ডিম খাওয়া নিয়ে এত বিভ্রান্তি!

আজ বিশ্ব ডিম দিবসঅলঙ্করণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

ডিম একটি ছোট্ট খাবার, কিন্তু পুষ্টিতে পরিপূর্ণ এক বিস্ময়। এটি শুধু দৈনন্দিন খাদ্যের উপাদান নয়, মানবস্বাস্থ্যের এক অমূল্য সম্পদ। এ বছর ১০ অক্টোবর, বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে বিশ্ব ডিম দিবস, যার প্রতিপাদ্য—‘ডিমে আছে প্রোটিন, খেতে হবে প্রতিদিন।’

এই প্রতিপাদ্য আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় ডিমের গুরুত্ব কতটা অপরিসীম। গুরুত্ব বিবেচনায়, ডিমকে বলা হয় ‘প্রকৃতির পরিপূর্ণ খাদ্য’, অর্থাৎ প্রকৃতির তৈরি পূর্ণাঙ্গ সুষম খাদ্য। ডিমের গড় গঠনে থাকে প্রায় ৭৪ শতাংশ পানি, ১২-১৩ শতাংশ উচ্চমানের প্রোটিন, ১১-১২ শতাংশ চর্বি (প্রধানত কুসুমে), এবং সামান্য পরিমাণ কার্বোহাইড্রেট ও খনিজ পদার্থ । একটি ডিমে প্রায় সব জরুরি পুষ্টি উপাদান রয়েছে—ভিটামিন এ, ডি, ই, কে এবং বি-কমপ্লেক্স, ফলেট, বায়োটিন, কোলিন, আয়রন, জিঙ্ক, ফসফরাস, সেলেনিয়াম ও আয়োডিনসহ বহু মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট।

সবচেয়ে মূল্যবান হলো এর প্রোটিনের মান—ডিমের প্রোটিনের বায়োলজিক্যাল ভ্যালু প্রায় ৯৪ শতাংশ, অর্থাৎ মানবদেহ এই প্রোটিনকে সবচেয়ে দক্ষভাবে শোষণ ও ব্যবহার করতে পারে। ডিমের অ্যামিনো অ্যাসিড গঠন মানবদেহের প্রয়োজনীয় অ্যামিনো অ্যাসিড প্রোফাইলের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ, যা একে ‘রেফারেন্স প্রোটিন’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ডিমে থাকা উচ্চমানের প্রোটিন পেশি গঠন, হাড়ের দৃঢ়তা রক্ষা, রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানো ও মস্তিষ্কের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে ডিমের কোলিন উপাদান মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্রে ‘অ্যাসিটাইলকোলিন’ নামক নিউরোট্রান্সমিটার তৈরিতে সহায়তা করে, যা শেখা, স্মৃতি ও মনোযোগ বৃদ্ধিতে অপরিহার্য। গর্ভবতী নারী ও শিশুদের জন্য ডিমে থাকা কোলিন ও আয়রন ভ্রূণের মস্তিষ্ক বিকাশ ও স্নায়ু গঠনে অত্যন্ত কার্যকর।

লাল না সাদা—ভ্রান্ত ধারণা দূর করি

আমাদের দেশে অনেকেই মনে করেন লাল ডিম বেশি পুষ্টিকর। আসলে এটি একটি ভুল ধারণা। লাল ডিম আসে ব্রাউন জাতের মুরগি থেকে, আর সাদা ডিম আসে হোয়াইট জাতের মুরগি থেকে। খোসার রং ভিন্ন হলেও পুষ্টিগত দিক থেকে কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই। উভয়ই সমান প্রোটিন, ভিটামিন ও খনিজ উপাদানে সমৃদ্ধ। তাই রং নয়, গুরুত্ব দিতে হবে নিয়মিত ডিম খাওয়ার অভ্যাসে।

দেশি না ফার্মের ডিম—কোনটি ভালো

দেশি মুরগির ডিমে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড ও ভিটামিন ডি সামান্য বেশি থাকতে পারে। কারণ, তারা খোলা মাঠে ঘুরে বেড়ায় ও প্রাকৃতিক খাদ্য খায়। তবে ফার্মের মুরগির ডিমও কম নয়—পুষ্টিগুণ স্থিতিশীল, নিরাপদ ও সহজলভ্য। দুটোই সমানভাবে স্বাস্থ্যসম্মত, যদি সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও সেদ্ধ করে খাওয়া হয়। তাই সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী ডিমই প্রতিদিনের খাবারে রাখা উচিত।

