আলুর দামে কেন এই অস্বাভাবিক আস্ফালন?

চলতি বছর আলুর ভালো ফলন হলেও সাধারণ কৃষকেরা লাভজনক দাম তুলতে পারেননি
ফাইল ছবি

এ বছরের মৌসুমের শুরুতে, মানে ২০২৩ সালের মার্চে কৃষকেরা আলু বিক্রি করেছিলেন কেজিপ্রতি ১০ থেকে ১২ টাকায়। মাত্র ছয় মাস পর, সেপ্টেম্বরে, ওই কৃষক যদি আজকে বাজারে যান আলু কিনতে, তাহলে তাঁকে ৪৮ থেকে ৫৫ টাকা দরে তা কিনতে হবে। কী এমন ঘটল যে বাংলাদেশে আলুর দামের এই অস্বাভাবিক আস্ফালন?

প্রশ্নটা অত্যন্ত ন্যায্য হলেও এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো সদুত্তর মেলেনি। পত্রিকা মারফত জানা গেল, সিন্ডিকেটের কারণে মানুষকে এভাবে জিম্মি করে ইচ্ছামতো মুনাফা করা হচ্ছে। দেশের সাধারণ কৃষকেরা বলছেন, আলুর বাজারের সমস্ত সিন্ডিকেটের হোতা হচ্ছেন ফড়িয়া, হিমাগারের (কোল্ড স্টোরেজ) মালিক ও আড়তদারেরা।

চলতি বছর আলুর ভালো ফলন হলেও সাধারণ কৃষকেরা লাভজনক দাম তুলতে পারেননি। সংবাদপত্রের খবর অনুসারে, চলতি মৌসুমে রাজশাহীর তানোর, গোদাগাড়ী, পবা, মোহনপুর, বাগমারাসহ বিভিন্ন উপজেলায় শুধু প্রতি কেজি আলুর উৎপাদন খরচ ১৩ টাকা হলেও পাইকারিতে ১১ টাকায় বিক্রি করতে হয়েছে।

এমনিতেই ফসল হিমাগারে রাখতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয় সাধারণ কৃষকদের। ফসল সংরক্ষণের ব্যবস্থায় সিন্ডিকেটের কর্তৃত্ব কিংবা ঋণ পরিশোধের চাপে মৌসুমের শুরুতেই কৃষক তাঁর উৎপাদিত ফসল কাঙ্ক্ষিত দামের কমে বিক্রি করতে বাধ্য হন।

এর সুযোগ নেন মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়ারা। কৃষকদের কাছ থেকে নামমাত্র দাম দিয়ে কিনে তারপর মৌসুম শেষে আড়তদার, ব্যবসায়ী ও হিমাগারের মালিকেরাই ফসলের দাম বাড়িয়ে দেন। ভোক্তা জনগণ ও উৎপাদক কৃষক—উভয়েই বাজার নিয়ন্ত্রণের এই কারসাজির ভুক্তভোগী। বাংলাদেশে পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, দেশে আলুর চাহিদা ৯০ লাখ টনের বিপরীতে বাংলাদেশে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১ কোটি ৪ লাখ ৩১ হাজার টন আলু উৎপাদিত হয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে আলুর কোনো ঘাটতি নেই। তবু বাজারে আলুর দাম নাগালের বাইরে।

সাম্প্রতিককালে মূল্যস্ফীতিতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা অনেক কমে গেছে। তবু মানুষ সব মুখ বুজে সহ্য করছে। কারণ, কোনো কার্যকর প্রতিরোধ আমরা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো গড়ে তুলতে পারিনি। বাম দলগুলো প্রতিবাদ করে এলেও তাতে সরকারকে বাধ্য করা যায়নি কোনো কার্যকর উদ্যোগে নিতে। সঞ্চয় দূরে থাক, মানুষের এখন নিত্যদিনের খাবারের জোগান দিতেই বেসামাল অবস্থা।

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়ালে নানান গৎবাঁধা বুলি শুনতে হয়। যেমন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দরুন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিকভাবে কোনো পণ্যের দাম কমলেও বাংলাদেশের বাজারে সেই দাম আর কমে না। ২০২৩ সালের জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার খাদ্যের মূল্যসূচকের প্রতিবেদন জানিয়েছে, বিভিন্ন পণ্যের অব্যাহত দাম কমার খবরও বাংলাদেশে কোনো প্রভাব ফেলেনি। সংশ্লিষ্ট সিন্ডিকেটকে নিয়ন্ত্রণ করা কিংবা কোনোভাবে বিচারের আওতায় আনার কোনো উদ্যোগ নেই সরকারের।

সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সংসদে সিন্ডিকেট প্রসঙ্গে বলেছেন, সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে নাকি তারা পণ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেবে। সুতরাং মন্ত্রীর কথাতেই স্পষ্ট যে কতটা ব্যর্থ সরকার। জনগণকে জিম্মি করে যে সিন্ডিকেট, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অপারগতা প্রকাশ করে তিনি পদত্যাগ করতে পারতেন। কিন্তু সেটা তো আমাদের দেশে কখনো দেখিনি।

আরও পড়ুন

সাম্প্রতিককালে মূল্যস্ফীতিতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা অনেক কমে গেছে। তবু মানুষ সব মুখ বুজে সহ্য করছে। কারণ, কোনো কার্যকর প্রতিরোধ আমরা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো গড়ে তুলতে পারিনি। বাম দলগুলো প্রতিবাদ করে এলেও তাতে সরকারকে বাধ্য করা যায়নি কোনো কার্যকর উদ্যোগে নিতে। সঞ্চয় দূরে থাক, মানুষের এখন নিত্যদিনের খাবারের জোগান দিতেই বেসামাল অবস্থা। শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের খরচ কমানোর মাধ্যমে খাদ্যের বাড়তি ব্যয় মেটাতে হচ্ছে। তবু প্রয়োজনীয় পুষ্টি নিশ্চিত করতে পারছে না মানুষ। অনেক পরিবার আমিষ বলতে কেবল ডিমকেই বুঝত। সেই ডিমও এখন লাগামছাড়া।

গণতান্ত্রিক বিধিবিধান থাকলে একটা দেশের বাজার পরিস্থিতির এই অস্থিতিশীলতার ন্যূনতম জবাবদিহি থাকত। নিত্যপণ্যের দাম কমানোর দাবিতে সরকারকে বাধ্য করতে না পারা, সিন্ডিকেটকে মোকাবিলায় সরকারের এই অনীহা কিংবা অপারগতাকে চ্যালেঞ্জ করার মতো রাজনীতিকে শক্তি জোগানোই একমাত্র বিকল্প। যে কৃষক উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দাম পান না, তাঁর কথাগুলো বলার রাজনীতি আমাদের জোরদার করতেই হবে। তা না হলে আমরা কেবল পরাজিতই হব সিন্ডিকেটের কাছে।

  • লাকী আক্তার সদস্য, বাংলাদেশ কৃষক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটি