৭ অক্টোবর থেকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোয় দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা একই খবর, ‘ইসরায়েল যুদ্ধ করছে’। কিন্তু আন্তর্জাতিক পাঠক, শ্রোতা ও দর্শকের জন্য ইসরায়েলের দখলদারি কোনো ব্রেকিং নিউজ নয়। তারা বরং এসব খবর থেকে ফিলিস্তিনিদের বিপর্যস্ত, বিপন্ন জীবনকে একঝলক দেখার সুযোগ পেল।
ফিলিস্তিনিদের যন্ত্রণা, মৃত্যু এবং ধ্বংস বেশির ভাগ সংবাদমাধ্যমেই গুরুত্ব পায়নি, কিংবা গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল। সেদিনের এই অপ্রত্যাশিত হামলায় যখন ১ হাজার ৪০০ ইসরায়েলি খুন হলেন, তখন সবাই হকচকিয়ে উঠলেন।
১৯৪৮ সালে নির্ধারিত সীমারেখার ভেতরে ঢুকে ফিলিস্তিনের সশস্ত্র বাহিনীর এই হামলা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন বিরোধের একটা উল্লেখযোগ্য দিকের সূচনা করে। এই হামলায় ইসরায়েলি সেনা ও সাধারণ মানুষের প্রাণহানিই শুধু ঘটেনি, ফিলিস্তিনিদের বাদ দিয়ে তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার যে তোড়জোড় চলছিল, সেই উদ্যোগের ভিতও নড়ে যায়।
এই হামলায় রামসফেল্ড ম্যাট্রিক্সের প্রতিফলন দেখি আমরা। ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র এবং এই অঞ্চলের দেশগুলোর জন্য এই হামলা ‘জানা-জানা’ অর্থাৎ ফিলিস্তিনিদের অস্তিত্ব সম্পর্কে নতুন করে মনে করিয়েছে।
সেই সঙ্গে ‘জানা-অজানা’কেও উসকে দিয়েছে। প্রমাণ করেছে যে ইসরায়েলের অ্যাপারথেইড রেজিম (জাতিগত বৈষম্য জারি রাখার রাষ্ট্রীয় ধারা) এভাবেই চলতে থাকবে, যুদ্ধও চলবে বিরতিহীনভাবে। এই হামলায় যে ‘অজানা-জানা’ অংশটি আছে, তা হলো অবরুদ্ধদের হাজারো দুর্বলতা থাকতে পারে। তবে যত দিন তারা দখলদারদের অধীনে থাকবে, তত দিন প্রতিরোধের সম্ভাবনাও মরবে না। রামসফেল্ড ম্যাট্রিক্সে যে ‘অজানা-অজানা’ বিষয়ের কথা বলা আছে, এখানে তার উপস্থিতিও আছে প্রবলভাবে। এই হামলা অনেকের কাছেই ছিল ‘অজানা-অজানা’, যা পরবর্তীতে পুরো বিশ্বকে বুঝিয়ে ছেড়েছে যে মধ্যপ্রাচ্য ও বৈশ্বিক ভূরাজনীতিতে ইসরায়েলকে শর্তহীন, জবাবদিহিহীন সমর্থনের ফল কি হতে পারে।
আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। আমরা জানতাম, মূলধারার গণমাধ্যম দ্রুত ৭ অক্টোবরের ঘটনাকে ৯/১১–এর সঙ্গে তুলনা করবে। দুটি ঘটনাতেই গোয়েন্দা ব্যর্থতার অভিযোগ ছিল।
মনে রাখা দরকার, ৯/১১–এর হামলা ছিল কল্পনাতীত। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিকেও ওই হামলা হার মানিয়েছিল। ৭ অক্টোবরের হামলাও ভয়াবহতার মাত্রায় আগের যেকোনো ঘটনাকে ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু বর্বর দখলদারির প্রেক্ষাপটে এ ধরনের বিদ্রোহ আর যা–ই হোক, কল্পনাতীত কিছু ছিল না।
ইসরায়েল গত দুই দশকে যা করেছে, তা ফিলিস্তিন নিয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের পথকে রুদ্ধ করে দিয়েছে। অ্যাপারথেইড নীতিতে শুধু ফিলিস্তিনের আঞ্চলিক অখণ্ডতা নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা হয়নি, সামরিক শক্তিনির্ভর ঔপনিবেশিক শক্তি ফিলিস্তিনের প্রতিটি ইঞ্চি দখল করার চেষ্টা করেছে।
উপরন্তু গাজাকে বড়জোর উন্মুক্ত জেলখানা বা ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’ হিসেবে টিকিয়ে রেখে অবিচার জারি রেখেছে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ।
ইসরায়েলের পাশবিক দখলদারি নীতির বাইরে সম্ভবত আরও গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হলো, কোনোভাবেই ফিলিস্তিন যেন তার বর্তমান পরিস্থিতি থেকে বের হতে না পারে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলের রাজনৈতিক গণ্ডির ভেতর সবচেয়ে প্রচলিত বস্তাপচা যে উক্তিটি প্রচলিত তা হলো, ফিলিস্তিনের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী ইসরায়েলের অস্তিত্বে বিশ্বাসী নয়।
অবরুদ্ধ অঞ্চলের বাসিন্দারা এ কথা বলে হয়তো আক্রমণবৈষম্য মৌখিকভাবে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু ইসরায়েলের জন্য এ শুধু মুখের কথা নয়। তারা সব সময় ফিলিস্তিনিদের অস্তিত্ব অস্বীকার করে আসছে। যতক্ষণ পর্যন্ত ইসরায়েলিরা ফিলিস্তিনিদের অস্তিত্ব স্বীকার করে না নেবে এবং তাদের স্বীকৃতি না দেবে—রাজনৈতিক বা সামরিক পদক্ষেপের মাধ্যমে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকটের সমাধান করা অসম্ভব কল্পনা হয়েই থাকবে।
দুই রাষ্ট্রব্যবস্থায় সমাধানের সব পথ বন্ধ করে দিয়ে ইসরায়েল অ্যাপারথেইড রাষ্ট্র হিসেবে জেঁকে বসেছে। এই ব্যবস্থায় ফিলিস্তিনিদের কোনো জায়গাই নেই। না রাজনৈতিক নেতৃত্বে, না বৃহত্তর সমাজ গঠনে।
আদতে, ফিলিস্তিনিরা তাদের রাডারের মধ্যেই নেই। ব্যক্তি বা রাজনৈতিক যে দোদুল্যমানতা, তার কোথাও তাদের কোনো অস্তিত্ব নেই। যেমন ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইওয়াভ গ্যালান্ট ফিলিস্তিনিদের ‘মানবপশু’ নামে অভিহিত করে গাজাকে পুরোপুরি অবরুদ্ধ করার পক্ষে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন।
ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট, অনির্বাচিত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব, হামাসের ফিলিস্তিনিদের জন্য রাজনৈতিক দল হয়ে ওঠার সীমাবদ্ধতা এবং বিশ্বের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া, মধ্যপ্রাচ্যে দশকের পর দশক ধরে চলা যুদ্ধবিগ্রহ, যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েলের যেকোনো কাজে অকুণ্ঠ সমর্থন এবং ইউরোপের ভূরাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়া ইত্যাদি হাজারটা কারণ এই সংকট সমাধানের পথে অচলাবস্থা তৈরি করেছে।
ওয়াশিংটনকে নিয়ে আস্থার সংকট
বর্তমান পরিস্থিতি কোনো আশা দেখায় না, বরং তা হৃদয়বিদারক। কিন্তু এই হতাশার মধ্যেও ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা এবং এ অঞ্চলকে ঘিরে চলমান ভূরাজনীতিকে ফুটিয়ে তুলেছে।
প্রথমত, ফিলিস্তিনিদের বুঝতে হবে, তারা এত বছর ধরে যে কষ্টের মধ্যে থেকেছে, তার সমাপ্তি খুব সহজে হবে না। তবে পরিবর্তনের একটা সম্ভাবনা আছে, নতুন একটা পর্বেরও সূচনা হতে পারে।
তারা ভুলতে বসা ফিলিস্তিনের অস্তিত্বের জানান দিয়েছে, বিশেষ করে ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র ও আঞ্চলিক দেশগুলোর কাছে। যদিও এই জানানটুকু দিতে তারা গভীর ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। ইসরায়েল ও গাজায় বেসামরিক জনগণের প্রাণহানির যে চক্র চলমান, বছরের পর বছর তা থামানো যায়নি। নতুন কিছু হতে পারে তখনই, যখন ফিলিস্তিনে একটি নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্বের উদ্ভব হবে।
গাজা সংকটকে মামুলি ইস্যু, শুধু বন্দিবিনিময়ের মাধ্যম অথবা ইসরায়েলের সঙ্গে বিপজ্জনক কোনো নিরাপত্তা চুক্তিতে পৌঁছানো অথবা প্রতিবেশী দেশগুলোর লাভালাভের প্রেক্ষাপট থেকে ব্যাখ্যা করা হবে বড় ভুল।
চলমান সংকটে ওয়াশিংটন ও ইউরোপের যে সাড়া, তা দেখে অনেকেই আশাবাদী হবেন না। তার ওপর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন যখন বলেন, ‘আমি ইসরায়েলে এসেছি একজন ইহুদি হিসেবে’, এবং পাশে থাকে মতাদর্শগত ও সামরিক সমর্থন, তখন ব্লিঙ্কেনের এই মন্তব্য জাতিগত ও ধর্মীয় বিভেদকে উসকে দেয়।
ওয়াশিংটনের মধ্যপ্রাচ্যনীতি ইসরায়েলকেন্দ্রিক, ইসরায়েলের চোখ দিয়ে তারা ভূরাজনৈতিক কৌশল ঠিক করে। এ বড় উদ্বেগের কথা। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ যদি সত্যিকারের ভূমিকা রাখতে চায়, তাহলে তাদের ৭ অক্টোবরের পরিপ্রেক্ষিতে ইসরায়েলের প্রতিশোধমূলক আচরণের বাইরে বেরিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।
ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং সংকট যেখানে প্রতিদিন চেহারা বদলায়, সেখানে জো বাইডেনের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং ভূরাজনৈতিক বিচক্ষণতা ট্রাম্পের মতো হলে চলবে না।
বাইডেন প্রশাসন ইহুদি জনগোষ্ঠীর মনোভাব বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে। ওরা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নীতির বিরুদ্ধে মাসের পর মাস রাস্তায় আন্দোলন করছে।
মনে হচ্ছে মার্কিন প্রশাসন এডওয়ার্ড সাঈদ ‘আমেরিকান জায়নিজম’ বলে যে শব্দটি ব্যবহার করেছে, তার প্রতিভূ হয়ে উঠেছে। পাল্টা হামলা, প্রতিশোধ আকাঙ্ক্ষা মধ্যপ্রাচ্যে কখনো রাজনৈতিক কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সহায়ক হয়নি। মার্কিনিদের জন্য বিপর্যয় এখন অপেক্ষমাণ কারণ তারা নেতানিয়াহুর হিংসাত্মক মনোভাবের বৃত্তে আটকা পড়েছে।
৯/১১–তে আমরা যে ধর্মান্ধ ভাষ্য পেয়েছিলাম, মার্কিন রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে সেই একই ধারার বক্তব্য আমরা এবারও শুনেছি। প্রেসিডেন্ট বাইডেন ‘দ্বিখণ্ডিত মস্তকের’ শিশুদের ছবি দেখার কথা বলেছেন, সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম ইরানে বোমা হামলার কথা বলেছেন। এতে মনে হয়, তাঁরা একটা ধর্মযুদ্ধে আছেন, ফলে ওই জায়গাটি গুঁড়িয়ে দিতে হবে। মার্কিনিদের এই চড়া স্বর তাদের অবস্থান কি তা প্রকাশ করে।
মধ্যপ্রাচ্যও এতকাল ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকট সমাধানে যে একচোখা ও বেপরোয়া সব বিকল্প হাজির করেছে, তাতে কোনো কাজ হবে না। মিসর তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট সমাধানে ইসরায়েলের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে এবং ফিলিস্তিনকে একটা মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র যদি ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ নিয়ে সত্যিই কাজ করতে চায়, তাহলে তাদের ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। এ কাজে তারা তুরস্ক বা কাতারের সহযোগিতা নিতে পারে। এ দুই দেশের সঙ্গেই ফিলিস্তিনের ভালো যোগাযোগ আছে। উপসাগরীয় অঞ্চল ও মিসরের সঙ্গেও আলোচনা করতে পারে সংকটের চূড়ান্ত সমাধানের জন্য।
১৬ অক্টোবর তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান এক সংবাদ সম্মেলনে সমাধানের একটি সূত্র উপস্থাপন করেছেন। যেখানে তিনি বলেছেন, সর্বসম্মতিক্রমে নেওয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ফিলিস্তিনের পক্ষে নিশ্চয়তাদানকারী এক বা একাধিক রাষ্ট্র থাকবে। তুরস্ক হতে পারে তার একটি।
গাজা এখন গভীর সংকটে। এ অবস্থায় ইসরায়েলের দয়াদাক্ষিণ্য বা যুক্তরাষ্ট্রের বিবেচনার ওপর নির্ভর করা বোকামি।
মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ
তাহা ওজহান আঙ্কারা ইনস্টিটিউটের গবেষণা পরিচালক, লেখক ও শিক্ষাবিদ