ইউক্রেনের সেনাবাহিনী রাশিয়ায় ঢুকে পড়লে পরিণতি হবে কী?

ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান কাইরিলো বুদানভ সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে ইউক্রেনের উচিত যুদ্ধটা রাশিয়ার ভূখণ্ডে নিয়ে যাওয়া।ছবি : এএফপি

রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন সংবাদ সংস্থা তাসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে ড্রোন হামলা চালিয়ে ক্রিমিয়া সেতু উড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা ঠেকিয়ে দিয়েছে মস্কো। রুশ বাহিনী ড্রোন ধ্বংস করার পর এ খবর প্রকাশ করে তাস।

প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, প্রসিদ্ধ এই সেতুটি তিন দফা ধ্বংসের চেষ্টা চালায় ইউক্রেনীয় বাহিনী।

সমুদ্রপথের হামলা থেকে ক্রিমিয়া সেতু রক্ষার জন্য রাশিয়ানরা নিমজ্জিত জাহাজ দিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করেছেন। এই প্রতিবন্ধকতা যেকোনো আক্রমণকারী জলযানকে বাধা দিতে পারবে এবং সেটা ধ্বংস করার সুযোগ তৈরি করে দেবে।

সামরিক সূত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের প্ররোচনায় এবং তাদের দেওয়া সামরিক সহায়তায় ইউক্রেনীয় বাহিনী ক্রিমিয়া সেতু ধ্বংসের অভিযানে নেমেছে। সূত্র অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি করা অত্যাধুনিক সেন্সর সমৃদ্ধ ড্রোন এবং তাদের গোয়েন্দা ব্যবস্থা কাজে লাগিয়ে ইউক্রেন এই হামলা চালাচ্ছে।

যুদ্ধের এখানকার পর্যায় হলো, ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলে পাল্টা আক্রমণ পরিচালনা করছে ইউক্রেনীয় বাহিনী। সেই অভিযানকে সমর্থন করার জন্য এবং রুশ বাহিনীর প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কতটা নাজুক, সেটা প্রমাণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অত্যাধুনিক সামরিক উপকরণ দিয়ে ক্রিমিয়া সেতুসংলগ্ন এলাকায় হামলা করা হচ্ছে।

ক্রিমিয়া সেতুতে চালানো হামলা প্রতিহত করা হয়েছে—এটা ছাড়া রাশিয়ানদের পক্ষ থেকে আর কোনো বিবৃতি আসেনি।

কার্চ প্রণালির ওপর অবস্থিত ক্রিমিয়া সেতু রাশিয়ার মূল ভূমির সঙ্গে ক্রিমিয়াকে সংযুক্ত করেছে। এটি মূলত সড়ক সেতু। কিন্তু মালবাহী ট্রেনও এ সেতু দিয়ে চলাচল করে। ক্রিমিয়া, খেরসন, জাপোরিঝঝিয়া অঞ্চলে সামরিক অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে এটি রাশিয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পথ। এই সেতুটি রাশিয়ার জন্য কৌশলগতভাবে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে ট্রাক বোমা হামলায় সেতুটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর যখন মেরামত করা হলো, তখন ভ্লাদিমির পুতিন মার্সিডিজ চালিয়ে সেটি ঘুরে আসেন।

ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান কাইরিলো বুদানভ সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে ইউক্রেনের উচিত যুদ্ধটা রাশিয়ার ভূখণ্ডে নিয়ে যাওয়া। এর মানে হচ্ছে, শুধু ড্রোন হামলা বা অন্তর্ঘাতমূলক হামলা নয়, ইউক্রেনের মূল সেনাবাহিনীকেও রাশিয়ার ভূখণ্ডে গিয়ে যুদ্ধ শুরু করা।

রাশিয়ার নর্ডস্ট্রিম পাইপলাইনের মতোই ক্রিমিয়া সেতু ধ্বংস করার আকাঙ্ক্ষা গোপন করেনি যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বড় প্রচেষ্টার পরও সেতুটি এখন পর্যন্ত অক্ষত রয়েছে।

খেরসন ও জাপোরিঝঝিয়া—এই দুটি অঞ্চল ইউক্রেনীয় বাহিনীর পাল্টা আক্রমণ অভিযানেরর মূল কেন্দ্র। এ অঞ্চলে রাশিয়ার প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে ভেঙে দিয়ে  জাপোরিঝঝিয়ার রাজধানী মেলিটোপল পুনর্দখল করার পরিকল্পনা রয়েছে ইউক্রেনের। কিন্তু খেরসন ও জাপোরিঝঝিয়ার সার্বিক পরিস্থিতি বলছে ইউক্রেন তাদের পাল্টা আক্রমণের যে লক্ষ্য ঠিক করেছিল, তা সফল হয়নি। এরই মধ্যে ইউক্রেনীয় বাহিনীর অনেক অস্ত্রশস্ত্র খোয়া গেছে। হতাহতের সংখ্যাও কম নয়। ইউক্রেনের সবচেয়ে সেরা সেনা ইউনিটগুলোর কয়েকটি পর্যুদস্তও হয়েছে।

