নারীর হাতে ক্ষমতা মানেই শক্তিশালী পরিবার, শক্তিশালী বাংলাদেশ। বাংলাদেশের লাখ লাখ পরিবারের কাছে দারিদ্র্য কোনো পরিসংখ্যান নয়, এটি প্রতিদিনের দুশ্চিন্তা। আজ রান্নার হাঁড়িতে চাল থাকবে তো? সন্তানের বই-খাতা কেনা যাবে তো? হঠাৎ কেউ অসুস্থ হলে চিকিৎসার খরচ আসবে কোথা থেকে?
এই প্রশ্নগুলোর ভার সবচেয়ে বেশি এসে পড়ে নারীদের ওপর। ঝালকাঠির একটি গ্রামের রাশিদা বেগমের গল্পই তা বলে দেয়। স্বামীর দিনমজুরির আয়ে সংসার চলে কোনোমতে। একদিন ভাত আর ডাল ছাড়া আর কিছু রান্না করতে না পারায় তাকে স্বামীর রাগ, গালাগাল আর অপমান সহ্য করতে হয়। খাবারের অভাব তখন শুধু ক্ষুধা নয়, তা হয়ে ওঠে অপমান আর সহিংসতার কারণ।
রাশিদার মতো অসংখ্য নারী নীরবে নিজের খাবার কমান, নিজের প্রয়োজন পেছনে সরিয়ে রাখেন, তবু সংসারের হাল শক্ত করে ধরে রাখেন। অথচ দুঃখজনক বাস্তবতা হলো দীর্ঘদিন ধরে আমাদের সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থায় নারীদের দেখা হয়েছে কেবল সহায়তার গ্রহীতা হিসেবে, সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী বা অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে নয়। এই বাস্তবতার পরিবর্তন ঘটাতেই ফ্যামিলি কার্ডের প্রস্তাব।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) মনে করে, দারিদ্র্য দূর করতে হলে রাষ্ট্রকে সরাসরি নারীর পাশে দাঁড়াতে হবে। কারণ, নারী শক্তিশালী হলে পরিবার শক্তিশালী হয়, আর পরিবার শক্তিশালী হলে রাষ্ট্র শক্তিশালী হয়। এই সত্য বহু আগেই উচ্চারণ করেছিলেন নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাকে সমৃদ্ধ জাতি উপহার দেব।’
তারেক রহমান তাঁর বিভিন্ন জনসভা ও বক্তব্যে বারবার এই দর্শনের আধুনিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন, শুধু শিক্ষা নয়, নারীর হাতে খাদ্যনিরাপত্তা, সঞ্চয় ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের ক্ষমতা তুলে না দিলে দারিদ্র্যের চক্র ভাঙা যাবে না। এই বিশ্বাস থেকেই তিনি পরিবারভিত্তিক সামাজিক সুরক্ষার ধারণা তুলে ধরেছেন এবং ফ্যামিলি কার্ডকে নারীর ক্ষমতায়নের কেন্দ্রীয় হাতিয়ার হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
এই দৃষ্টিভঙ্গির বাস্তব রূপ হলো ইলেকট্রনিক ফ্যামিলি কার্ড। যা একটি আধুনিক, মর্যাদাভিত্তিক ও নারীকেন্দ্রিক সামাজিক সুরক্ষা উদ্যোগ। এটি ২০২৩ সালে তারেক রহমান ঘোষিত রাষ্ট্র মেরামতের ৩১ দফা রূপরেখার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। এই কর্মসূচির মাধ্যমে তিনি শুধু সহায়তা নয়; বরং নারীদের আত্মনির্ভরতার পথে এগিয়ে নেওয়ার একটি দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক অঙ্গীকার তুলে ধরেছেন।
ফ্যামিলি কার্ডের আওতায় প্রতিটি পরিবার মাসে দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা সমমূল্যের খাদ্যসহায়তা পাবে। এই সহায়তা নগদ অর্থ হিসেবে অথবা নির্দিষ্ট খাদ্যপণ্য, যেমন চাল, আটা, ডাল ও ভোজ্যতেল হিসেবে দেওয়া হতে পারে। এতে একটি পরিবারের ন্যূনতম খাদ্য চাহিদার বড় অংশ নিশ্চিত হবে। খাবারের পেছনে মাসিক ব্যয় কমে গেলে পরিবার কিছুটা স্বস্তি পাবে, আর সেই স্বস্তির কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবেন নারী।
এই কর্মসূচি হঠাৎ সারা দেশে চাপিয়ে দেওয়া হবে না। স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে প্রতিটি বিভাগে একটি করে উপজেলা নিয়ে পাইলট প্রকল্প চালু করা হবে। সেখানে দেখা হবে—মানুষ নগদ সহায়তা বেশি পছন্দ করছে নাকি খাদ্যসহায়তা; কোন পদ্ধতিতে দুর্নীতি কম, কোনটিতে প্রশাসনিক ব্যয় কম।
এই উদ্ভাবনী সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির অর্থায়ন করা হবে বর্তমান রাজস্ব ও ব্যয়ের কাঠামোর মধ্যেই, বরাদ্দ ও ব্যয় ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বাড়িয়ে এবং দুর্নীতি ও অপচয় কমানোর মাধ্যমে প্রয়োজনীয় রাজস্ব সাশ্রয় সৃষ্টি করে। একই সঙ্গে প্রাথমিক বাস্তবায়ন ও সম্প্রসারণ পর্যায়ে বিশ্বব্যাংক ও এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের মতো উন্নয়ন সহযোগীদের কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা গ্রহণের পরিকল্পনাও রয়েছে। এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কর্মসূচিটি ধাপে ধাপে সম্প্রসারণ করা হবে, প্রথমে ৫০ লাখ পরিবারে, পরে পর্যায়ক্রমে সারা দেশে।
বিশ্বের নানা দেশে গবেষণায় প্রমাণিত—নারীর হাতে সরাসরি সহায়তা দিলে তার সুফল শুধু নারীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। তা পৌঁছে যায় সন্তানের শিক্ষা, পরিবারের পুষ্টি এবং সামগ্রিক উৎপাদনশীলতায়। নারী সহায়তা পেলে তা অপচয় হয় না; বরং ভবিষ্যতের জন্য বিনিয়োগ হয়।
ফ্যামিলি কার্ডের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হলো এর সর্বজনীন বা ব্ল্যাঙ্কেট–পদ্ধতি। এখানে কারও নাম বাছাই করে তালিকায় তোলার প্রয়োজন হবে না। কারণ, অভিজ্ঞতা বলছে—যেখানে বাছাই থাকে, সেখানে পক্ষপাত থাকে, দুর্নীতি থাকে, বাদ পড়ার ভয় থাকে। ফ্যামিলি কার্ড সবার জন্য। এতে কাউকে বেঁচে থাকার জন্য রাজনৈতিক পরিচয়, তদবির বা সুপারিশ খুঁজতে হবে না। অধিকার যখন সর্বজনীন হয়, তখন মর্যাদাও সর্বজনীন হয়।
এই কার্ড দেওয়া হবে পরিবারের প্রাপ্তবয়স্ক নারী সদস্যের নামে। এটি একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত। কারণ, নারীই পরিবারের খরচের সবচেয়ে বাস্তব ও দায়িত্বশীল ব্যবস্থাপক। মাসে প্রায় দুই হাজার টাকা সাশ্রয় হলে, সেই অর্থ জমিয়ে নারী নিজেই ছোট উদ্যোগ নিতে পারবেন—হাঁস-মুরগি পালন, সবজি চাষ, সেলাই কাজ, ঘরে তৈরি খাবার বা ক্ষুদ্র ব্যবসা। অর্থাৎ ফ্যামিলি কার্ড শুধু সহায়তা নয়; এটি আত্মনির্ভরতার বীজ।
বাংলাদেশ এর আগেও এমন সাহসী উদ্যোগ দেখেছে। ১৯৯২-৯৩ সালে খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষা কর্মসূচি চালু হয়েছিল। সেই উদ্যোগ খাদ্যের সঙ্গে শিক্ষাকে যুক্ত করে লাখো শিশুকে, বিশেষ করে মেয়েদের স্কুলে ফিরিয়ে এনেছিল। আজ ফ্যামিলি কার্ড সেই ঐতিহ্যের আধুনিক রূপ। তখন শিক্ষা দিয়ে কন্যাশিশুকে এগিয়ে নেওয়া হয়েছিল, আজ খাদ্যনিরাপত্তা ও সঞ্চয়ের মাধ্যমে প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের দারিদ্র্য থেকে বের করে আনার চেষ্টা।
বিশ্বের নানা দেশে গবেষণায় প্রমাণিত—নারীর হাতে সরাসরি সহায়তা দিলে তার সুফল শুধু নারীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। তা পৌঁছে যায় সন্তানের শিক্ষা, পরিবারের পুষ্টি এবং সামগ্রিক উৎপাদনশীলতায়। নারী সহায়তা পেলে তা অপচয় হয় না; বরং ভবিষ্যতের জন্য বিনিয়োগ হয়।
ফ্যামিলি কার্ড তাই কোনো দয়ার কর্মসূচি নয়। এটি একটি রাজনৈতিক ও নৈতিক অবস্থান। এটি বলে নারী করুণার বস্তু নয়, উন্নয়নের অংশীদার। এটি বলে দারিদ্র্য দূর করা মানে দান নয়, মানুষের সক্ষমতায় বিনিয়োগ।
আজকের কঠিন অর্থনৈতিক বাস্তবতায় ফ্যামিলি কার্ড একটি বাস্তবসম্মত, স্বচ্ছ ও সাহসী পথনির্দেশনা। এটি নারীর হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়, পরিবারকে শক্ত করে এবং রাষ্ট্রকে স্থিতিশীল করে।
ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে একটি নতুন সামাজিক চুক্তির প্রস্তাব আসছে, যেখানে নারীর ক্ষমতায়নই হবে আত্মনির্ভরশীল, মর্যাদাপূর্ণ ও ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশের ভিত্তি।
ড. জিয়াউদ্দিন হায়দার বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা
*মতামত লেখকের নিজস্ব