এরদোয়ান কি পারবেন ট্রাম্পের সঙ্গে কৌশলে বন্ধুত্ব গড়তে

ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে এরদোয়ান কি তাঁর কৌশলী নীতি ধরে রাখতে পারবেনছবি: এএফপি

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান দুই দশকের বেশি সময় ধরে কৌশলী ভারসাম্য বজায় রেখে পশ্চিমা বিশ্ব, রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে আসছেন। তাঁর কৌশলে একদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দুই পক্ষই তুরস্কের সহায়তা থেকে উপকৃত হয়েছে, তেমনি মধ্যপ্রাচ্য ও আশপাশের অঞ্চলে তুরস্কের সামরিক উপস্থিতি এবং প্রভাব বাড়ানো সম্ভব হয়েছে। সিরিয়া, লিবিয়া, ককেশাস, পূর্ব ভূমধ্যসাগর ও উপসাগরীয় এলাকায় তুরস্কের শক্তি বৃদ্ধি ঘটেছে। পাশাপাশি আফ্রিকা, মধ্য এশিয়া ও পশ্চিম বলকানে তুরস্ক নিজের ‘সফট পাওয়ার’ বিস্তার করতে পেরেছে। সেই সঙ্গে তুরস্ক একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষা শিল্প গড়ে তুলেছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে এরদোয়ান কি তাঁর এই কৌশলী নীতি ধরে রাখতে পারবেন। সেই নীতি কি আগের মতোই লাভজনক হবে?

ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কের মধ্যে উত্তেজনা বেশ বেড়েছিল। ওয়াশিংটনের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে আঙ্কারা যখন রাশিয়ার কাছ থেকে উন্নত প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এস-৪০০ কিনেছিল। তখন যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে অত্যাধুনিক এফ-৩৫ ফাইটার জেট প্রকল্প থেকে বাদ দেয়। অন্যদিকে এরদোয়ান অভিযোগ করেছিলেন যে যুক্তরাষ্ট্র তাঁর অন্যতম রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ফেতুল্লাহ গুলেনকে আশ্রয় ও সহায়তা দিচ্ছে।

একসময় ট্রাম্প প্রকাশ্যে হুমকি দিয়েছিলেন যে এরদোয়ান যদি সিরিয়ায় মার্কিন–সমর্থিত কুর্দি বাহিনীর ওপর হামলা চালাতে সেনা পাঠান, তবে তুরস্কের অর্থনীতি ধ্বংস করে দেওয়া হবে। তুরস্ক ওই কুর্দি গোষ্ঠীকে কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) শাখা হিসেবে দেখে। এরা তুরস্কের সবচেয়ে ভয়ংকর অভ্যন্তরীণ শত্রু। তবে ট্রাম্পের দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হওয়াকে বিশ্বনেতাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উচ্ছ্বাসের সঙ্গে স্বাগত জানিয়েছেন এরদোয়ান। অন্যদিকে ট্রাম্পও এরদোয়ানকে ‘বন্ধু’ বলে উল্লেখ করে সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের নৃশংস শাসনের পতনে তুরস্কের ভূমিকার প্রশংসা প্রকাশ করেছেন।

বাইডেনের আমলে এরদোয়ানকে কখনো হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। দুই দেশের সম্পর্কও ছিল বেশ ঠান্ডা, কিন্তু ট্রাম্প এখনো এরদোয়ানের ফোন ধরেন। নতুন মার্কিন প্রশাসনও স্বীকার করছে যে তুরস্ক এখন একটি আত্মবিশ্বাসী মাঝারি শক্তি হয়ে উঠেছে।

ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে তুরস্ক পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। সম্প্রতি সে চীন ও রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন ব্রিকস গোষ্ঠীতে যোগ দেওয়ার আবেদন করেও ব্যর্থ হয়েছে। তারপরও তুরস্ক পশ্চিমা শিবিরেই রয়ে গেছে। ন্যাটোর সদস্য হিসেবে তুরস্কের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘদিন ধরে তুরস্ক ইইউ সদস্যপদপ্রত্যাশী একটি দেশ।

তুরস্ক-ইসরায়েল সংঘাত হলে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি কমানোর ট্রাম্পের পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে পারে। তবে এরদোয়ান অত্যন্ত চতুর ও বাস্তববাদী নেতা। তাই তিনি পরিস্থিতি তিনি এত দূর যেতে দেবেন না বলেই মনে হয়।

তুরস্ক ও মার্কিন বিশেষজ্ঞরা রাশিয়ার এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে বিরোধ সমাধানের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছেন। তা হতে পারে ক্ষেপণাস্ত্রটি ইঞ্চিরলিক বিমানঘাঁটিতে সংরক্ষণ করে রাখা। সেখানে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বিমানঘাঁটি রয়েছে। বিনিময়ে ওয়াশিংটন তুরস্কের ওপর আরোপিত অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করবে এবং এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান বিক্রি করবে। তবে প্রশ্ন হলো, তুরস্ক কি এখনো এই প্রস্তাবে আগ্রহী হবে? কারণ, তুরস্ক ইতিমধ্যে নিজস্ব যুদ্ধবিমান উন্নয়নে মনোযোগ দিয়েছে।

