হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ যেভাবে বৈশ্বিক পরিস্থিতি পাল্টে দিচ্ছে

ইসরায়েলের হামলায় গাজার স্কুল, হাসপাতাল, শরণার্থীশিবির কোনো কিছুই রক্ষা পাচ্ছে না।

মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ফিরে এসেছে। ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর প্রায় এক মাস ধরে গাজায় ইসরায়েল অভিযান চালাচ্ছে এবং ক্রমাগত স্থল অভিযান জোরদার করেই যাচ্ছে।

যাঁরা ইসরায়েল বাস করছেন অথবা আমার মতো প্রবাসে থাকা লোকদের যেসব পরিবার–পরিজন সেখানে বসবাস করছেন, তাঁদের কাছে এটি একটি গভীর ব্যক্তিগত পর্যায়ের সমস্যা হয়ে উঠেছে। একই সঙ্গে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে বিশ্বের অগণিত মানুষ সংহতি প্রকাশ করেছে।

তবে একেবারে ব্যক্তি পর্যায়ের সম্পর্কের বাইরে এই যুদ্ধ একটি বৈশ্বিক সংকট হয়ে উঠেছে। ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী যে প্রভাব পড়েছে, এই যুদ্ধের প্রভাব তার চেয়ে অনেক বেশি সুদূরপ্রসারী হয়ে দেখা দিচ্ছে।

আরও পড়ুন

এ যুদ্ধের প্রভাব সবার আগে যেখানে অনুভূত হবে, সেটি হলো মধ্যপ্রাচ্য। বহু বছর ধরে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যে বিভ্রমের আশ্রয় নিয়ে দেশবাসীকে শাসন করে এসেছেন, এই যুদ্ধ সেই বিভ্রম-বিভ্রান্তিকে ভেঙে দিয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, ফিলিস্তিনিকে ইসরায়েল কোনো রকম স্বীকৃতি না দিয়েই আরব দেশগুলোর সঙ্গে মসৃণভাবে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে সক্ষম হবে বলে নেতানিয়াহু যে আশা করেছিলেন, সেটি এখন আর সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।  

এ প্রশ্ন এখন এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

গাজায় আক্রমণের ফল কী হবে না হবে, সে প্রশ্নের বাইরে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মধ্যপ্রাচ্য শান্তির বিষয়ে ইসরায়েলকে এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সতর্ক ও বিচক্ষণতার সঙ্গে কৌশলনীতি গ্রহণ করতে হবে।

সৌদি আরব ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিল। কিন্তু এখন সৌদি জনগণ ও মুসলিম বিশ্বের চাপের মুখে পড়ে সৌদি সরকার সম্ভবত এ বিষয়ে সামনে এগোতে ইসরায়েলের কাছে ফিলিস্তিনের জন্য বড় ধরনের ছাড় দাবি করবে।

তর্কাতীতভাবেই ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে। কিন্তু এই ভাষ্য প্রতিষ্ঠায় কিংবা নিজের রাজনৈতিক অবস্থানকে সুসংহত করতে নেতানিয়াহু যে বেপরোয়া অভিযান চালিয়েছেন, তা আঞ্চলিক অস্থিরতার ঝুঁকি তৈরি করেছে।

নেতানিয়াহু হয়তো ভাবছেন, উপসাগরীয় অঞ্চলের নামমাত্র মিত্রদের নিয়ে তিনি তাঁর ‘পছন্দের নক্ষত্রমালা’ পুনরায় গড়ে তোলার চেষ্টা করবেন এবং ইরানবিরোধী সুন্নি আরব দেশগুলোকে নিয়ে ‘প্রতিরোধচক্র’ গড়ে তুলবেন। এই বৃহত্তর ইস্যুর আড়ালে ফিলিস্তিন ইস্যু চাপা পড়ে যাবে।

আরও পড়ুন

তবে গাজা-ইসরায়েলের এই যুদ্ধের প্রভাব মধ্যপ্রাচ্য ছাড়িয়ে বাইরের দেশগুলোয়ও পড়বে। এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ইউক্রেন। কিছুদিন আগেও সহিংসতা ও বর্বরতার শিকার হওয়া ইউক্রেনীয়দের দুঃখ–দুর্দশার কথা যেভাবে সামনে আসত, এখন তা আর আসছে না। খারকিভ ও মাউরিপোলে হামলার পর যেসব ধ্বংসলীলার ছবি সংবাদমাধ্যমে এসেছিল, এখন গাজা থেকে সে রকমই হৃদয় বিদীর্ণ করা ছবি আসছে।

