সেই ইউএনওকে পুরস্কার না দিয়ে তিরস্কার কেন

ঘটনাটি কিছুদিন আগের হলেও রেশ কাটছে না। শুরুটা হয় এভাবে, ২০২২ সালের বৃক্ষরোপণে প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় পুরস্কার পেতে আবেদন করেছিলেন চট্টগ্রামের হাটহাজারীর তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। তথ্যাদি বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে নেওয়া।

তিনি হাটহাজারী পৌরসভার রাস্তার পার্শ্বস্থ বেদখল জমি উদ্ধার করে সেখানে নিজ অর্থ ব্যয়ে ব্যাপক বনায়ন করেন। বনায়ন করেন বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের খালি জমিতে। 

এ বিষয়ে ব্যক্তিগত ক্যাটাগরিতে পুরস্কার দেওয়ার বিধান রয়েছে বলে জানা যায়। তবে তিনি ও তাঁর স্ত্রীর যৌথ আবেদনটি বিবেচনার জন্য সুপারিশ করে সেই ইউএনওর সভাপতিত্বে গঠিত উপজেলা কমিটি। পাঠানো হয় জেলা কমিটিতে।

ধরে নেওয়া যায় ইউএনও নিজে সভাপতি হয়ে তার আবেদন সুপারিশ করতে পারেন না। এতে স্বার্থের সংঘাতের প্রশ্ন জড়িত।

তবে জেলা কমিটি হাটহাজারীতে ব্যাপক বনায়ন–সম্পর্কিত পুরস্কারটি উপজেলা পরিষদকে দেওয়ার সুপারিশ করে। এর সঙ্গে একমত হয়ে বিভাগীয় কমিটি পাঠায় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত মন্ত্রণালয়ে। 

জাতীয় কমিটি সব সুপারিশের সঙ্গে একমত হয়ে হাটহাজারী উপজেলা পরিষদকে এ পুরস্কার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। পুরস্কার গ্রহণ করেন পরিষদের চেয়ারম্যান। তবে এ ধরনের বৃক্ষরোপণের জন্য উপজেলা পরিষদের কোনো সিদ্ধান্ত ও বরাদ্দ ছিল না বলে নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানা যায়। 

হয়তোবা কিছুটা হতাশা থেকে বৃক্ষরোপণকারী ইউএনও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি দেন। মন্ত্রণালয় বিষয়টি তার অসদাচরণ বিবেচনায় বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করে। রুজু হয় বিভাগীয় মামলা। তদন্ত কার্যক্রম চলে প্রায় ১৪ মাস। এর অনেক আগেই সেই ইউএনও বদলি হয়ে গেছেন অন্যত্র।

এ বছরের এপ্রিলের শুরুতে একটি সরকারি আদেশে বলা হয়, ‘...হীন ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল না হওয়ায় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের যথাযথ ও আইনসম্মত কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। এর মাধ্যমে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছেন।’ 

আরও পড়ুন

এরপরে সে প্রজ্ঞাপনেই বলা হয়েছে, ‘...এর বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। তবে তিনি বেশ কয়েকটি বাগান সৃজন করে জনস্বার্থের জন্য ইতিবাচক কাজ করেছেন বিধায় তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হলেও তাঁকে সর্বনিম্ন তিরস্কার দণ্ড প্রদান সমীচীন বলে প্রতীয়মান হয়।’

আলোচিত বনায়ন ও পুরস্কার প্রদানসংক্রান্ত বিষয়টি মাঠ প্রশাসন সম্পর্কিত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা সে সময়ে ইউএনও ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় কার্যক্রম গ্রহণের আগে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মতামত নেওয়া প্রতিষ্ঠিত বিধান। এ ক্ষেত্রে তাঁদের মতামত নেওয়া হয়েছে বলে মনে হয় না।

সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮ অনুসারে তিরস্কারও দণ্ড। এটা আরোপের ফলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা পরবর্তী পদোন্নতির ক্ষেত্রে ন্যূনতম একবার বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আমরা জানি সরকারি কর্মচারীদের নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি, দণ্ড সবকিছুই জনস্বার্থে করা হয়।

সরকারের বিভিন্ন বিভাগ, সংস্থা ও দপ্তরে দুর্নীতির প্রকোপ বেড়েছে, সংবাদমাধ্যম সূত্রে তা জানা যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অসংযত ও সৌজন্যবর্জিত আচরণের অভিযোগও আসছে। তবে এ ধরনের কর্মকর্তা–কর্মচারীরা অনেক ক্ষেত্রেই আইন ও বিধিবিধানের আওতার বাইরে থাকছেন। দুঃখজনকভাবে এমনটাও লক্ষ করা যায়।

এখানে যে কর্মকর্তাকে সাজা দেওয়া হয়েছে, সে আদেশে উল্লেখ রয়েছে তিনি বেশ কয়েকটি বাগান সৃজন করে জনস্বার্থের জন্য ইতিবাচক কাজ করেছেন। হতে পারে পদ্ধতিগত কোনো ত্রুটি কোথাও হয়েছে। এমনটা হলেও জনপ্রশাসনসচিব বিভাগীয় মামলা দায়েরের আগে নিয়ম মোতাবেক শুনানিকালে মৌখিকভাবে মৃদু তিরস্কার করে ব্যাপারটা নিষ্পত্তি করলেই চলত। বাগান সৃজন করা হয়নি এমন অভিযোগ তো কোনো পক্ষের নেই। 

ইউএনও উপজেলা পরিষদে প্রেষণে নিয়োজিত কর্মকর্তা হলেও তাঁর একটি সরকার স্বীকৃত পৃথক সত্তা আছে। নিশ্চিতভাবে জানা যায়, সেই ইউএনও নিজ উদ্যোগেই বাগানগুলো সৃজন করেছিলেন। বদলিযোগ্য চাকরির কর্মকর্তারা কেউ কেউ এমনটা করলেও মূলত সুফলভোগী হন জনগণ। তিনি সেসব গাছের কোনো কিছুই ভোগদখল করেননি, করতে পারবেনও না। বরং পৌরসভার বেদখল জমি দখলদারদের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। তিনি উপজেলাটিতে বঙ্গবন্ধু হেরিটেজ ঘোষিত হালদা নদীকে সুরক্ষার জন্য প্রশংসনীয় অবদান রাখেন। একটি দুর্গম ত্রিপুরাপল্লিকে নিয়ে আসেন উন্নয়নের মূলধারায়। 

এ ধরনের কর্মকর্তাদের সামান্য পদ্ধতিগত বিচ্যুতি বড় করে দেখে বৃহৎ উদ্যমকে উপেক্ষা করা হলে মাঠ প্রশাসনে ভুল বার্তা যাবে। সরকারি কর্মকর্তাদের উদ্যম নেওয়ার পেছনে কিছু ঝুঁকি থাকে। এসব সিদ্ধান্তে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সে ধরনের স্বার্থান্বেষী লোকেরও অভাব নেই আমাদের সমাজে। তবে যাঁরা এসব কর্মকর্তাকে দেবেন নিরাপত্তা ও সাধুবাদ, তাঁদের এ বিষয়ে আরও উদার হওয়া জরুরি ছিল। গোটা বিষয়টিতে ভিন্নরূপই আমরা দেখলাম।

আরও পড়ুন

দেশের এখন আগের যেকোনো সময়কার তুলনায় প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা বেতন–ভাতাদিসহ অন্যান্য সুবিধা ভোগ করছেন অনেক বেশি। এটা অবশ্যই যৌক্তিক।

আমাদের নিকট প্রতিবেশী দেশের গড়পড়তা মাথাপিছু আয়ের তুলনায় আমাদের আয় বেশি এমনটাই সরকারি তথ্য বলে। অন্যদিকে দেশের সব স্তরের কর্মচারীদের বেতন–ভাতাদি তাঁদের তুলনায় অনেক কম। হয়তোবা সীমাবদ্ধতা রয়েছে রাজকোষের। তা–ও সম্ভব হলে এসব সুবিধা আরও বাড়ানোর দাবি রাখে। 

তবে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ, সংস্থা ও দপ্তরে দুর্নীতির প্রকোপ বেড়েছে, সংবাদমাধ্যম সূত্রে তা জানা যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অসংযত ও সৌজন্যবর্জিত আচরণের অভিযোগও আসছে। তবে এ ধরনের কর্মকর্তা–কর্মচারীরা অনেক ক্ষেত্রেই আইন ও বিধিবিধানের আওতার বাইরে থাকছেন। দুঃখজনকভাবে এমনটাও লক্ষ করা যায়।

বিচারহীনতার সংস্কৃতি জনপ্রশাসনের অনেক জায়গায় বিরাজ করছে। কয়েকটি ক্ষেত্রে কিছু শাস্তি দেওয়া হয় বটে। কোনো কোনোটি অজ্ঞাত কারণে আবার মওকুফও হয়ে যায়। দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান ও তদন্ত করতে অভাবনীয় বিলম্ব হয়; অভিযোগপত্র যদি দাখিল করাও হয়, অভিযুক্ত ও সাক্ষীদের অনেকেই থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। 

প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের কাজ বিবেচনায় পুরস্কার ও শাস্তি দুটোই দৃশ্যমানভাবে থাকা উচিত বলে মনে করা হয়। তবে আইন ও বিধিবিধান থাকলেও সেগুলো যথাযথভাবে প্রতিপালন করা হয় না। কিছুকাল আগে দেশের উত্তরাঞ্চলে একজন নারী ইউএনও সরকারি বাসভবনে রাতের বেলা দস্যু দ্বারা আক্রান্ত হন। ইউএনও মস্তকে আঘাত পান গুরুতর। সহমর্মিতায় সোচ্চার হন সারা দেশের সরকারি কর্মচারীরা।

হেলিকপ্টারে ঢাকায় এনে তাঁর সুচিকিৎসা এবং দেশের সব ইউএনওর সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার প্রশংসনীয় ব্যবস্থা করা হয়। সে ইউএনও কিছুটা সুস্থ হলে তাঁর পক্ষ থেকে সে বাসভবনের স্টিলের আলমারি ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের উপস্থিতিতে খুলে তাঁর সহোদর বিশাল অঙ্কের গচ্ছিত টাকা নিয়ে যান। ঘটনাটি গণমাধ্যমে এসেছিল। 

বড় ধরনের সন্দেহের সূচনা হয় টাকার যথাযথ উৎস সম্পর্কে। কিন্তু বিষয়টির গভীরে আদৌ যাওয়া হয়নি, গেলেও অজ্ঞাত রয়ে যায় জনগণের কাছে। অবশ্যই একটি তদন্তের মাধ্যমে বিষয়টি স্পষ্টীকরণ ও যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল। এসব বিষয় অন্যায়কারীদের সবুজসংকেত দেবে।

অবশ্য অনেক ক্ষেত্রে এমনটা ঘটে চলছে। আর দুর্ভাগ্যবশত বিপরীতটা ঘটল হাটহাজারীর আলোচিত সাবেক ইউএনওর ভাগ্যে। এ কর্মকর্তা পেয়েছেন শুদ্ধাচার পুরস্কার ও জনপ্রশাসন পুরস্কার। অবশ্য পুরস্কার পাওয়া কর্মকর্তারও অনেক সময় ব্যাপক অনিয়মের সঙ্গে জড়িত হওয়ার নজির আছে। ফলে এসব পদক বা পুরস্কারও হারিয়ে ফেলছে মর্যাদা ও গুরুত্ব। তবে এই কর্মকর্তা স্থানীয় জনগণের কাছে এখনো অতি প্রশংসনীয়। আলোচিত বনায়নগুলো তাঁরই কাজ। কোনো কারণে তাঁকে পুরস্কৃত করা না গেলে তিরস্কার করে দমিয়ে দেওয়াও জনপ্রশাসনকে ভুল বার্তা দিল। 

আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব

[email protected]