মাখোঁ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে ফরাসিরা, কী হবে ফ্রান্সের ভবিষ্যৎ?

গত ২৫ এপ্রিল সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে মাখোঁ তাঁর ইউরোপ নিয়ে ভাবনা তুলে ধরেনছবি : রয়টার্স

ভবিষ্যৎ ইউরোপ নিয়ে স্বপ্নদর্শী যে বক্তব্য সাম্প্রতিক সময়ে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট দিয়ে চলেছেন, সেখানে তিনি ইউরাপীয় ইউনিয়নের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, হয় নিজেদের সামরিক শক্তিতে রূপান্তরিত করো, না হয় ‘মৃত্যুর মোকাবিলা করো; কিন্তু ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর আসন একটি দীর্ঘ গোধূলিকালের মধ্যে পড়েছে। কেননা, আগামী জুন মাসে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচন। সেই নির্বাচনে তাঁর দল অতিমন্দা পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে যাচ্ছে।

মাখোঁর অজনপ্রিয়তার কারণেই তাঁর মধ্যপন্থী ইউরোপ সমর্থক রেনেসাঁ পার্টি মতামত জরিপে কট্টর ডানপন্থী মেরিন লঁ পেনের ন্যাশনাল র‌্যালি থেকে অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে। ইউরোপীয় পার্রামেন্টের নির্বাচনে লঁ পেন প্রার্থীদের যে তালিকা দিয়েছেন, তার নেতৃত্ব দিচ্ছেন জর্ডান বারডেলা।

বারডেলা একজন জনতুষ্টিবাদী নেতা ও অভিবাসনবিরোধী রাজনীতিতে একজন উঠতি তারকা। অন্যদিকে রেনেসাঁ পার্টি এখনো প্রার্থী তালিকা দিতে পারেনি। কিন্তু প্রার্থীদের প্রধান হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন স্বল্প পরিচিত ভ্যালেরি হ্যায়েরকে।

আরও পড়ুন

সাম্প্রতিক জরিপে ন্যাশনাল র‌্যালি যেখানে ৩১ শতাংশ সমর্থন পেয়েছে, সেখানে রেনেসাঁ পার্টি পেয়েছে মাত্র সাড়ে ১৭ শতাংশ সমর্থন। পাঁচ বছর আগে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সর্বশেষ নির্বাচনে দুই দলের অবস্থান সমানে-সমান ছিল।

ইউরোপীয় পার্লামেন্টের এই নির্বাচন মাখোঁর জন্য একটা পরীক্ষা। তার কারণ হলো, ২০২৭ সালে ফ্রান্সে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের এটাই বড় মঞ্চ। ২০২৭ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে টানা চতুর্থবারের মতো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দিয়েছেন মেরিন লঁ পেন।

মাখোঁ তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদে এলিসি প্রসাদে (ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতির সরকারি ভবন) সবে দুই বছর পার করছেন। কিন্তু ফ্রান্সের পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় এখনই তাঁকে ধুঁকতে হচ্ছে। মাখোঁর সরকার এই মেয়াদে স্থায়ীভাবে অনাস্থায় পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।

ইউরোপে মাখোঁর প্রভাবও ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। তার মূল কারণ হলো, ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে তাঁর দলের উদারপন্থী সদস্যরা আসন হারাতে চলেছেন। এ ছাড়া ইউরোপের দেশে দেশে ডানপন্থী দলগুলোর দিকে ভোটাররা ঝুঁকে পড়ায় ইউরোপীয় পার্লামেন্টে উদারপন্থী নেতার সংখ্যাও কমে যাচ্ছে।

মাখোঁ যৌথ অর্থায়নে ইউরোপের জন্য একটি প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলেছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার জন্য আরও বেশি রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপযুক্ত এবং সুরক্ষাবাদী অর্থনৈতিক নীতির কথা বলেছেন। কিন্তু জার্মানি, নেদারল্যান্ডস কিংবা নর্ডিক দেশগুলোকে এসব নীতি মানানো কঠিন।

এ ছাড়া, ক্রমধারাবাহিক উচ্চ বাজেটঘাটতি আর পর্বতপ্রমাণ ঋণের কারণে অনেকেই ফ্রান্সের অবস্থানকে খারাপ চোখে দেখছেন। সে কারণে নির্বাচনের পর ফ্রান্সকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের তদন্তের মুখে পড়তে হবে।

ফ্রান্সের সব দুর্দশার জন্য ৪৬ বছর বয়সী প্রেসিডেন্টকে এককভাবে দায়ী করা হয়। সরকার পরিচালনাকে এমন একটি ব্যক্তিগত বিষয়ে পরিণত করেছেন যে ভোটাররা জীবনযাত্রার ব্যয়, তরুণদের মধ্যে সহিংসতা বাড়া কিংবা গ্রীষ্মকালীন প্যারিস অলিম্পিক গেমসে সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকি—সব বিষয়েই মাখোঁকে দোষারোপ করেন।

মাখোঁর নিজস্ব গ্রুপের একজন জ্যেষ্ঠ এমইপি (ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্য) আমাকে বলেছেন, ‘মাখোঁ মনে করেন, কেউ শোনেননি এমন একজনকে প্রধান প্রার্থী করা কোনো ব্যাপারই না। কারণ, ইউরোপপন্থী ভোটারেরা মাখোঁর প্রার্থী হিসেবেই তাকে ভোট দেবেন। সবকিছুই এলিসি প্রাসাদ থেকে নির্ধারিত হয়। সে কারণে আমরা দৈববাণীর জন্য অপেক্ষা করে  থাকি।’

আরও পড়ুন

মাখোঁর রেনেসাঁ পার্টি এখন পর্যন্ত জানে না ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে তাদের দলীয় প্রার্থী কারা। কেননা, ৭ মে প্রেসিডেন্ট মাখোঁ তাঁদের নাম ঘোষণা করবেন। বর্তমান এমইপিরা তাঁদের প্রার্থিতা নিশ্চিত করার জন্য ভেতরে-ভেতরে জোর লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। কেননা, জোটের চারটি দল তালিকায় তাঁদের প্রার্থী ঢোকানোর জোর চেষ্টা করে চলেছেন। আবার প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে লিঙ্গ সমতাও থাকতে হবে।

এত সব চাপের কারণে প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করা কঠিন একটি কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদায়ী পার্লামেন্টে ফ্রান্সের মধ্যপন্থীদের আসন ছিল ২৩টি; আর সর্বশেষ জরিপ বলছে, সেটি কমে এবার ১৩–তে গিয়ে ঠেকবে।

রেনেসাঁ পার্টি এবার মধ্য-বামপন্থীদের দিক থেকেও বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে। সমাজতন্ত্রীদের দলনেতা করা হয়েছে আরেক উঠতি তারকা রাফায়েল গ্লুকসম্যানকে। সর্বশেষ জরিপে তিনি ১৩ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। দার্শনিক আর্দ্রে গ্লুকসম্যানের বুদ্ধিজীবী সন্তান ইউক্রেনকে সমর্থন করায় এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের পক্ষে জোরালো অবস্থান নেওয়ায়, তাঁর পক্ষে জনসমর্থন ব্যাপকভাবে বেড়েছে। মাখোঁ ও চরম-বামপন্থী জঁ-লুক মেলেশনের সমর্থকদের একটি অংশ রাফায়েল গ্লুকসম্যানের দিকে ঝুঁকছেন।

আরও পড়ুন

অন্যদিকে ডানপন্থী শিবিরের রাজনীতিতে ফ্রান্সের মূলধারার রক্ষণশীল দল রিপাবলিকান পার্টিও জুনের নির্বাচনে বড় ধাক্কা খেতে চলেছে। সবকিছু ছাপিয়ে মেরিন লঁ পেনের ন্যাশনাল র‌্যালি ফ্রান্সের ডানপন্থী শিবিরে নিজেদের অবস্থান সবচেয়ে পোক্ত করে ফেলেছে।

রাজনৈতিক বিজ্ঞানী এবং নির্বাচনবিশেষজ্ঞ চলি মরিন সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর বইয়ে (উই হ্যাভ ট্রাইড এভরিথিং এলস) যুক্তি দিয়েছেন, আগামী নির্বাচনে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট হতে পারে লঁ পেন। কেননা, ফ্রান্সের ভোটাররা দেখতে পাচ্ছেন যে ডান, বাম ও মধ্যপন্থী প্রেসিডেন্টরা তাঁদের সমস্যা সমাধানে  ব্যর্থ হয়েছেন। অনেকে যেমনটা মনে করছেন ফ্রান্স ক্ষয়ের পথে হাঁটছে, সেই অবস্থানকেও পাল্টে দিতে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন।

অবশ্য এটা আগাম ধারণা করা যেতে পারে। ২০২৭ সাল আসতে এখনো অনেক বাকি। মাখোঁ তার হারানো অবস্থান পুনরুদ্ধার করার সুযোগ পেয়ে যেতে পারেন। যদিও সেটি খুব সহজ নয়। মাখোঁ তার মন্ত্রিসভা ঢেলে সাজাতে পারেন। অবশ্য সম্প্রতি তিনি মন্ত্রিসভায় যে রদবদল করেছেন, তাতে প্রভাব পড়েছে সামান্যই।

তাঁর বিরুদ্ধে যদি অনাস্থা আসে, তিনি পার্লামেন্ট বিলুপ্ত করে দিয়ে নতুন নির্বাচন দিতে পারেন। কিন্তু সেটি হবে ন্যাশনাল র‌্যালির জন্য বড় বিজয়। জনপ্রিয় বিষয় নিয়ে তিনি গণভোটও দিতে পারেন। সে ক্ষেত্রে সেই গণভোটকে ভোটাররা অজনপ্রিয় প্রেসিডেন্টকে শাস্তি দেওয়ার সুযোগ হিসেবে নিতে পারে।

দেশের রাজনীতিতে মাখোঁর এই যে দুর্দশা, তা থেকে তাঁকে একমাত্র পরিত্রাণ দিতে পারে ইউরোপে নেতৃত্বের যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, সেই জায়গাটা যদি তিনি নিতে পারেন। ফ্রান্সের সোরবোন বিশ্ববিদ্যারয়ে মাখোঁ তাঁর ভাষণে ইউরোপের জন্য বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরেন।

মাখোঁ যৌথ অর্থায়নে ইউরোপের জন্য একটি প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলেছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার জন্য আরও বেশি রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপযুক্ত এবং সুরক্ষাবাদী অর্থনৈতিক নীতির কথা বলেছেন। কিন্তু জার্মানি, নেদারল্যান্ডস কিংবা নর্ডিক দেশগুলোকে এসব নীতি মানানো কঠিন।

ইউরোপের জন্য মাখোঁর এই বড় দৃষ্টি তাঁর দলকে নির্বাচনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে পারবে না। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নে তাঁর দাঁড়ানোর একটা জায়গা তৈরি করে দিতে পারে।

  • পল টেইলর, ইউরোপিয়ান পলিসি সেন্টারের জ্যেষ্ঠ ভিজিটিং ফেলো
    দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে