নতুন মধ্যপ্রাচ্য আসছে, কিন্তু সেটা...

ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি জানিয়ে জর্দানে বিক্ষোভছবি: রয়টার্স

এক বছর আগে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ‘নতুন মধ্যপ্রাচ্য’ আঁকা একটা মানচিত্র নিয়ে গিয়েছিলেন। এই মানচিত্রে আব্রাহাম চুক্তির ভিত্তিতে আঞ্চলিক ব্যবস্থা রূপান্তরের একটা দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছিল। আব্রাহাম চুক্তি হলো প্রতিবেশী আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার একটা প্রক্রিয়া।

কিন্তু কূটনীতি ও বাণিজ্যের মাধ্যমে আঞ্চলিক ব্যবস্থা রূপান্তরের পরিবর্তে গত এক বছর ধরে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ ও গণহত্যার পথ বেছে নিয়েছে ইসরায়েল।

বছরজুড়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে ইসরায়েল যেভাবে খোলাখুলি আক্রমণ শুরু করেছে, তাতে সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠার যে নড়বড়ে পথ, সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে। গাজায় গণহত্যামূলক আগ্রাসন, সিরিয়া ও ইয়েমেনে আকাশপথে বোমা, ড্রোন ও মিসাইল হামলা এবং এখন লেবাননে স্থল অভিযান—এসবই এ দশকের শুরুতে মধ্যপ্রাচ্যে আপেক্ষিক যে স্থিতিশীলতা তৈরি হয়েছিল, সেটা পুরোপুরি ভেঙে গেছে।

২০০৩ সালে নয়া রক্ষণবাদী চিন্তকেরা ইরাককে এমন একটি গণতান্ত্রিক বাতিঘর হিসেবে তৈরি করতে চেয়েছিলেন, যেখান থেকে নতুন একটা মধ্যপ্রাচ্য চারদিকে ছড়িয়ে যেতে পারে। দুই দশক পর মধ্যপ্রাচ্যের সেই রূপান্তর ঘটছে চরম বর্ণবাদী, বসতি স্থাপনকারী একটি রাষ্ট্রের হাতে। সেই রাষ্ট্র গণহত্যা, আগ্রাসন ও গণবিতাড়নের মাধ্যমে রূপান্তরের কাজটি করে চলেছে।

যতভাবে সম্ভব, ততভাবে এবং সহনীয় মাত্রার আঞ্চলিক সশস্ত্র সংঘাতে ইসরায়েল তার সীমানা বাড়িয়েই চলেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন নিয়মিত লঙ্ঘন করে ও বড় ধরনের উত্তেজনার মধ্যে ঠেলে না দিয়ে আরব দেশগুলোকে পরীক্ষায় ফেলে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে চলেছে ইসরায়েল।

ইসরায়েলি গণহত্যামূলক আগ্রাসন গাজার সিংহভাগ অঞ্চলকে বসবাসের অনুপযোগী করে ফেলেছে। আঞ্চলিক সরকারগুলো যুদ্ধবিরতি ও উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানিয়েছে। এখন পর্যন্ত অরাষ্ট্রীয় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো বাদে আরব রাষ্ট্রগুলোর বেশির ভাগই নিষ্ক্রিয় ক্রীড়নক।

আরব দেশগুলো এর আগে যেসব লাল সীমানা (যেমন ফিলিস্তিনিদের গণবাস্তুচ্যুতি, হাসপাতাল ও স্কুলে লক্ষ্যবস্তু করে হত্যাযজ্ঞ চালানো) ঠিক করেছিলেন, সেগুলো ইসরায়েলি আগ্রাসন বন্ধে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। কিন্তু গাজায় বছরব্যাপী যুদ্ধ নতুন মধ্যপ্রাচ্য উদয়ের আগমনী ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের সম্পর্কের বিচারে এটা বলা–ই যায়। এখানে আমেরিকান ও ইউরোপীয় কূটনীতির বিষয়টি পুরোপুরি দৃশ্যমান।

তবে পশ্চিমা নেতৃত্বের প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের নেতাদের আস্থা কমে যাচ্ছে। রাজনৈতিক চুক্তির মধ্যস্থতার ক্ষেত্রে সেখানকার দেশগুলো ক্রমাগতভাবে চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। প্রযুক্তি খাতে উন্নয়ন এবং অবকাঠামো খাত পুনর্গঠনের জন্য দেশগুলো চীনকে অংশীদার করছে।

নেতানিয়াহু মধ্যপ্রাচ্যের যে সংশোধিত মানচিত্র দেখিয়েছিলেন, সেখানে দখলকৃত ফিলিস্তিন সুস্পষ্টভাবে অনুপস্থিত ছিল। এই বিকৃতির পেছনের কারণ কী, তা তিনি এক বছর ধরে দেখিয়ে চলেছেন।

ইসরায়েলের দৃষ্টিতে নতুন একটি আঞ্চলিক বিন্যাসের অর্থ হচ্ছে সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা। কিন্তু সেই লক্ষ্য অর্জনে ফিলিস্তিন একটা বাধা। সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান সম্প্রতি বলেছেন, পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটা ফিলিস্তিন রাষ্ট্র যতক্ষণ প্রতিষ্ঠা পাবে না, ততক্ষণ তার দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করবে না।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, তরুণ সৌদিদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা দাবি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সৌদি যুবরাজ এটি বলেছেন। শুধু সৌদি আরব নয়, ইসরায়েলি গণহত্যায় পুরো মধ্যপ্রাচ্যের তরুণদের মধ্যে ফিলিস্তিনিদের প্রতি নিরঙ্কুশ সংহতি বোধ তৈরি হয়ে উঠেছে।

এ বিবেচনায় গাজা যুদ্ধ প্রকৃত অর্থেই মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র বদলে দিচ্ছে। ইসরায়েলি দখলদারি ও জাতিগত নির্মূল অভিযানের বিরুদ্ধে আরব দেশগুলোর রাস্তায় রাস্তায় জনগণের মধ্যে ঐক্যের এক শক্তিশালী বোধ তৈরি হয়েছে।

কিন্তু এই নতুন সচেতনাকে দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তনে রূপ দিতে হলে আরব দেশগুলোকে অবশ্যই তাদের ভবিষ্যৎ আঞ্চলিক রূপান্তরে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। একটি উড়ে এসে জুড়ে বসা বসতি স্থাপনকারী, ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদের পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া শক্তিকে সেই গতিপথ নির্ধারণের সুযোগ দেওয়া যাবে না।
শুধু একটা ন্যায্য ও সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ও বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্য প্রতিষ্ঠার নেতৃত্ব দেওয়ার মাধ্যমে সেটা নিশ্চিত করা সম্ভব।

  • স্যানসম মিল্টন কাতারের দোহার সেন্টার ফর কনফ্লিক্ট অ্যান্ড হিউম্যানিটারিয়ান স্টাডিজের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো
    মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত