আলুর বদলে এখন কী খাবে মানুষ

চালের দাম বেড়ে গেলে বলা হয় ‘বেশি করে আলু খান, ভাতের ওপর চাপ কমান’। আলুর দাম মোটা চালের দামকে ছাড়িয়ে গেছে অনেক আগেই। সম্প্রতি চিকন চালের দামকেও ছাড়িয়ে গেল। টিসিবির তথ্য অনুসারে, মোটা চালের দর ৪৮-৫০ আর চিকন চালের দর ৬০-৭০ টাকা।

অন্যদিকে প্রথম আলোর সংবাদ, বাজারে নতুন আলু উঠলেও নতুন ও পুরোনো আলুর কেজি পড়ছে ৮০ টাকা। এখন আলুর ওপর চাপ কমাতে কী খেতে বলা হবে? সস্তা খাদ্য হিসেবে বিবেচিত আলুও কি তাহলে দরিদ্র মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেল!

আলুর বাজার সেপ্টেম্বর মাস থেকেই নিয়ন্ত্রণহীন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আলুর দাম বেঁধে দিলেও তাতে কোনো কাজ হয়নি। একপর্যায়ে গত ৩০ অক্টোবর আলু আমদানির অনুমতি দেয় সরকার।

প্রথম আলোর তথ্য অনুসারে, ৩ লাখ ৬ হাজার টন আমদানির অনুমতির বিপরীতে ডিসেম্বর পর্যন্ত আলু এসেছে মাত্র ৬০ হাজার টন, যা আলুর বাজারে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি।

সরকার যদি আলুর উদ্বৃত্ত উৎপাদনের বিভ্রমে আটকে না থেকে আলুর উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নিত, যদি কৃষকের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্যে আলু কিনে হিমাগারে সংরক্ষণ করে সংকটের সময় ন্যায্যমূল্যে বিক্রির ব্যবস্থা করত, তাহলে আজ আলুর দাম নিয়ে এই অরাজকতা চলতে পারত না।

অথচ গত ফেব্রুয়ারি মাসে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক এ বছর থেকেই রাশিয়ায় আলু রপ্তানির ঘোষণা দিয়েছিলেন। প্রশ্ন হলো, দেশে রপ্তানি করার মতো বাড়তি আলু উৎপাদিত হলে আলুর দাম রেকর্ড পরিমাণ বাড়ল কেন, আলু আমদানিই–বা কেন করতে হলো!

আসলে কৃষকের হাতে আলু থাকে মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত। এ সময় আলুর দাম সাধারণত বাড়ে না। আলুর দাম বাড়তে শুরু করে কৃষকের হাত থেকে আলু যখন ব্যবসায়ীদের হাতে যায়, তখন থেকে, অর্থাৎ জুলাই মাস থেকে। মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত কৃষকের কাছ থেকে ব্যবসায়ীরা যে আলু ১০-১২ টাকা কেজিতে ক্রয় করেন, সেই আলুই কিছুদিন হিমাগারে রাখার পর বহুগুণ বেশি দামে বিক্রি করেন।

৫০ কেজির এক বস্তা আলু হিমাগারে রাখার খরচ ৩০০ টাকা, বস্তার দাম ৫৫ টাকা। অর্থাৎ, হিমাগারে রাখার জন্য কেজিপ্রতি খরচ ৭ টাকা ১০ পয়সা। এর সঙ্গে শ্রমিক ও পরিবহন খরচ কেজিপ্রতি ২ টাকা ধরলে ব্যবসায়ীদের খরচ পড়ে সব মিলিয়ে প্রতি কেজিতে ২০ টাকা। এর ফলে পাইকারি পর্যায়ে এই আলু ২২ টাকা এবং খুচরা পর্যায়ে ২৫ টাকা দরে বিক্রি হওয়া উচিত। কিন্তু জুনের পর আলু যখন কৃষকের হাতে থাকে না, তখন ব্যবসায়ীরা সুযোগ বুঝে চাহিদার তুলনায় কম করে আলু বাজারে ছেড়ে আলুর সংকট তৈরি করেন এবং অনেক বেশি দামে বিক্রি করেন।

অবশ্য ব্যবসায়ীরা চাইলেই সব সময় এই কারসাজি করতে পারেন না। বাজার অর্থনীতিতে যখন পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিকের চেয়ে কম হয়, কারসাজির সুযোগ তখন সবচেয়ে বেশি থাকে। সরকার রেকর্ড পরিমাণ আলু উৎপাদন হওয়ার কথা বললেও হিমাগারমালিকেরা বলছেন, গত বছরের তুলনায় কম পরিমাণ আলু এসেছে হিমাগারে।

প্রথম আলো জানাচ্ছে, কৃষি মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, দেশে এ বছর আলু উৎপাদিত হয়েছে যাথাক্রমে ১ কোটি ৪ লাখ টন এবং ১ কোটি ৯ লাখ টন। অথচ হিমাগার সমিতির হিসাবে, এর পরিমাণ ৮০ থেকে ৮৫ লাখ টনের বেশি নয়। আলুর উৎপাদন নিয়ে এই রকম একটি ধোঁয়াটে পরিস্থিতি এবং বাজারে আলুর সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে সরকারের নিষ্ক্রিয়তাই কিন্তু আলুর বাজারে কারসাজির সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।

অবশ্য দেশে আলুর দাম নিয়ে এ ধরনের কারসাজি নতুন নয়। ২০২০ সালেও আমরা আলুর দাম নিয়ে ব্যাপক কারসাজি হতে দেখেছি। আলুর দাম ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে বাড়তে শুরু করে এবং খুচরা বাজারে প্রতি কেজি আলুর দাম তখন ৫০ টাকায় পৌঁছায়।

আরও পড়ুন

সেই সময় ডেইলি স্টার–এ সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল যে হিমাগারে থাকা আলুর মালিকানা, যা সাধারণত বছরে চারবার হাতবদল হয়, ২০২০ সালে সেই মালিকানা আরও ঘন ঘন পরিবর্তিত হয়েছিল।

মূলত, আলুর বাজারের সংকটকে কাজে লাগিয়ে অতি মুনাফা লাভের আশা থেকেই হিমাগারে মজুত আলুর মালিকানার ঘন ঘন হাতবদল হয়, যা আলুর বাজারকে আরও অস্থির করে তোলে।

আলুর মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের একদল বিজ্ঞানীর করা ‘ডিমান্ড, সাপ্লাই অ্যান্ড রিজনস ফর প্রাইস হাইক অব পটেটো ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে, কৃষকেরা উৎপাদিত আলুর ৯০ শতাংশই এপ্রিলের মধ্যে বিক্রি করে দেন। অন্যদিকে হিমাগারে সংরক্ষিত আলু জুন থেকে বাজারে ছাড়া শুরু হয়। লক্ষণীয় বিষয় হলো, আলুর সর্বনিম্ন বিক্রয়মূল্য ছিল ২০২০ সালের মার্চ ও এপ্রিলে, যখন আলু কৃষকের হাতে ছিল; আর সর্বোচ্চ বিক্রয়মূল্য ছিল নভেম্বরে, যখন আলু হিমাগার ব্যবসায়ীদের হাতে ছিল।

আরও পড়ুন

ওই গবেষণায় আলুর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পেছনে যে কারণগুলোকে দায়ী করা হয়, সেগুলো হলো আলুর উৎপাদন কম হওয়া, হিমাগারে থাকা আলুর মালিকানার ঘন ঘন হাতবদল, ভবিষ্যতে উচ্চ মূল্যের প্রত্যাশায় হিমাগারে আলুর মজুত ধরে রাখা, আলুর বাজারের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকা ইত্যাদি।

আলুর দাম স্থিতিশীল করার জন্য গবেষকেরা যেসব সুপারিশ করেছিলেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কৃষি মূল্য কমিশন গঠন করে আলুর সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন দাম নির্ধারণ, দেশে আলুর প্রকৃত উৎপাদন, চাহিদা, সরবরাহ ও মূল্যবিষয়ক তথ্য নিয়ে বিদ্যমান অস্বচ্ছতা দূর করা এবং আলুর দামের ওপর নজর রাখা ও সরকার কর্তৃক হিমাগার থেকে পর্যাপ্ত আলু ছাড়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা ইত্যাদি।

সুতরাং সরকার যদি আলুর উদ্বৃত্ত উৎপাদনের বিভ্রমে আটকে না থেকে আলুর উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নিত, যদি কৃষকের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্যে আলু কিনে হিমাগারে সংরক্ষণ করে সংকটের সময় ন্যায্যমূল্যে বিক্রির ব্যবস্থা করত, তাহলে আজ আলুর দাম নিয়ে এই অরাজকতা চলতে পারত না। সেপ্টেম্বর মাস থেকে আলুর বাজারের নিয়ন্ত্রণ হিমাগারভিত্তিক সিন্ডিকেটের হাতে চলে গেলেও সরকার সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার জন্য কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেনি, যা থেকে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, সরকার নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে আদৌ আন্তরিক কি না।

কল্লোল মোস্তফা বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক