অবশেষে ক্ষমতায় আনোয়ার ইব্রাহিম, টিকবেন কত দিন?

অনেকেই মনে করছেন, নতুন প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম অবিলম্বে বড় ধরনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবেন
ছবি : রয়টার্স

মালয়েশিয়ার সাংবিধানিক রাজা সুলতান আব্দুল্লাহ ঐতিহাসিক ঐকমত্যের সরকারের নেতৃত্বে আনোয়ার ইব্রাহিমকে নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত দেওয়ার পর গত ২৩ নভেম্বর বৃহস্পতিবার তিনি দেশটির দশম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন। টানা তিন দশক ধরে প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হওয়ার জন্য আনোয়ার সংগ্রাম চালিয়েছেন এবং সমকামিতা ও দুর্নীতির দায়ে নয় বছর জেল খেটেছেন (অবশ্য প্রথম থেকেই তিনি এ অভিযোগকে মিথ্যা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করে এসেছেন)। বহু চড়াই-উতরাই শেষে ৭৫ বছর বয়সী এই রাজনীতিক সরকারের শীর্ষ পদে বসলেন।

গত ১৮ নভেম্বর সাধারণ নির্বাচনের পর কোনো দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় এবং দলগুলো নিজেদের মতো করে সমঝোতা করে সরকার গঠনে ব্যর্থ হওয়ায় দেশটিতে যে ঝুলন্ত পার্লামেন্টের সৃষ্টি হয় তা রাজনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি করে। পাঁচ দিনের অচলাবস্থার পর রাজা সব দলকে ডেকে বিশেষ বৈঠক করে আনোয়ারকে প্রধানমন্ত্রী করার ঘোষণা দেন এবং অন্য দলগুলো সে সিদ্ধান্ত মেনে নেয়। ইউনিভার্সিটি অব নটিংহাম মালয়েশিয়া এশিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউট-এর সাম্মানিক গবেষণা সহযোগী ব্রিজেট ওয়েলশ বলেছেন, ‘সবার প্রতিক্রিয়া হলো “অবশেষে তিনি পারলেন”। তিনি দীর্ঘদিন ধরে এই জায়গায় আসার জন্য লড়াই করেছেন এবং লোকেরা ধরে নিয়েছিল, তিনি আসতে পারবেন না—তবে এখন তিনি প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু তিনি এক কঠিন পরিস্থিতি পার হয়ে এক কঠিনতর পরিস্থিতিতে এসেছেন।’

মালয়েশিয়ার রাজা জোটের নেতাদের এবং তার সহযোগী সুলতানদের সঙ্গে বৈঠক করে রাজনৈতিক অচলাবস্থা সমাধানে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছেন। এর মাধ্যমে মাত্র দুই বছরের মধ্যে তৃতীয়বারের মতো রাজা ফের একজন প্রধানমন্ত্রীকে বেছে নিলেন। নির্বাচনে আনোয়ারের নেতৃত্বাধীন পাকাতান হারাপান (পিএইচ) ব্লক ৮২টি আসন পেয়েছে। সরকার গঠনে দরকার ছিল ১১২টি আসন। আনোয়ার ইব্রাহিম বলেছেন, মালয়েশিয়ার দীর্ঘতম সময় ক্ষমতাসীন থাকা জোট বারিসান ন্যাশনাল (বিএন) এবং বোর্নিও-ভিত্তিক গাবুঙ্গান পার্টি সারাওয়াক (জিপিএস) তাঁকে সমর্থন দেবে বলে অঙ্গীকার করেছে।

তিনি জানান, আরেকটি বোর্নিও ব্লকও তার সঙ্গে যোগ দেওয়ায় তিনি ২২২ আসনের পার্লামেন্টে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সমর্থন পেয়ে গেছেন। এই সংখ্যাগরিষ্ঠতার ফলে আনোয়ারের সরকার সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা পাবে। ২০০৮ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত সেখানে পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে কোনো সরকারের এ ধরনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না।

বিদায়ী অর্থমন্ত্রী টেংকু জাফরুল আবদুল আজিজ পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার মাত্র তিন দিন আগে ২০২৩ সালের বাজেট ঘোষণা করেছেন। ৩৭২০০ কোটি রিঙ্গিতের (আট হাজার কোটি ডলার) রেকর্ড পরিমাণের সে বাজেট এখনো পাশ হয়নি। এই বাজেট পাশ করা এবং বাস্তবায়ন করা আনোয়ার সরকারের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। মালয়েশিয়ার প্রাক্তন সরকারগুলো যা এত দিন নিশ্চিত করতে পারেনি, সেই বহুত্ববাদ, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠায় আনোয়ার ইব্রাহিম একটি আশার আলো বলে অনেকে মনে করে থাকেন। তাঁদের সেই প্রত্যাশা পূরণে তিনি কতটা সফল হবেন অচিরেই হয়তো জানা যাবে।

আনোয়ারের নতুন প্রশাসনের মূল কাজ হবে স্থিতিশীলতা কারণ দেশটি গত চার বছরে তিনটি তুলনামূলকভাবে স্বল্পকালীন সরকার দেখেছে। সর্বশেষ দুটি সরকার খুব পাতলা সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দেশ শাসন করেছে। তবে আনোয়ারের সরকার তার চেয়ে তুলনামূলক বেশি মজবুত হতে পারবে। ইউনিভার্সিটি অব তাসমানিয়ার এশিয়ান স্টাডিজ বিষয়ের অধ্যাপক জেমস চিন বলেছেন, ‘বেশির ভাগ মালয়েশিয়ান, বিশেষ করে পিএইচ-এর মূল সমর্থনকারী শহুরে নাগরিকেরা আনোয়ারকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করায় খুব খুশি। আনোয়ার একজন মুসলিম গণতন্ত্রী হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে অত্যন্ত সুপরিচিত এবং তার নিয়োগ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে, বিশেষ করে পশ্চিমে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হবে।’

দীর্ঘদিনের তিক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী পিএইচ এবং বিএন-এর মধ্যে নির্বাচন-পরবর্তী চুক্তির কথা বিশ্লেষকেরা অস্বীকার করেননি। তবে এই চুক্তি কত দিন টিকে থাকবে সে বিষয়ে তাঁরা তেমন কিছুই বলেননি। নিজেদের মধ্যে আবার কোন্দল লাগতে পারে এবং তার জের ধরে সরকার শিগগিরই ভেঙে পড়ার হুমকি মোকাবিলা করতে পারে। এই আশঙ্কা থাকলেও আনোয়ার ইব্রাহিমের জয় বাজারগুলোকে চাঙা করেছে। মালয়েশিয়ার শেয়ার বাজারে দুই বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় উল্লম্ফন ঘটেছে এবং যেখানে মার্কিন ডলারের বিপরীতে রিঙ্গিত মুদ্রার পতন চলছিল, সেখানে রিঙ্গিতের দাম অনেক বেশি বেড়ে গেছে।

ব্রিজেট ওয়েলশ বলছেন, ‘এটা ঠিক যে বোধগম্যভাবে আনোয়ারের নেতৃত্বে সবাই খুশি নয়, কারণ নির্বাচকমণ্ডলীর মধ্যে বড় ধরনের বিভক্তি আছে, কিন্তু আমি মনে করি, আমরা এমন একটি পরিস্থিতি পেয়েছি যেখানে অন্তত দুটি প্রধান জোট এক হয়েছে এবং এতে আমাদের অন্তত আপাতত একটি স্থিতিশীল শক্তি রয়েছে।’ তিনি বলছেন, ‘নতুন সরকারে বোর্নিও এবং অ-মালয় অধ্যুষিত অঞ্চলের মালয় সম্প্রদায়ের অন্তত ৪৫ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব আছে। সুতরাং, এটি এই সরকারের খুব ইতিবাচক দিক।’

গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী হিসাবে প্রথম সংবাদ সম্মেলনে আনোয়ার ইব্রাহিম রক্ষণশীল মালয় ভোটারদের প্রতি অন্যান্য জাতিগত সম্প্রদায়ের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করার মুদ্রাস্ফীতিতে বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন এবং প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তিনি বেতন নেবেন না বলেও অঙ্গীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের বৈধতা নিয়ে যাতে কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত না হয়, সে জন্য তাঁর নেতৃত্বের পরীক্ষা হিসেবে ১৯ ডিসেম্বর পার্লামেন্টে আস্থা ভোট করা তাঁর প্রধান এজেন্ডা হবে।

প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মুহিউদ্দিন ইয়াসিনের একটি চ্যালেঞ্জের মধ্যে আনোয়ার এই ঘোষণা দিয়েছেন। আনোয়ারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের আগে মুহিউদ্দিন ইয়াসিন বেশ জোর দিয়ে দাবি করেছিলেন, তাঁর ডানপন্থী দল পেরিকটান ন্যাশনাল (পিএন) জোট সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। তিনি একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ২২ নভেম্বর জাতীয় প্রাসাদে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তাঁকে সমর্থন করা আইন প্রণেতাদের কাছ থেকে ১১৫টি সাক্ষর সংবলিত একটি বিধিবদ্ধ ঘোষণা জমা দিয়েছেন। ধারণা করা হয়, কমপক্ষে ১০ জন বিএন আইন প্রণেতা প্রথম পিএনকে সমর্থন দিয়েছিলেন, কিন্তু পরে সে সমর্থন তাঁরা প্রত্যাহার করে নেন। এর আগে জিপিএস মুহিউদ্দিনকে সমর্থন দেওয়া থেকে পিছু হটে বলেছিল, তাঁরা রাজা যাকে নির্বাচিত করবে তাঁরা তাকে সমর্থন দেবে।

অনেকেই মনে করছেন, নতুন প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম অবিলম্বে বড় ধরনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবেন। এ ক্ষেত্রে তাঁকে তার জোটের বিস্তৃত সমর্থকদের কাছে প্রশংসনীয় একটি মন্ত্রিসভা গঠন করতে হবে। আনোয়ারের নতুন সরকারের শরিক জোট বিএন-এর গুরুত্বপূর্ণ দল ইউনাইটেড মালয়েস ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের (ইউএমএনও) ডেপুটি প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হাসানকে উপ-প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হতে পারে বলে জল্পনা চলছে। আনোয়ার এমনভাবে মন্ত্রিসভা গঠন করতে চান যাতে শরিকেরা ক্ষুব্ধ না হয়। কিন্তু সব পক্ষকে ঠিক রেখে কতক্ষণ চলা সম্ভব হবে তা বলা কঠিন।

আরও পড়ুন

বিদায়ী অর্থমন্ত্রী টেংকু জাফরুল আবদুল আজিজ পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার মাত্র তিন দিন আগে ২০২৩ সালের বাজেট ঘোষণা করেছেন। ৩৭২০০ কোটি রিঙ্গিতের (আট হাজার কোটি ডলার) রেকর্ড পরিমাণের সে বাজেট এখনো পাশ হয়নি। এই বাজেট পাশ করা এবং বাস্তবায়ন করা আনোয়ার সরকারের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।

মালয়েশিয়ার প্রাক্তন সরকারগুলো যা এত দিন নিশ্চিত করতে পারেনি, সেই বহুত্ববাদ, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠায় আনোয়ার ইব্রাহিম একটি আশার আলো বলে অনেকে মনে করে থাকেন। তাঁদের সেই প্রত্যাশা পূরণে তিনি কতটা সফল হবেন অচিরেই হয়তো জানা যাবে।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

  • নিল বোয়ি এশিয়া টাইমসের সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া সংবাদদাতা