অধিকন্তু গাজায় ইসরায়েলের অভিযানের সঙ্গে তুলনা করে অনেকেই ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধকে ইউরোপের ‘স্থানীয়’ সংঘাত বলে আখ্যা দিচ্ছেন।

যেহেতু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অব্যাহত সমর্থনের ওপর ইউক্রেনের অস্তিত্ব নির্ভর করছে, সেহেতু ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ থেকে আন্তর্জাতিক মনোযোগ সরে গেলে তা তাদের সংগ্রামের জন্য দুঃসংবাদ হয়ে দাঁড়াবে।

শুধু তা–ই নয়, যদি ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ প্রলম্বিত হয় এবং ইরানের সম্পৃক্তি বাড়ে, তাহলে জ্বালানি তেলের দামের ওপর তার প্রভাব পড়বে। জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গেলে রাশিয়ার ওপর তেল নিষেধাজ্ঞা জারি রাখা তখন পশ্চিমাদের জন্য আরও ব্যয়সাধ্য হয়ে উঠবে।

আর গাজা সংকট ইউরোপের জন্য আরও বিশদ পরিসরের চ্যালেঞ্জ সামনে আনছে। এর প্রারম্ভিক ধাক্কায় ফ্রান্স, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যের মধ্যকার চিড় ধরা সম্পর্কের আসল ছবি উন্মোচিত হয়ে গেছে।

ফ্রান্সে গত বছরে যতসংখ্যক ইহুদিবিরোধী ঘটনা ঘটেছে, তার চেয়ে বেশি ঘটেছে গত তিন সপ্তাহে। একই সঙ্গে হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্য সদস্যদেশগুলোর বিভক্তিকেও উসকে দিচ্ছে।

আরও পড়ুন

গত বছর রাশিয়া ইউক্রেনে সর্বাত্মক যুদ্ধ চালানো শুরু করার পর ইউরোপীয় দেশগুলো নিজেদের মধ্যে বিস্ময়কর জোরালো ঐক্য দেখিয়েছিল। তাদের সবার দৃষ্টি ইউক্রেনের দিকে নিবদ্ধ ছিল। এখন সেই দৃষ্টি ইউক্রেন, নাগারনো-কারাবাখ ও গাজায় ভাগ হয়ে গেছে। গাজায় অস্ত্রবিরতির বিষয়ে গত সপ্তাহে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে উত্থাপন করা প্রস্তাবে ভোটদানের বিষয়ে ইইউ সদস্যদেশগুলো তিন রকম ভোট দিয়েছে।

ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধে ইইউর অসংগঠিত প্রতিক্রিয়ার কারণে চীনের জোরালো প্রতিক্রিয়া সবার দৃষ্টি কেড়েছে। ইউক্রেনে রাশিয়া অভিযান চালানোর পর চীন যেমন নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছিল, এ ক্ষেত্রে তারা নিরপেক্ষ নয়। চীন দ্রুততার সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের সমর্থন দিয়েছে। এটি বৈশ্বিক দক্ষিণে চীনের প্রাধান্য বিস্তার চেষ্টার একটি অংশ হিসেবে কাজ করছে। চীনের কূটনীতিকেরা ইসরায়েল ও রাশিয়া এবং ফিলিস্তিন ও ইউক্রেনবিষয়ক পশ্চিমা দ্বিমুখী নীতিকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

তবে এই যুদ্ধে ফিলিস্তিনকে চীনের সমর্থন দেওয়াটা কিছু ঝামেলার সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে চীনের উদ্যোগে ইরান ও সৌদি আরবকে এ ছাতার তলে আনার যে চেষ্টা চলছে, সেটি হুমকির মুখে পড়তে পারে।

আর হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধের কারণে মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে আমেরিকার যে দশা হয়েছে, তা আমেরিকান ক্রাইম ফিল্ম দ্য গডফাদার পার্ট থ্রির একটি বিখ্যাত সংলাপ মনে করিয়ে দেয়: ‘যখনই ভাবি আমি বেরিয়ে যাব, তখনই তারা আমাকে টেনে ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়।’

জো বাইডেন ভাবছিলেন, তাঁর পূর্বসূরি বারাক ওবামা ও ডোনাল্ড ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন; কিন্তু এবার তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে এশিয়ায় মনোযোগী হতে পারবেন। কিন্তু এখন আবার তাঁকে পররাষ্ট্রনীতিতে মধ্যপ্রাচ্যকেই এক নম্বর ইস্যু হিসেবে রাখতে হচ্ছে। আর এটি করতে গিয়ে এশিয়ায় মার্কিন প্রাধান্য ধরে রাখা হুমকির মধ্যে পড়ে গেছে।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনূদিত

  • মার্ক লিওনার্ড ইউরোপীয় কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের পরিচালক