ট্রাম্প তাঁর প্রথম মেয়াদে মধ্যপ্রাচ্যের দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ থেকে সরে আসার নীতি গ্রহণ করেছিলেন। সিরিয়ায় মার্কিন–সমর্থিত কুর্দি বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত মার্কিন বিশেষ বাহিনী প্রত্যাহারের চেষ্টা করেছিলেন। তবে তা সফল হয়নি। ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে তুরস্কের সঙ্গে সিরিয়া নীতিতে নতুন সমঝোতা হতে পারে।

আঙ্কারা আরেকটি কৌশলগত পদক্ষেপ নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ মন্ত্রণালয় গোপনে সতর্কবার্তা পাঠিয়ে রাশিয়ান নিষেধাজ্ঞার লঙ্ঘনে সহায়তাকারী তুর্কি ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম বন্ধের আহ্বান জানায়। তুরস্ক সেই নির্দেশনা মেনে নেয়। যদিও রাশিয়ার সঙ্গে তুরস্কের বাণিজ্য ২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধের পর প্রায় তিন গুণ বেড়েছে। তবে রুশ পর্যটকদের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় কিছু অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীনও হয়েছে তুরস্ক। তবে মস্কোর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার পাশাপাশি ইউক্রেনকেও সামরিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে তুরস্ক। তুরস্ক একদিকে যেমন রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখেছে, তেমনি পশ্চিমা মিত্রদের স্বার্থও পুরোপুরি এড়ায়নি।

এরদোয়ান জোরালোভাবে হামাস ও ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তিনি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে ‘গণহত্যাকারী’ আখ্যা দিয়ে হিটলারের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ফলে ইসরায়েলপন্থী ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে তার সংঘাতের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তবে বিষয়টি এতটা সরল নয়। এরদোয়ান ৭ অক্টোবর ২০২৩-এ হামাসের হাতে ইসরায়েলি বেসামরিক নাগরিকদের হত্যাকাণ্ডের ঠিক আগমুহূর্তে নেতানিয়াহুকে তুরস্কে স্বাগত জানানোর পরিকল্পনা করছিলেন। দুই দেশের সম্পর্ক উন্নতির পথে এগোচ্ছিলেন। কিন্তু গাজায় ইসরায়েলি সামরিক অভিযানের কারণে নতুন করে সংকট তৈরি হয়। এতে তুরস্ক-ইসরায়েল সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

তুরস্ক আনুষ্ঠানিকভাবে ২০২৩ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দেয়। তবে বাস্তবে বিষয়টি আরও জটিল। আজারবাইজান থেকে ইসরায়েলে তেল সরবরাহ এখনো তুরস্কের বন্দর ব্যবহার করেই হয়; অর্থাৎ নতুন নামে ইসরায়েলের সঙ্গে তুরস্কের বাণিজ্য অব্যাহত রয়েছে। ইসরায়েলের গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা শিন বেতের প্রধান গত নভেম্বর মাসে তুর্কি গোয়েন্দাপ্রধান ইব্রাহিম কালিনের সঙ্গে গোপন বৈঠক করেছেন।

যুক্তরাষ্ট্র-তুরস্ক সম্পর্কের জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো সিরিয়ায় তুরস্ক ও ইসরায়েলের মধ্যে সরাসরি সংঘাতের আশঙ্কা। আসাদ সরকারের পতনের পর নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হওয়ায় এই অঞ্চলে তারা কার্যত প্রতিবেশী হয়ে উঠেছে। ইসরায়েলের রাজনীতিক ও শিক্ষাবিদেরা ক্রমে তুরস্ককে ইহুদি রাষ্ট্রের জন্য হুমকি হিসেবে দেখতে শুরু করেছেন। অন্যদিকে কিছু তুর্কি সামরিক পরিকল্পনাবিদ আশঙ্কা করছেন যে ইসরায়েল গোপনে কুর্দি যোদ্ধাদের সঙ্গে মিলে তুরস্কের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে পারে।

তুরস্ক-ইসরায়েল সংঘাত হলে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি কমানোর ট্রাম্পের পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে পারে। তবে এরদোয়ান অত্যন্ত চতুর ও বাস্তববাদী নেতা। তাই তিনি পরিস্থিতি তিনি এত দূর যেতে দেবেন না বলেই মনে হয়।

পল টেলর ইউরোপিয়ান পলিসি সেন্টারের সিনিয়র ভিজিটিং ফেলো

গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনুবাদ জাভেদ হুসেন