খাবার কেনার পেছনে ৫৮ শতাংশ বেশি ব্যয় হচ্ছে। ২০২২ সালে দেশের দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের খাবার কেনার খরচ ছিল প্রতি মাসে মাথাপিছু ১ হাজার ৮৫১ টাকা। এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে মাথাপিছু খাবার কেনার খরচ বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৯২৩ টাকা। দেশের ৬৮ শতাংশ মানুষ জীবনযাত্রার ব্যয় কমিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছে।

এসব পরিসংখ্যানই কি যথেষ্ট নয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কীভাবে বেঁচেবর্তে আছে? এ পরিস্থিতিতে তাদের নাগালের ভেতর থাকা কোনো পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া মানে পাত থেকে সেটাকে বাদ দিয়ে দেওয়া। অনেকের পাত থেকে ডিম যখন বাদ পড়ছে, সেই ডিমের সন্ধান মিলছে হিমাগারে।

দেশের বিশাল অংশের মানুষ যখন খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকিতে এবং ব্যয়ের সঙ্গে আয়ের লাগাম ধরতে না পেরে অনেক মানুষ যখন খাবার থেকে একটা একটা করে পদ বাদ দিতে বাধ্য হচ্ছে, সে সময় কিছু মানুষ অতি মুনাফার জন্য বাজার কারসাজি করেই চলবে, এর চেয়ে বড় অপরাধ আর কী হতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, সিন্ডিকেট করে আজ ডিম তো কাল মসলার দাম বাড়ানোর সুযোগ কারা করে দিচ্ছে?

● মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী