জি স্যার! ইয়েস স্যার!! ওকে স্যার!!!

অবস্থান কর্মসূচিতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক।
ছবি: প্রথম আলো

‘নামে কী যায় আসে?’—এ কথার আড়ালের আসল কথা হলো, নামে আসে যায়। স্কুলবেলাতেই ‘স্যার’ আর ‘ছার’ উচ্চারণ শুনে বুঝতাম—কোনটা বিজ্ঞানী ‘জগদীশচন্দ্র বসু’র নামের আগে বসবে, আর কোনটা মাসে আঠারো শ টাকা মাইনে পাওয়া গোবেচারা ক্লাসটিচার জগদীশ বিশ্বাসের নামের পরে বসবে। কেউ শিখিয়ে না দিলেও ওই বয়সেই বুঝতে পারতাম, গরিবগুরবো লোকেরা দারোগাকে ‘স্যার’ না ডেকে ‘ভাই’ ডাকলে দারোগা কেন তাঁদের ‘বাপ’ ডাকিয়ে ছাড়তেন।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ওমর ফারুক রংপুরের ডেপুটি কমিশনার (ডিসি) চিত্রলেখা নাজনীনকে ‘স্যার’ না বলে ‘আপা’ বলেছিলেন। এতে ডিসি খেপেছিলেন। ‘শিক্ষক আমি শ্রেষ্ঠ সবার...ভয় করি নাকো ধারি নাকো ধার’ টাইপের একটা চেতনায় আক্রান্ত হয়ে শিক্ষক ভদ্রলোক প্ল্যাকার্ড লিখে প্রতিবাদ করার পরই ফেসবুকে ‘স্যার’ ভাইরাল হয়ে গিয়েছে। কয়েক দিন ধরে ‘স্যার’ নিয়ে সিরিয়াস তর্কের পাশাপাশি কুতর্কের ছ্যাঁচড়ামিও চলছে।

‘স্যার’ঘটিত সারিগান যে আজকে থেকে চলছে, তা নয়। সন্তান জন্ম দেওয়ার পর ‘মা’ ডাক শোনার জন্য মায়ের মনে যে রকম আকুলিবিকুলি করে, তেমনি বিসিএস নামের সাফল্যের প্রসূতিদের একটি অংশের চির-আরাধ্য সম্বোধনের নাম ‘স্যার’। ‘মা’ ডাকে মাতৃত্ব যেভাবে পূর্ণতা পায়, তেমনি ‘স্যার’ ডাকে বেশি বেতন পাওয়া এই কর্মচারীদের পদপূর্ণতা ঘটে।

এই ‘স্যার-কাঙাল’ স্যাররা ‘স্যার’ ডাকের জন্য কতটা মরিয়া হয়ে থাকেন, তা বুঝতে যাতে অসুবিধা না হয়, সে জন্য কয়েকটা ঘটনার কথা বলছি।

আরও পড়ুন

ঘটনা-১: ‘স্যার না ডাকায় ফিরেও তাকালেন না চিকিৎসক, অবশেষে মৃত্যু’

৭০ বছরের নিরঞ্জন মণ্ডলকে ব্রেন স্ট্রোক করার পর তাঁর ছেলে বিশ্বজিৎ মণ্ডল তাঁকে নিয়ে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এসেছিলেন। জরুরি বিভাগের চিকিৎসক অমিতকে তিনি বলেছিলেন, ‘দাদা, আমার বাবাকে দেখুন।’ অমিত বলেছিলেন, ‘সবাই আমাকে “স্যার” ডাকে, আপনি “দাদা” ডাকলেন কেন?’ স্যারের বদলে দাদা ডাকায় রাগের চোটে তিনি শত অনুরোধেও নিরঞ্জনকে দেখলেন না। নিরঞ্জন চিকিৎসা না পেয়ে মারা গেলেন।

ঘটনা-২: ‘আমি বিসিএস ক্যাডার...আমাকে স্যার বলতে হবে’

যশোরের অভয়নগর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আবদুস সোবহানকে ‘স্যার’ না বলে ‘ভাই’ বলায় ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি চার সাংবাদিককে অফিস থেকে বের করে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি একজন বিসিএস ক্যাডার। আমার সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয়, জানেন না? আমাকে স্যার বলতে হবে।’

আরও পড়ুন

ঘটনা-৩: 

মাদারীপুরের শিবচর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা অনিরুদ্ধ দাশকে এক সাংবাদিক ‘ভাই’ বলায় অনিরুদ্ধ তাঁকে বলেছিলেন, ‘পরিশ্রম করে এই চেয়ারে বসতে হয়েছে।’ তাই ‘ভাই’ না ডেকে তাঁকে ‘স্যার’ ডাকতে হবে।

ঘটনা-৪

ম্যাডাম না বলায় স্থানীয় এক সংবাদকর্মীর ওপর চটে গিয়ে পাবনার বেড়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারজানা খানম বলেছিলেন, ‘আপনি জানেন না একজন ইউএনওকে স্যার বা ম্যাডাম বলতে হয়?’

তো, এই কর্মচারীদের ‘স্যারাসক্তি’র কারণ কী, তা নিয়ে এক শ পৃষ্ঠার গবেষণাপত্র হতে পারে। কিন্তু সংক্ষেপে বলতে গেলে স্যারপ্রেমের পেছনে আসলে ‘নামে আসে যায়’ তত্ত্ব কাজ করেছে।

২.

ইংরেজিতে ‘রিপাবলিক’ বললে মাথার মধ্যে যেভাবে ‘পাবলিক’ তথা সাধারণ নাগরিক ঘোরাঘুরি করে, বাংলায় ‘প্রজাতন্ত্র’ বললে একইভাবে মনের মধ্যে ‘পাবলিক’ বা নাগরিক আসে না, আসে ‘প্রজা’। ‘ছেলে’ কথাটির মধ্যে যেমন বাপের ইতিহাস লুকিয়ে আছে, তেমনি ‘প্রজা’র মধ্যে তার ওপর প্রভুত্ব ফলানো ‘রাজা’র বীজ বোনা আছে। ব্রিটিশরাজের সিলসিলা ধরে আসা প্রজাতন্ত্রের মধ্যে যে ‘প্রজা’ আছে, সেই প্রজার অবস্থান রাজার তুলনায় নিচে।

প্রজাতন্ত্র কার্যত এমন এক তন্ত্র, যেখানে প্রজার সর্বোচ্চ ক্ষমতা হলো রাজার হাতেপায়ে ধরে তাঁর দিলে দয়া জাগ্রত করে নিজের চাওয়া পূরণ করা। প্রজাতন্ত্রকে এভাবে দেখলে চোখ বন্ধ করে বলা যায়, স্বাধীন হওয়ার অর্ধশতাব্দী পর আমাদের দেশে একটি চমৎকার প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

‘প্রজা’ ও ‘নাগরিক’ যে দুই জিনিস, সেই বোধ এখন রিপাবলিকের পাবলিক বুঝতে শুরু করেছেন। তাঁদের মধ্যে এই বোধ যতই জাগ্রত হচ্ছে, ততই তাঁরা নিজেদের প্রজার বদলে নাগরিক ভাবতে শুরু করেছেন। এতে নিজেদের ‘কর্মকর্তা’ (পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রের মালিক) পরিচয় দিয়ে মনের সুখ নেওয়া এবং পাবলিকের কাছ থেকে ‘স্যার’ ডাক শুনে কানের সুখ উপার্জন করা লোকেরা বেকায়দায় পড়েছেন।

স্বাধীনতা লাভের অর্ধশতাব্দী বছর পরও আমরা বুঝতে শিখিনি, ‘প্রজা’ আর ‘নাগরিক’ কাছাকাছি জিনিস বটে, কিন্তু এক জিনিস নয়। নাগরিক হলো সেই লোক, যিনি কিনা একটি জনপদের অধিবাসী এবং সেই সূত্রে তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে অধিকার দাবি করতে পারেন। প্রজা ভিক্ষা চান আর নাগরিক অধিকার দাবি করেন।

যে সরকারি কর্মচারীরা নিজেদের ‘কর্মকর্তা’ মনে করতে ভালোবাসেন, তাঁরা ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’কে ‘গণনাগরিকতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’ হিসেবে দেখেন না। তাঁরা দেশের বাসিন্দাদের ‘প্রজা’ এবং নিজেদের ‘রাজলস্কর’ হিসেবে দেখেন। এ কারণে কোনো নাগরিক ‘স্যার’ না বলে ‘ভাই’ বললেই তার মধ্যে তিনি রাজাজ্ঞা লঙ্ঘন খুঁজে পান। এতে তাঁদের গায়ে জ্বলুনি শুরু হয়।

সমস্যা হলো ‘প্রজা’ ও ‘নাগরিক’ যে দুই জিনিস, সেই বোধ এখন রিপাবলিকের পাবলিক বুঝতে শুরু করেছেন। তাঁদের মধ্যে এই বোধ যতই জাগ্রত হচ্ছে, ততই তাঁরা নিজেদের প্রজার বদলে নাগরিক ভাবতে শুরু করেছেন। এতে নিজেদের ‘কর্মকর্তা’ (পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রের মালিক) পরিচয় দিয়ে মনের সুখ নেওয়া এবং পাবলিকের কাছ থেকে ‘স্যার’ ডাক শুনে কানের সুখ উপার্জন করা লোকেরা বেকায়দায় পড়েছেন। সংখ্যায় অতি নগণ্য হলেও কিছু প্রজা এখন নিজেদের নাগরিক তথা রাষ্ট্রের মালিক এবং তথাকথিত কর্মকর্তাদের বেতনভুক্ত কর্মচারী ভাবতে শিখে গেছেন।

মালিক হয়ে নাগরিক যদি চাকরকে স্যার বলেন, তাতে আমলার হয়তো গৌরব হয়, কিন্তু নাগরিকের গ্লানি কম হয় না।

নাগরিক নিজেকে প্রজাতন্ত্রের প্রজা না ভেবে নাগরিক ভাবতে শিখছে, ভাবতে খারাপ লাগছে না।

  • সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
    [email protected]