আরও পড়ুন

ওয়াশিংটন এখন তাদের পক্ষ থেকে যুদ্ধের আশা জিইয়ে রাখতে ও স্থিতিশীলতা আনতে সেরা চেষ্টাটা করে যাচ্ছে। তারা এখন লড়াইয়ের তীব্রতার বিরতি দিতে চাইছে, যাতে ইউক্রেনীয় বাহিনীর জন্য নতুন করে সেনা নিয়োগ করা যায়। কিন্তু সেনা নিয়োগ দেওয়ার পর প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠাতে ছয় মাস থেকে এক বছর লেগে যাবে।

যাহোক, ইউক্রেনীয় প্রতিরক্ষা ব্যূহ ভেঙে দিতে রাশিয়ার দিক থেকে বড় যে আক্রমণ অভিযানের কথা বলা হয়েছিল, সেটা এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান হয়নি। রাশিয়ার পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল যে তারা খারকিভের কুপানিয়াস্কে বড় ধরনের আক্রমণ অভিযান শুরু করতে চলেছে। কিন্তু সেটা এখন পর্যন্ত বাস্তব রূপ পায়নি। অনেকে বলছেন, ইউক্রেনীয় বাহিনীর আরও বড় ধরনের শক্তিক্ষয়ের জন্য রাশিয়া অপেক্ষা করছে। তার আগে রাশিয়ার জেনারেলরা সত্যিকারের কোনো ঝুঁকি নিতে চান না।

কিন্তু সমস্যা হলো, রাশিয়ান বাহিনী যদি দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষা করতে থাকে, তাহলে সবকিছুর পুনরাবৃত্তি হতে থাকবে। তারা হারতে থাকলে রাশিয়ার জনগণের কাছে সেটা গ্রহণযোগ্য হবে না। রাশিয়ার ভেতরে এখন অনেকে প্রকাশ্য প্রশ্ন তুলছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে শোরও তুলছেন এই বলে যে রাশিয়ার উচিত ইউক্রেনের কাছে মাথা নত করে বাড়ি চলে আসা।

অন্যরা বলছে, রাশিয়ার উচিত জার্মানি, পোল্যান্ডসহ অন্য খানে ইউক্রেনের সামরিক ভান্ডারে আক্রমণ করা, যাতে ইউক্রেনীয় বাহিনীকে শ্বাস রোধ করা যায়।

একটি প্রস্তাবও আকর্ষণীয় মনে হচ্ছে না। কিন্তু যুদ্ধ যদি দীর্ঘায়িত হতে থাকে, তাহলে কোনো একটি ঘটনা ঘটে যেতে পারে। এ ছাড়া রুশ ভূখণ্ডে ইউক্রেনের অন্তর্ঘাতমূলক হামলা অথবা ড্রোন হামলা অব্যাহত থাকলে সেটা রাশিয়ার জনগণের মাঝে এমন রোষ তৈরি করতে পারে যে তাতে পুতিন সরকারকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে বাধ্য করতে পারে।

ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান কাইরিলো বুদানভ সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে ইউক্রেনের উচিত যুদ্ধটা রাশিয়ার ভূখণ্ডে নিয়ে যাওয়া। এর মানে হচ্ছে, শুধু ড্রোন হামলা বা অন্তর্ঘাতমূলক হামলা নয়, ইউক্রেনের মূল সেনাবাহিনীকেও রাশিয়ার ভূখণ্ডে গিয়ে যুদ্ধ শুরু করা।

বুদানভের এই বক্তব্য যদি সত্যি হয়, তাহলে বাস্তবে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ। রাশিয়া এখন যে বিশেষ সামরিক অভিযান চালাচ্ছে, সেটার চরিত্র পাল্টে গিয়ে সর্বাত্মক অভিযানে নামবে রাশিয়া। দৃষ্টান্ত হিসেবে রাশিয়া তখন কিয়েভ, ওদেসাসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ব্যাপক হামলা শুরু করবে, যাতে ইউক্রেন সরকারকে পঙ্গু করে দেওয়া যায়।

আরও পড়ুন

সাক্ষাৎকারে বুদানেভ অনেকগুলো দাবি করেছে। এর অনেকগুলো দাবিই ভিত্তিহীন। যাহোক, আমরা জানি না, বুদানেভের কোন দাবিকে রাশিয়ানরা গুরুত্ব সহকারে নিচ্ছে।
এর মধ্যে ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে বড় ঝুঁকি নেওয়া অব্যাহত রয়েছে। তারা ইউক্রেনকে ক্লাস্টার বোমা দেওয়ার পর ট্যাংকবিধ্বংসী গোলাবারুদ সরবরাহ করছে।

যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা ব্যবস্থা ব্যবহার করে রাশিয়ার লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত করার ঘটনা ইউরোপে বড় সংঘাতের শঙ্কা তৈরি করছে। ওয়াশিংটন যদি এই উত্তেজনা বাড়াতেই থাকে, তাহলে আগামী সপ্তাহগুলোতে যুদ্ধের গতি কোন দিকে মোড় নেবে, তা কেউই বলতে পারে না।

  • স্টিফেন ব্রায়েন সেন্টার ফর সিকিউরিটি পলিসির সিনিয়র ফেলো
    এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত