সিলেটে ভোটের আগাম হাওয়া ও আওয়ামী লীগে চাপান-উতোর

একজন জনপ্রতিনিধি, তিনি যে দলেরই হোন না কেন, বৈরী পরিবেশেও যে জনগণের কাজ করতে পারেন, তার প্রমাণ অতীতে একাধিক সিটি করপোরেশনের মেয়র রেখে গেছেন। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী প্রথম নির্বাচিত হয়েছিলেন বিএনপির আমলে।

তিনি চট্টগ্রাম শহরে অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করে নগরবাসীর মন জয় করেছিলেন; যদিও শেষ মেয়াদে সেই ধারাবাহিকতা রাখতে পারেননি। তিনি বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘সরকারের কাছ থেকে আমি টাকা চাই না, প্রকল্পের অনুমোদন চাই।’

 চট্টগ্রাম বন্দরনগরী। সরকার তার বাহারি নাম দিয়েছে বাণিজ্যিক রাজধানী। ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল হিসেবে সিটি মেয়রের পক্ষে অনেক কাজ করা সম্ভব। কিন্তু অন্যান্য সিটি মেয়রের পক্ষে তা প্রায় অসম্ভব।

নির্বাচন নিয়ে দুই দলের মধ্যে যে বিরোধ, তা কীভাবে সুরাহা হবে, এ সম্পর্কে তাঁরা কিছু বলতে পারেননি। সবাই চেয়ে আছেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রতি। সিলেটের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ বললেন, যে-ই জিতুন না কেন, তাঁরা একটা ভালো নির্বাচন চান

৪ ফেব্রুয়ারি কথা হয় সিলেটের সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর বাসভবনে। সহকর্মী সুমনকুমার দাশকে নিয়ে আমরা যখন মেয়রের বাসভবনে পৌঁছাই, সেখানে একটি চীনা বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের দুজন কর্মকর্তা ছিলেন। তাঁরা মেয়রকে শহরে অত্যাধুনিক ওয়াটার প্ল্যান্ট তৈরি করে দেওয়ার প্রস্তাব দেন; শতভাগ তাঁদের বিনিয়োগে। কিন্তু মেয়র তাঁদের জানিয়ে দেন, নীতিগতভাবে এই প্রকল্পের বিষয়ে তাঁর আপত্তি নেই। কিন্তু সিদ্ধান্ত আসতে হবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে। সিটি করপোরেশনগুলো স্থানীয় সরকারের অধীনই কাজ করে।

সিলেটের রাজনীতিতে উত্তাপ আছে। ঝগড়া-বিবাদ আছে। কিন্তু আরিফুল হক চৌধুরীকে নিয়ে তেমন বিরোধ নেই। সরকারি ও বিরোধী দল, উভয়ের কাছে তিনি গ্রহণযোগ্য। মাস কয়েক আগে জাতীয় নির্বাচনে তাঁর প্রার্থী হওয়ার গুঞ্জন উঠলে সরকারের তিনজন মন্ত্রী তাঁকে আশ্বস্ত করেন, আগামী সিটি নির্বাচনেও তাঁর জয় নিশ্চিত। তিনি মহানগরের নেতৃত্ব ছেড়ে দেবেন কেন? গত বন্যার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন সিলেট নাগরিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন, মেয়র আরিফুল হকও সেখানে ছিলেন।

তিনি বলেছিলেন, ‘আমাকে ১০ কোটি টাকা দিন, আমি শহর রক্ষা বাঁধ করে বন্যা থেকে সিলেট শহরকে বাঁচাতে পারব।’ কিন্তু সরকারের ভেতরেও সরকার থাকে। করিতকর্মা আমলারা ও সরকারি দলের কোনো কোনো নেতা উজান থেকে জকিগঞ্জ পর্যন্ত সুরমার দুই তীরে বাঁধ নির্মাণের জন্য ২০০ কোটি টাকার প্রকল্পের প্রস্তাব দেন। ফলে, ‘নয় মণ তেলও জোগাড় হবে না, রাধাও নাচবে না’।

২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে সিটি নির্বাচনে সরকারি দলের জয়জয়কার ছিল; পাঁচটি সিটি করপোরেশনের চারটিতেই আওয়ামী লীগ প্রার্থী জয়ী হন। সেই নির্বাচনেও আরিফুল হক চৌধুরী টেক্কা দিয়েছেন। সিলেটের অনেকের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, আরিফুল হক মেয়র থাকতে সিটি করপোরেশনকে দলীয় কাজে ব্যবহার করেননি, সবাইকে নিয়ে কাজ করেছেন।

কিন্তু দল তাঁকে সেভাবে মূল্যায়ন করেনি, বিএনপির স্থানীয় নেতাদের অনেকে তাঁকে এড়িয়ে চলেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের ভয়, আরিফুল হক জাতীয় বা সিটি করপোরেশন—যেখানেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করুন, মানুষ তাঁকে জয়ী করবে। আওয়ামী লীগের মধ্যে এমন গুঞ্জনও আছে যে বিএনপি সিটি নির্বাচন বর্জন করলে আরিফুল হক চৌধুরীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী বা দলে এনে তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করাবে।

অনেকের প্রশ্ন, তাহলে কি আরিফুল হক উকিল আবদুস সাত্তার হবেন? এ বিষয়ে মেয়রের মতামত জানতে চাইলে বলেন, ‘দল নির্বাচন বর্জন করলে আমার আর নির্বাচন করার সুযোগ থাকবে না। আমাকে হয়তো রাজনীতি থেকেই অবসর নিতে হবে।’ তবে তাঁর সমর্থক ও অনুসারীরা চান, বিএনপি সিটি নির্বাচন বর্জন করলেও আরিফুল হক প্রতিদ্বন্দ্বিতা করুন। নগরবাসীর স্বার্থেই তা প্রয়োজন। গত দুই মেয়াদে সিলেট শহরকে তিনি একটি পরিচ্ছন্ন শহরে রূপ দিয়েছেন।

আরিফুল হক চৌধুরী মনে করেন, স্থানীয় নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে হওয়া উচিত নয়। আওয়ামী লীগ সরকারই এই নিয়ম বানিয়ে দিয়েছে। এতে আওয়ামী লীগের লাভ হয়নি, ক্ষতি হয়েছে স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর। এখন দলীয় অফিস ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অফিস একাকার হয়ে গেছে। খোদ সরকারি দলেরও অনেকে এর পরিবর্তন চান। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?

সিলেটে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কয়েকজন নেতা প্রথম আলোর অফিসে এসেছিলেন। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে। তাঁদের সঙ্গে কথা হলো। আওয়ামী লীগের নেতাদের দাবি, গত ১৪ বছরে সরকার সিলেটে অনেক উন্নয়ন করেছে। বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। আগামী নির্বাচনে সিলেটের মানুষ আওয়ামী লীগকেই জয়ী করবে। অন্যদিকে, বিএনপির নেতারা বলেছেন, সিটি মেয়র সিলেটকে পরিচ্ছন্ন শহর হিসেবে গড়ে তুলেছেন। রাস্তাগুলো প্রশস্ত হয়েছে। যানজট কমেছে। কারাগারটি শহরের বাইরে নেওয়া ছাড়া সরকার কোনো কাজ করেনি। অতএব, মানুষ বিএনপিকেই বেছে নেবে।

কিন্তু নির্বাচন নিয়ে দুই দলের মধ্যে যে বিরোধ, তা কীভাবে সুরাহা হবে, এ সম্পর্কে তাঁরা কিছু বলতে পারেননি। সবাই চেয়ে আছেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রতি। সিলেটের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ বললেন, যে-ই জিতুন না কেন, তাঁরা একটা ভালো নির্বাচন চান।

সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচন হতে এখনো কয়েক মাস বাকি। এরই মধ্যে নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করেছে। আওয়ামী লীগের একজন প্রবাসী নেতার রঙিন পোস্টার সেঁটে দেওয়া হয়েছে শহরের মোড়ে মোড়ে। তিনি নিজেও বিভিন্ন মসজিদে গিয়ে এলাকাবাসীর ‘দোয়া’ চাইছেন।

তাঁর অনুসারীরা বলছেন, তিনিই শীর্ষ নেতৃত্বের কাছ থেকে গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে মাঠে নেমেছেন। অন্যদিকে, স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, তাঁরা এমন কোনো নির্দেশনা পাননি। এ নিয়ে সিলেট আওয়ামী লীগে চাপান-উতোর চলছে।

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

    [email protected]