ইউরোপের সবচেয়ে সামরিক শক্তিধর দেশ হবে পোল্যান্ড?

ইউক্রেন যুদ্ধের পর সামরিক খাতে বিপুল ব্যয় বাড়িয়েছে পোল্যান্ড
ছবি: এএফপি

পোল্যান্ডের সামরিক বাহিনী ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিধর বাহিনী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে—এই ধরনের একটি ধারণা জনমনে দিনকে দিন জোরালো হচ্ছে। পোল্যান্ডের ক্ষমতাসীন ল অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি (পিআইএস) এই ধারণাকে দেশের মধ্যে ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করতে ছাড়ে না। দেশের বাইরেও এই কথা বেশি বেশি শোনা যাচ্ছে। কিন্তু আসলেই কি তাই?

পিআইএস সরকারের নজিরবিহীন সমরাস্ত্র ক্রয় এবং ২০৩৫ সালের মধ্যে দেশটির সেনাসংখ্যা তিন লাখে উন্নীত করার পরিকল্পনা এই ধারণাকে জোরালো করেছে। নতুন জাতীয় প্রতিরক্ষা আইন অনুযায়ী, এ বছর পোল্যান্ডকে জিডিপির ৩ শতাংশ পরিমাণ অর্থ সামরিক খাতে খরচ করতে হবে। ন্যাটো সদস্যদের সামরিক ব্যয় জিডিপির যত শতাংশ হওয়া উচিত বলে সাধারণত মনে করা হয়, এই ব্যয় তার চেয়ে বেশি।

পোল্যান্ড সরকারের কার্যত প্রধান নির্বাহী জারস্লাভ কাচজিনস্কি (যিনি এর আগে উপপ্রধানমন্ত্রী ছিলেন) প্রকাশ্যে বলেছেন, দীর্ঘ মেয়াদে তিনি এই ব্যয়কে জিডিপির ৫ শতাংশ পরিমাণে নিয়ে যাবেন।

অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, প্রতিবেশী দেশ ইউক্রেনে রাশিয়ার সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া হিসেবে পোল্যান্ড তার সামরিক শক্তি বাড়াচ্ছে। দেশটির নিয়মিত সেনাসদস্য আছে ১ লাখ ২৮ হাজার এবং সীমান্তরক্ষী আছে ৩৬ হাজার। এ ছাড়া নিজের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা উন্নত করতে ও সরবরাহব্যবস্থাকে সুরক্ষিত করতে তারা উন্নত সামরিক সরঞ্জাম কিনছে।

পোল্যান্ড ইউক্রেনকে ইতিমধ্যে এত বেশি বিমান, ট্যাংক, বন্দুক, যুদ্ধযান ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম দিয়েছে যে দ্রুত যদি তারা নতুন করে অস্ত্র না কেনে, তাহলে তাদের প্রতিরক্ষা সামর্থ্য অর্ধেকে নেমে আসবে।

১৯৯০ সালে তৃতীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে পোল্যান্ডের প্রতিটি সরকারই সামরিক খাতে একই তালে ব্যয় করে যাচ্ছিল। কিন্তু পিআইএস সরকার গঠনের পর থেকে তারা রাষ্ট্রীয় বাজেটের বাইরের তহবিল থেকে অস্ত্র কেনায় ব্যয় করে আসছে; এমনকি তারা যুদ্ধ সরঞ্জাম কিনতে ঋণও নিচ্ছে।

পোল্যান্ড মূলত দুটি সরবরাহকারী দেশের ওপর নির্ভর করে থাকে। এর একটি হলো যুক্তরাষ্ট্র এবং অপরটি দক্ষিণ কোরিয়া; যাদের অস্ত্র পোল্যান্ডের কাছে বিক্রির জন্য তৈরিই থাকে।

