জয়নাল, রফিকুল বা আলী: এরাও পারে বদলে দিতে পৃথিবী

বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় পাওয়া নারীদের সঙ্গে রফিকুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী (বাম দিক থেকে তৃতীয়)
ছবি: প্রথম আলো

বছর দশেক আগে ময়মনসিংহের এক দরিদ্র রিকশাচালক জয়নাল আবেদিনের কথা পড়েছিলাম প্রথম আলোর পাতায়। হতদরিদ্র দিনমজুর, ৩০ বছর তিলে তিলে সঞ্চয় করে নিজ গ্রামে গড়ে তুলেছেন একটি হাসপাতাল। মুক্তিযোদ্ধা বাবা বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়ার পর শপথ নিয়েছিলেন একটি হাসপাতাল করবেন। ৩০ বছর লেগেছে, কিন্তু পৈতৃক ভিটায় সে হাসপাতাল তিনি ঠিকই নির্মাণ করেছেন।

সেদিন একই পত্রিকার পাতায় আরেক মানুষের গল্প পড়লাম। নাম রফিকুল ইসলাম। তিনিও ময়মনসিংহের মানুষ। একদম একার চেষ্টায় নির্মাণ করেছেন একটি বৃদ্ধাশ্রম। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের সামনে আশ্রয়হীন, সম্বলহীন বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের করুণ অবস্থা দেখে এই বৃদ্ধাশ্রম নির্মাণের ভাবনা তাঁর মাথায় আসে। সরকারি হাসপাতালের সামান্য নিরাপত্তাপ্রহরী তিনি, নিজ সংসার চালাতেই হিমশিম খেতে হয়। কিন্তু হাল ছাড়েননি। যে দুই-দশ কাঠা পৈতৃক ও নিজের কেনা জমি ছিল, তা বিক্রি করে গড়ে তুলেছেন ‘মাতৃছায়া সমাজকল্যাণ সংস্থা ও বৃদ্ধ আশ্রয় কেন্দ্র’। এখন সেখানে আটজন অসহায় মানুষের ঠাঁই হয়েছে। তাঁদের মধ্যে নারী ও পুরুষ, মুসলিম ও হিন্দু উভয় ধর্মের মানুষই রয়েছেন।

প্রতিবেদনটি পড়ে আমার চোখ ভিজে এসেছে। আনন্দে বুকও ভরেছে। আমরা অনেকেই পৃথিবী বদলে দেওয়ার কথা বলি, কিন্তু কথা বলার বাইরে কুটোটিও নেড়ে দেখি না। এই সামান্য কথাটাও আমরা বুঝি না যে পৃথিবী বদলের আগে দরকার নিজের দেশ, নিজের গ্রাম বা নিজের পাড়া বদলের কাজে হাত লাগানো। তারও আগে দরকার নিজেকে বদলে নেওয়া। জয়নাল আবেদিন ও রফিকুল ইসলাম ঠিক সে কাজটি করে আমাদের পথ দেখালেন।

গত পাঁচ হাজার বছরে পৃথিবী একটু একটু করে বদলেছে মূলত স্বপ্নচারী মানুষদের জন্যই। কার্ল মার্ক্স থেকে আজকের গ্রেটা থুনবার্গ সেই রকম মানুষ, যাঁরা সত্যি সত্যি পৃথিবী বদলের স্বপ্ন দেখেছেন। তাঁদের সেই স্বপ্ন পৃথিবীকে অল্পবিস্তর বদলেও দিয়েছে, দিচ্ছে। কিন্তু আমরা মার্ক্স বা থুনবার্গ নই। খুব বড় কোনো পরিবর্তন, সারা বিশ্বকে যা ধারণ করে, তা কল্পনায় আনাও আমাদের সাধ্যে কুলায় না। কিন্তু নিজ গ্রাম, শহর বা দেশের কথা ভাবা তো অসম্ভব নয়। শুধু ভাবা নয়, পরিবর্তন যে বাস্তবে সম্ভব, সত্যি সত্যি সে কাজ করে জয়নাল ও রফিকুলের মতো মানুষ আমাদের হাতে–কলমে দেখিয়ে দিলেন।

