সরকারিভাবে নদী মারার ফল ‘ভবদহ জলাবদ্ধতা’

ভবদহে কপালিয়া বাজারের পাশে হরি নদে এই সেতুটি নদের প্রকৃত মাপের চেয়ে অনেক ছোট। পানি উন্নয়ন বোর্ড দুই পাশে মাটি ফেলে সেই সেতুর মাপের চেয়ে আরও সংকুচিত করেছে নদটিকেছবি: তুহিন ওয়াদুদ

নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ঠিক না রাখলে পরিণতি কত ভয়ংকর হতে পারে, তা যশোরের ভবদহে দেখে এলাম। গণমাধ্যমসূত্রে দীর্ঘকাল ধরে যশোরের ভবদহের জলাবদ্ধতার কথা শুনে আসছি। সরেজমিন সেই জলাবদ্ধতার কারণ অনুসন্ধান করে এলাম। ভবদহে জলাবদ্ধতার যে ধরন দেখে এলাম, দেশে সরকারিভাবে এমন জলাবদ্ধতা তৈরি করার দৃষ্টান্ত অনেক আছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড এই কাজে সিদ্ধহস্ত।

ভবদহ জলাবদ্ধতা বোঝার আগে আমাদের সেখানকার নদী সম্পর্কে ধারণা নিতে হবে। যশোর সদর উপজেলা থেকে মুক্তেশ্বরীর নামে একটি নদী চলে এসেছে অভয়নগরের দিকে। মাঝপথে একটি প্রবাহের সঙ্গে মিলিত হয়ে মুক্তেশ্বরীর নাম হয় টেকা।

অভয়নগর বাজারের ঠিক পাশেই শ্রী নামে একটি নদী এসে মিলিত হয়েছে টেকা নদীর সঙ্গে। এরপর টেকা নাম বদলে হয়েছে হরি নদ। ঠিক যেখানে হরি নাম হয়েছে, তার বাঁ তীর থেকে শ্রী নামে আরেকটি নদী বিল ডাকাতিয়া দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। হরি নদের ভাটিতে আপারভদ্রা নামে আরেকটি নদী এসে মিলিত হয়েছে। তখন হরি নদের নাম হয়েছে তেলিগাতী গ্যাংরাইল, যা শিবসা নদী হয়ে চলে গেছে সমুদ্রে।

ভবদহ বাজার থেকে নদীর ভাটিতে প্রচুর পলি জমেছে। নদীটির দুই দিকে অনেকাংশ অবৈধ দখলদারদের হাতে চলে গেছে। মাছের ঘের, দোকানপাট, বাড়িসহ নানা স্থাপনা গড়ে উঠেছে নদীতে। দেখলাম, পানি উন্নয়ন বোর্ড হরি নদের মাটি তুলে নদের ভেতরে ফেলেছে। ফলে নদটি অনেক সংকুচিত হয়েছে। জোয়ারের সময় সমুদ্রের লবণাক্ত পানি উজানে চলে আসে। এটাই প্রাকৃতিক নিয়ম।

পানি উন্নয়ন বোর্ড ষাটের দশকে হরি নদের ভবদহ নামক স্থানে জোয়ারের পানি যাতে আসতে না পারে, সে জন্য ২১ ভেন্টের একটি স্লুইসগেট নির্মাণ করে। কেবল তা–ই নয়, শ্রী নামের উপনদী এবং শাখানদী—উভয় অংশের মুখ বন্ধ করা হয়েছে। হরি নদের শাখা হিসেবে যে অংশ প্রবাহিত হতো, সেটিও ৪০০-৫০০ ফুট প্রশস্তের।

২১ ভেন্টের স্লুইসগেট তৈরি করার মাধ্যমে সমুদ্রের লোনাপানি টেকা নদী ও শ্রী নদীতে যাওয়া বন্ধ করা হয়েছে। এতে প্রথম কয়েক বছর লবণাক্ত জোয়ারের পানির প্রবাহ বন্ধ করে চাষাবাদ বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়েছিল। ১৫-২০ বছরের মধ্যেই স্লুইসগেটের ভাটিতে প্রচুর পলি জমা হয় এবং বর্ষার পানি স্লুইসগেট খুলে দিলেও আর নিচে নামে না। কারণ, ভাটিতে পলি পড়ে অনেক উঁচু হয়েছে। গত শতকের আশির দশক থেকে ক্রমে জলাবদ্ধতা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।

ভবদহ এলাকায় অনেক নিম্নাঞ্চল আছে। ভবদহের যে স্থানে ২১ ভেন্টের স্লুইসগেট আছে, তার উজানে ৫২টি নিম্নাঞ্চল আছে। নদীর ডান তীর–সংলগ্ন আরও ১২৯টি নিম্নাঞ্চল আছে। আগে এগুলোতে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করত। এখন লবণাক্ত পানি প্রবেশ করে না। কিন্তু ভাটি উঁচু হওয়ার কারণে অভয়নগর থেকে শুরু করে যশোর জেলা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় জলাবদ্ধতা হয়। জলাবদ্ধতায় কয়েকটি উপজেলায় বাড়িঘর-সড়ক পানিতে তলিয়ে যায়।

নদীকে নদীর মতো থাকতে দেওয়া না গেলে ভবদহ জলাবদ্ধতা দূর হবে না। বর্তমানে ভবদহ এলাকায় ঘেরপদ্ধতিতে প্রচুর মাছ চাষ করা হয়ে থাকে। নদী উন্মুক্ত থাকলে ঘেরপদ্ধতিতে মাছ চাষ করা কঠিন হবে না। ভবদহ সংকট নিরসনে দীর্ঘ মেয়াদে পরিবেশ-প্রতিবেশের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে

ভবদহ জলাবদ্ধতা থেকে উত্তরণে বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দুবার ড্রেজার মেশিনও আনা হয়েছিল খননের জন্য। এ ছাড়া কয়েকবার খনন করা হয়েছে। কিন্তু খননের কয়েক বছরের মধ্যে আবার পলি পড়ে ভরাট হয় নদী। একবার এ নদীর জোয়ারের পানি একটি বিলের সঙ্গে সংযোগ দেওয়া হয়েছিল। স্থানীয় ব্যক্তিদের ভাষ্য অনুযায়ী, সেটাতে কিছুটা ভালো ফল পাওয়া গেছে।

ভবদহ এলাকায় দেখলাম, ২১ ভেন্ট এবং ৬ ভেন্টের উজানে মোট ২০টি পাম্প দিয়ে বর্ষা মৌসুমে পানি তুলে ভাটিতে দেওয়া হয়। আরেকটি ৩ ভেন্টের স্লুইসগেট তৈরি করেছে বিএডিসি। স্থানীয় লোকজন বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ সাপেক্ষে সেখানেও পাম্প চালু করেছে। কেবল পাম্প করে পানি তুলে জলাবদ্ধতা দূর করা সম্ভব নয়।

যশোরের অভয়নগর উপজেলার ভবদহে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ২১ ভেন্টের এই স্লুইস গেটটি ভবদহ জলাবদ্ধতার প্রধান কারণ
ছবি: তুহিন ওয়াদুদ

স্থানীয় ব্যক্তিরা মনে করেন, টিআরএম (টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট) পদ্ধতিতে সমস্যার সমাধান হতে পারে। টিআরএম পদ্ধতিতে উপকূলীয় নদীর সমস্যা সমাধান হতে হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু টিআরএম বলতে স্থানীয় মানুষ যা ভাবেন, সেটাই উপযুক্ত পদ্ধতি কি না, ভাবতে হবে। স্থানীয় ব্যক্তিদের অনেকে টিআরএম পদ্ধতি সম্পর্কে যা বোঝালেন, তা অনেকটা এ রকম—স্লুইসগেট ঠিক রেখে পাশ দিয়ে হরি নদে আসা জোয়ারের পানি একটি–দুটি বিলের সঙ্গে সংযোগ দিলে সমাধান হবে। তখন সংযোগ দেওয়া বিল ভরাট হবে। যত বছরের জন্য যে বিলের সঙ্গে সংযোগ দেওয়া হবে, ওই বিলের যাঁরা মালিক, তাঁদের ওই কয় বছরের জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

মুক্তেশ্বরী, হরি, শ্রী, আপারভদ্রা, তেলিগাতী গ্যাংরাইলসহ সংযুক্ত নদ–নদীর সব অবৈধ দখল উচ্ছেদ করতে হবে। প্রকৃত মাপ ধরে এমনভাবে খনন করতে হবে, যাতে পানি দ্রুত নেমে যায়। সংযুক্ত সব উপনদী এবং শাখানদীর সংযোগ উন্মুক্ত করতে হবে। সেতুবিহীন আড়াআড়ি সড়কে সেতু স্থাপন করতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় ২১ ভেন্টের যে স্লুইসগেটটি তুলে দেওয়া। ২১ ভেন্ট স্লুইসগেট করার সময় নদীর প্রবাহ অনেক ছোট করা হয়েছে। নদীর প্রকৃত প্রস্থ অনুযায়ী প্রবাহ সচল রাখতে হবে। কেবল একটি সেতু সেখানে করতে হবে।

নদীকে নদীর মতো থাকতে দেওয়া না গেলে ভবদহ জলাবদ্ধতা দূর হবে না। বর্তমানে ভবদহ এলাকায় ঘেরপদ্ধতিতে প্রচুর মাছ চাষ করা হয়। নদী উন্মুক্ত থাকলে ঘেরপদ্ধতিতে মাছ চাষ করা কঠিন হবে না। ভবদহ সংকট নিরসনে দীর্ঘ মেয়াদে পরিবেশ-প্রতিবেশের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

জানতে পেরেছি, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে হরি নদ খননের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ভবদহ সংকট নিরসনে বিশেষজ্ঞদের সমীক্ষাপূর্বক একটি স্থায়ী সমাধানের দিকে যেতে হবে। আমরা চাই, ভবদহের স্থায়ী সমাধান। নদী বাঁচুক, জীববৈচিত্র্য বাঁচুক, বাঁচুক মানুষ।

  • তুহিন ওয়াদুদ রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং রিভারাইন পিপলের পরিচালক

    [email protected]