ডিম ও কোলেস্টেরল: ভয় নয়, সচেতনতা দরকার

অনেকেই মনে করেন ডিম খেলে কোলেস্টেরল বেড়ে যায়। কিন্তু আধুনিক গবেষণায় প্রমাণিত—ডিম শরীরে ক্ষতিকর কোলেস্টেরল (এলডিএল) বাড়ায় না, বরং উপকারী এইচডিএল বাড়িয়ে হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি কমায়। আমাদের লিভার প্রতিদিন প্রায় ২০০০ মিলিগ্রাম কোলেস্টেরল উৎপাদন করে, অথচ একটি ডিমে থাকে মাত্র প্রায় ১৮৫ মিলিগ্রাম। ডিম খাওয়ার ফলে শরীর নিজেই স্বাভাবিকভাবে কোলেস্টেরলের ভারসাম্য বজায় রাখে। এ কারণেই ২০১৫ সালে আমেরিকার খাদ্য নির্দেশিকায় খাদ্য কোলেস্টেরলের সীমা তুলে নেওয়া হয়।

বয়সভেদে ডিমের গুরুত্ব

শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশে প্রতিদিন অন্তত একটি ডিম অত্যন্ত কার্যকর। কিশোর ও তরুণদের জন্য পড়াশোনা ও শারীরিক পরিশ্রমের সময় প্রতিদিন ২-৩টি ডিম নিরাপদ ও উপকারী। গর্ভবতী নারীর ক্ষেত্রে ডিমে থাকা কোলিন ও আয়রন ভ্রূণের মস্তিষ্ক ও রক্ত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আর বয়স্কদের জন্য ডিম হলো সহজপাচ্য প্রোটিন, ভিটামিন ডি, লুটেইন ও জেক্সানথিনের উৎস, যা চোখ ও হাড়ের স্বাস্থ্যে সহায়তা করে। সারকথা, প্রতিটি বয়সের মানুষই প্রতিদিন অন্তত একটি করে ডিম খেতে পারেন, বিশেষত সেদ্ধ অবস্থায়।

ডিম ও ওজন নিয়ন্ত্রণ

ডিমের ‘স্যাটাইটি ইনডেক্স’ অনেক বেশি—মানে এটি খেলে দীর্ঘ সময় পেট ভরা থাকে। সকালে সেদ্ধ ডিম খেলে সারা দিন কম ক্যালরি গ্রহণ হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, সকালের নাশতায় ডিম খাওয়া ব্যক্তিরা দ্রুত ওজন কমাতে পারেন। কারণ, এটি শরীরে প্রোটিন সরবরাহ বাড়ায় এবং ফ্যাট বার্নিং প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে।

পোচ না সেদ্ধ ডিম—কোনটি ভালো

পোচ বা ভাজা ডিমে সাধারণত তেল বা মাখন ব্যবহার হয়, ফলে এতে বাড়তি ক্যালরি ও ফ্যাট যোগ হয়। আবার অনেক সময় নরম পোচ করলে জীবাণুর ঝুঁকি থেকে যায়, বিশেষ করে সালমোনেলা ব্যাকটেরিয়া। অন্যদিকে সেদ্ধ ডিমে কোনো বাড়তি তেল লাগে না, ফলে এটি স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ। সেদ্ধ করলে সব ভিটামিন ও প্রোটিনও অক্ষুণ্ন থাকে। শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য সেদ্ধ ডিমই সবচেয়ে ভালো; কারণ, সহজে হজম হয় ও জীবাণুর ঝুঁকি নেই। ক্রীড়াবিদেরা শক্ত সেদ্ধ ডিম খেলে প্রোটিন পুরোপুরি শোষিত হয়, যা পেশি গঠনে সহায়তা করে। তরুণেরা মাঝে মাঝে কম তেলে পোচ খেতে পারেন, তবে প্রতিদিনের অভ্যাস হিসেবে সেদ্ধ ডিমই শ্রেষ্ঠ বিকল্প।

বাচ্চা মুরগির মাংস খেলে কি রক্ত বাড়ে

আসুন বৈজ্ঞানিকভাবে দেখি। আমাদের শরীরে প্রতিদিন নতুন রক্তকণিকা তৈরি হয়। এই প্রক্রিয়াটির জন্য দরকার কয়েকটি মূল উপাদান। প্রথমত, আয়রন বা লোহা। মুরগির মাংসে থাকে ‘হিম আয়রন’, যা সরাসরি হিমোগ্লোবিন তৈরি করে এবং রক্তে অক্সিজেন বহনে সাহায্য করে। দ্বিতীয়ত, ভিটামিন বি-১২ ফলেট। এগুলো ছাড়া শরীর নতুন রক্তকণিকা তৈরি করতে পারে না। বাচ্চা মুরগির মাংসে এ দুটোই পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকে। তৃতীয়ত, উচ্চমানের প্রোটিন। আমাদের অস্থিমজ্জা রক্ত তৈরি করে, আর এই প্রোটিন সেই কাঁচামাল।

এখন প্রশ্ন হলো, শুধু মুরগির মাংস খেলেই কি রক্ত বেড়ে যাবে? উত্তর হলো না। এটি সাহায্য করবে, তবে সঠিক ফল পেতে হলে খাবারের সঙ্গে রাখতে হবে লালশাক, পালংশাক, ডাল, মাছ, কলিজা ইত্যাদি। এগুলোতে থাকে অতিরিক্ত আয়রন ও অন্যান্য ভিটামিন। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ভিটামিন সি। কারণ ভিটামিন সি শরীরে আয়রনের শোষণ বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। তাই মুরগির মাংস বা লালশাক খাওয়ার পর যদি আমরা লেবু, কমলা কিংবা আমলকী খাই, তবে আয়রন শোষণ অনেক বেশি হবে। সারকথা হলো, বাচ্চা মুরগির মাংস রক্ত তৈরির জন্য বৈজ্ঞানিকভাবে উপকারী। তবে একে একা না খেয়ে, সুষম খাদ্যের অংশ হিসেবে খেলে আমরা প্রকৃত উপকার পাব।

‘প্লাস্টিক ডিম’—গুজবে নয়, বিজ্ঞানে বিশ্বাস রাখুন

‘প্লাস্টিক ডিম’ শব্দটি আসলে একধরনের গুজব, যার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। ভারত, বাংলাদেশসহ বহু দেশের খাদ্যনিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করেছে। বাজারে প্লাস্টিক ডিম নামে কোনো জিনিস নেই। হ্যাঁ, পরীক্ষাগারে কৃত্রিমভাবে ডিম বানানো সম্ভব, কিন্তু খরচ এত বেশি যে তা বাজারে বিক্রি করা অসম্ভব। সাধারণত পুরোনো বা নষ্ট ডিম ভাঙলে কুসুম ও সাদা অংশ অস্বাভাবিক আচরণ করে, যেমন কুসুম বেশি শক্ত বা অস্বাভাবিক রঙের হয়—তখন অনেকেই ভুল করে একে প্লাস্টিক ভাবে। আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু বিভ্রান্তিকর ভিডিও প্রচারিত হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে আমাদের বাজারে যা বিক্রি হয়, সবই প্রাকৃতিক মুরগির ডিম।

ডিম দিবস শুধু ডিম খাওয়ার বার্তা দেয় না; দেয় সচেতন, স্বাস্থ্যকর ও টেকসই জীবনযাপনের আহ্বান। কারণ, ডিম স্বাস্থ্য, কৃষি, অর্থনীতি, নারীর ক্ষমতায়ন ও পরিবেশ—সব ক্ষেত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত। ডিম যেমন সাশ্রয়ী, তেমনি অপুষ্টি মোকাবিলায় কার্যকর। অথচ ভ্রান্ত ধারণার কারণে অনেকেই ডিম খাওয়া কমিয়ে দেন। বাস্তবে একটি ডিমেই রয়েছে শিশুর বিকাশ, তরুণের শক্তি, গর্ভবতী মায়ের স্বাস্থ্য ও বয়স্কের চোখ-হাড়ের সুরক্ষার উপাদান। বিশ্ব ডিম দিবস ২০২৫-এর মূল বার্তা তাই একটাই, ‘ডিমে আছে প্রোটিন, খেতে হবে প্রতিদিন।’

প্রতিদিন অন্তত একটি ডিম খাওয়া মানে নিজের ও পরিবারের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিনিয়োগ করা। এই ছোট্ট খাদ্যই পারে অপুষ্টির বিরুদ্ধে বড় পরিবর্তন আনতে, আমাদের সমাজকে আরও শক্তিশালী ও স্বাস্থ্যবান করতে।

ড. এ কে এম হুমায়ুন কবির অধ্যাপক ও গবেষক, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম। [email protected]

*মতামত লেখকের নিজস্ব