পরিকল্পনা অনুযায়ী, সামরিক শক্তি বাড়ানোর জন্য পোল্যান্ডের দরকার ১ হাজার ৬৮২টি ট্যাংক, ৩ হাজার ৭৪টি ইনফ্যান্ট্রি যুদ্ধযান ও সেনাবাহী সাঁজোয়া যান, ১ হাজার ৮টি কামান ও ৬৪৮টি মাল্টিপ্রপেল্ড রকেট লঞ্চার।

আরও পড়ুন

সাম্প্রতিক একটি হিসাব অনুযায়ী, পোল্যান্ডের হাতে ৪৮টি এফ-১৬ জঙ্গি বিমান, প্রায় এক ডজন সোভিয়েত মিগ-২৯ বিমান (যেগুলো ইউক্রেনে পাঠানো হয়েছে) এবং ডজনখানেক সু-২২ বিমান (এগুলোও একটা একটা করে মেরামত-অযোগ্য হয়ে পড়ছে) আছে। এই জায়গা থেকে দেশটি তার হাতে সব মিলিয়ে কমপক্ষে ১৬০টি অভিযান-সক্ষম যুদ্ধবিমান রাখতে চায়।

সেই লক্ষ্যে দেশটি ৩২টি এফ-৩৫এ মাল্টিরোল বিমান ও ৪৮টি এফএ-৫০ হালকা যুদ্ধ-প্রশিক্ষণ বিমান কিনেছে এবং ৯৬টি এএইচ-৬৪ই অ্যাপাচি হেলিকপ্টার কেনার ক্রয়াদেশ দিয়েছে। পোল্যান্ডের কাছে ২৩৩টি লেপার্ড২ ট্যাংক থাকলেও দেশটি ৩৬৬টি এম১ অ্যাবরামস ট্যাংক এবং ১৮০টি কে২ ট্যাংক অর্ডার করেছে। দেশটির আরও ৮২০টি কোরিয়ান কে২ /কে২ পিএল ট্যাংক অর্ডার করার এবং ১৫৯৯টি ইউনিটে সশস্ত্র ডিভিশনকে উন্নীত করার পরিকল্পনা আছে। এর সঙ্গে যুক্ত হবে ২১২টি অতিরিক্ত কে৯ এ ১ ও ৪৬০টি কে৯ এ১ /কে৯ পিএল ট্যাংক। এ ছাড়া প্রচুর বিস্ফোরক ও রকেট লঞ্চারের অর্ডার করেছে দেশটি।

যদিও পোল্যান্ড তার সামরিক বাহিনীকে সম্প্রসারিত ও আধুনিক করতে একটি চিত্তাকর্ষক উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা নিয়েছে, কিন্তু দেশটি এসব অস্ত্র ব্যবহার করতে এখনো সম্পূর্ণরূপে নিজেকে প্রস্তুত করে উঠতে পারেনি। আসলে সরকার কীভাবে এই প্রাথমিক কেনাকাটা সারবে বা আরও দেড় লাখ সেনার তালিকাভুক্তি ও প্রশিক্ষণের অর্থের জোগান দেবে, তা–ও স্পষ্ট নয়।

ফলে সামরিকভাবে পোল্যান্ড যে ঠাটবাট দেখাচ্ছে, তার ভিত্তি খুব মজবুত নয়।

কাচজিনস্কি ও তাঁর জার্মানবিরোধী ও পশ্চিমাবিরোধী জনতুষ্টিবাদী সমর্থকেরা পোল্যান্ডের প্রতিরক্ষার বিষয়ে যদি সত্যিকার অর্থেই আন্তরিক হয়ে থাকেন, তাহলে তাঁদের ফিটফাট দেখানো অস্ত্র কেনার দিকে কম মনোযোগ দিয়ে কৌশলগত জোটগুলোর সঙ্গে বিদ্যমান দুর্বল সম্পর্ক মেরামতে বেশি মনোযোগী হতে হবে।

ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

● স্লাভমির সিয়েরাকভস্কি জার্মান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের একজন জ্যেষ্ঠ ফেলো