আরও পড়ুন

কেউ কেউ বলবেন, দশ শয্যার হাসপাতাল বা আট শয্যার বৃদ্ধাশ্রম, এ আর এমন বড় কী কাজ! খুব ভুল কথা। সব বড় কাজই শুরু হয় খুব সামান্য কাজ দিয়ে। সব দীর্ঘ যাত্রাই শুরু হয় একটি সামান্য পদক্ষেপ দিয়ে। তাঁর গ্রামে একটি হাসপাতাল দরকার, অথবা অসহায় বৃদ্ধদের জন্য একটি আশ্রয়কেন্দ্র চাই, এ কথা আরও অনেকেই ভেবেছেন। কিন্তু সবাই হাত গুটিয়ে বসে থেকেছেন। নিজেকে এই বলে বুঝ দিয়েছেন, এ কাজ আমার নয়, সরকার বা গ্রাম সরকারের। অথবা খুব দানবীর কারোর। যাঁরা সমস্যা নিয়ে যথেষ্ট ভেবেছেন, তাঁরাও কী করা যায় ভেবে কুলকিনারা পাননি। এর জন্য অর্থ চাই, জনবল চাই, তার কোনোটাই তো তাঁদের নেই। অন্য সবার মতো হাত গুটিয়ে বসে না থেকে এই দুজন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন খুব বড় বা মহৎ কাজের আগে এই আপাত ছোট কাজটি কীভাবে সম্ভব। দীর্ঘ যাত্রার প্রথম পদক্ষেপটি তাঁরা নিজেরাই নিলেন সম্ভবত এই আশায় যে এরপর আরও অনেকে এগিয়ে আসবেন সে পদযাত্রা শেষ করতে।

আপাতভাবে মনে হতে পারে জয়নাল বা রফিকুল পাগল। তাঁদের না আছে বিত্ত, না আছে সাংগঠনিক সমর্থন। নিজ স্বপ্নপূরণের আশায় গ্রাম ছেড়ে ঢাকা শহরে চলে এসেছিলেন জয়নাল। ৩০ বছর রিকশা চালিয়ে একটু একটু অর্থ জমিয়েছেন। কাজটা একদম পাগলামি এই সন্দেহ তাঁর মনেও জেগেছে, স্ত্রী বা সন্তানদের কেউ যাতে বিব্রত না হয় সে জন্য তাঁদের নিজের স্বপ্নের কথা জানতেও দেননি। কিন্তু হাল ছাড়েননি। তাঁর তুলনায় রফিকুল অধিক বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। স্ত্রীকে নিভৃতে নিজের বাসনার কথা জানিয়েছেন, তাঁর সমর্থন নিয়ে একমাত্র সঞ্চয় ছোট দুটি অনাবাদি জমি বিক্রি করে পুঁজি সংগ্রহ করেছেন। এই কাজ হাতে নেওয়ার পর একসময় নিজের চাকরিও ছেড়েছেন, কিন্তু হাল ছাড়েননি।

পৃথিবী বদল মানে বিপ্লব নয়, ক্ষমতা দখল নয়। অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মানবিক কাজ, তারাও পৃথিবী বদলে দেওয়ার প্রথম পদক্ষেপ। জয়নালের হাসপাতালে প্রতিদিন যে দশজন রোগী, অথবা রফিকুলের বৃদ্ধাশ্রমে যে জনা আটেক মানুষ মাথার ওপর ছাদ পেয়েছেন, পেয়েছেন প্রতিদিনে আহার, তাঁদের জন্য ঘাড়ের ওপর সমর্থনের এই শ্রদ্ধাস্পর্শটুকুর মূল্য অপরিসীম।

বলবেন পাগলামি। অ্যাপল কোম্পানির স্টিভ জবসের একটি কথা মনে পড়ছে। নিজ স্বপ্নের কথা বলতে গিয়ে অ্যাপল কম্পিউটার ও আই-ফোনের এই উদ্ভাবক বলেছিলেন, কিছু কিছু পাগল আছে, যারা মনে করে পৃথিবী বদলে দেবে। তাঁরা আছে বলেই পৃথিবীটা বদলে যায়, প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে। মাদার তেরেসা, নেলসন ম্যান্ডেলা বা মার্টিন লুথার কিংয়ের কথা ভাবুন। মানবতায় আমরা যে এখনো সম্পূর্ণ আস্থা হারাইনি, তা তো তাঁদের জন্যই।

কিন্তু সেসব অসাধারণ প্রতিভাবান মানুষ নয়, আমি জয়নাল ও রফিকুলের মতো অতি সাধারণ, অথচ সম্পূর্ণ অসাধারণ আরও দু-একজন মানুষের কথাই বলতে চাই। যেমন চটগ্রামের ওষুধ কোম্পানির সাবেক সেলসম্যান কাজী মোহাম্মদ আলী, তাঁর কথাও পড়েছি প্রথম আলোতে। বাবা রেলওয়ের সামান্য কর্মচারী, শৈশব থেকে দুঃখ-কষ্টে বড় হয়েছেন। পরে এপাড়া–সেপাড়া ঘুরে ওষুধ বিক্রি করতে এসে অন্য মানুষের অসহায়ত্বের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন। সবচেয়ে অসহায় বোধ করেছেন ক্যানসারে আক্রান্ত মানুষদের দেখে। যেন অবধারিত মৃত্যুপথযাত্রী, তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই। তখনই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, যদি কখনো সাধ্যে কুলোয় সেসব হতভাগ্যদের পাশে দাঁড়াবেন। ৪০ বছর ধরে অল্প অল্প করে জমিয়েছেন ৫০ লাখ টাকা। সে অর্থ দিয়ে তিনি কী করেছেন জানেন? জমানো পুরো টাকাটা তিনি তুলে দিয়েছেন চটগ্রামের এক ক্যানসার হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতির হাতে।

এখন পর্যন্ত যাঁদের কথা বললাম তাঁরা সবাই পরিণত বয়সের। কী করছেন, কেন করছেন, সে বিষয়ে সম্পূর্ণ সচেতন। লেখাটা শেষ করতে চাই এক তরুণীর গল্প বলে। ওডিশার এক অজপাড়াগাঁয়ের কৃষক পরিবারের মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী চারুলতা বারিক। তাঁর কথা জেনেছি আনন্দবাজার পত্রিকার কল্যাণে। তিন বছর আগে জন্মদিনের উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন একটি স্মার্টফোন। এর মাধ্যমে কীভাবে টুইট করা যায় সে কাজটা শিখেছিলেন এক বন্ধুর কাছ থেকে। বিপদগ্রস্ত মানুষের খোঁজ পেলে টুইট করে সে কথা জানিয়ে সাহায্যের অনুরোধ করতেন মুখ্যমন্ত্রী থেকে পঞ্চায়েতের নেতাদের। কাজটা শুরু করেছিলেন নিজ গ্রামের এক বৃদ্ধার বিধ্বস্ত বাড়ি দেখে। পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই, বৃষ্টিতে ভিজে সে বাড়ির চালচুলো গেছে। ছবিসহ সে বৃদ্ধার অবস্থা জানিয়ে টুইট করেছিলেন স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তাদের। চট করে ফল মিলে যায়, সরকারি উদ্যোগে বৃদ্ধার ভাঙা বাড়ি মেরামত হয়ে যায়। আর ফিরে তাকাতে হয়নি চারুলতাকে, এ পর্যন্ত প্রায় হাজার পাঁচেক মানুষ চারুলতার টুইটারের কল্যাণে ছোট-বড় বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়েছে।

আরও পড়ুন

বলবেন, এ আর এমনকি, আমরাও পারি। একদম ঠিক, চাইলে আপনিও পারেন। পৃথিবী বদল মানে বিপ্লব নয়, ক্ষমতা দখল নয়। অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মানবিক কাজ, তারাও পৃথিবী বদলে দেওয়ার প্রথম পদক্ষেপ। জয়নালের হাসপাতালে প্রতিদিন যে দশজন রোগী, অথবা রফিকুলের বৃদ্ধাশ্রমে যে জনা আটেক মানুষ মাথার ওপর ছাদ পেয়েছেন, পেয়েছেন প্রতিদিনে আহার, তাঁদের জন্য ঘাড়ের ওপর সমর্থনের এই শ্রদ্ধাস্পর্শটুকুর মূল্য অপরিসীম। তাঁদের উদ্যোগে যে কাজ শুরু, ক্রমে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন আরও অনেকে। জয়নালের হাসপাতালের কথা জানার পর দেশ-বিদেশ থেকে সাহায্য এসেছে। রফিকুলের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে স্থানীয় অ্যাপেক্স ক্লাব।

গান্ধীজি একটা কথা বলতেন। যারা পরিবর্তন চায়, শুধু কথা না বলে তাদেরই পরিবর্তনের এজেন্ট হতে হবে, হতে হবে দিনবদলের প্রতিনিধি। হোক না সামান্য কাজ, একদিন সে কাজই বদলে দেবে গ্রাম, বদলে দেবে দেশ, বদলে দেবে পৃথিবী।

  • হাসান ফেরদৌস প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক