এটা যুদ্ধ নয়, ফিলিস্তিনিদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদের অভিযান

বর্তমানে গাজার ওপর যে হামলা চলছে, সেদিকেই বিশ্বের দৃষ্টি ঘুরিয়ে রেখে পশ্চিম তীরে অবৈধ দখলদারি বাড়ানো হচ্ছে

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) কৌঁসুলি করিম খান হামাসের হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের চালানো পাইকারি হামলার বিষয়ে গত ৩০ অক্টোবর নিজের বক্তব্য তুলে ধরেছেন।

সেখানে করিম খান বলেছেন, গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের যেসব জায়গায় হামাস হামলা চালিয়েছে, সেসব জায়গা ঘুরে তিনি বাস্তব অবস্থা দেখার চেষ্টা করেছেন। সেখানকার সাধারণ মানুষের মধ্যে কী পরিমাণ আতঙ্ক ছড়িয়েছে এবং মানুষেরা কীভাবে স্বজন হারানোর ব্যথা নিয়ে দিন পার করছেন, এসব তিনি সবিস্তার তাঁর বক্তব্যে বলেছেন।

ইসরায়েলিদের দুর্দশার বর্ণনার এক ফাঁকে অবশ্য তিনি দু-এক লাইন গাজার কথাও বলেছেন। গাজা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, পরিস্থিতি সরেজমিন দেখার জন্য তিনি গাজায় ঢোকার জন্য অবিরাম চেষ্টা করে যাচ্ছেন, কিন্তু এখনো তিনি সেখানে ঢুকতে পারেননি।

আইসিসির কৌঁসুলি ইসরায়েল বা ফিলিস্তিনের মানুষের দুর্দশার বর্ণনা কতটা নিরপেক্ষভাবে দিয়েছেন, তাতে অবশ্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আসে যায় না। কারণ, আন্তর্জাতিক আইন ও প্রতিষ্ঠানগুলোর বর্ণবাদী ও ঔপনিবেশিক ভিত্তি এমনভাবে গড়া হয়েছে, যাতে ফিলিস্তিনিদের দুর্দশাকে গৌণ মাত্রার গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়ে থাকে। করিম খান তাঁর বক্তব্যে বলেছেন, ২০১৪ সালের আগে গাজা ও পশ্চিম তীরে ইসরায়েল যুদ্ধাপরাধ করেছিল বলে যে অভিযোগ আছে, সে বিষয়ে আইসিসির তদন্ত চলমান।

খানের বক্তব্যে একটি প্রশ্ন না তুলে আর উপায় থাকে না। সেটি হলো, ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ ২০১৪ সাল থেকে আইসিসি তদন্ত করে যাচ্ছে এবং এখনো তদন্ত শেষ করে বিচার শুরু করা না গেলেও এক বছরের মধ্যেই কী করে ইউক্রেনে যুদ্ধাপরাধ সংঘটনের জন্য রাশিয়াকে অপরাধী সাব্যস্ত ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা সম্ভব হলো?

ইসরায়েলকে কোনো অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত করা যাচ্ছে না। অথচ ইসরায়েলের নেতারা কোনো রকম রাখঢাক না করে একেবারে প্রকাশ্যে বলেছেন, ফিলিস্তিনিদের ‘সম্মিলিত সাজা’ দিতে হবে এবং তাঁদের জাতিগতভাবে নির্মূল করতে হবে। খোদ ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়ায়োভ গালান্ত ফিলিস্তিনিদের ‘নররূপী জানোয়ার’ উল্লেখ করে গাজার ‘সবকিছু নিশ্চিহ্ন’ করে ফেলতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন।

ইসরায়েল ও পশ্চিমারা বলে আসছে, হামাস বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের জিম্মি করে লড়াই করতে থাকায় আক্রমণের মাঝে পড়ে ‘আনুষঙ্গিক ক্ষয়ক্ষতি’ (কোলেটেরাল ড্যামেজ) হিসেবে হাজার হাজার ফিলিস্তিনির দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু হচ্ছে। আইসিসির কৌঁসুলির বক্তব্যে ঠিক একই ধরনের সুর লক্ষ করা গেছে।

ইসরায়েলের দখলদারির বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের অন্যতম প্রাচীন তথ্য হিসেবে ১৮৮৬ সালের ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। ওই বছর ইসরায়েলের তিকভা এলাকার কট্টর ইহুদিবাদীরা এমলাব্বিস ও আল ইয়াহুদিয়া এলাকা থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করার চেষ্টা করেছিল এবং ফিলিস্তিনিরা তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল।

অটোমান সাম্রাজ্যের শাসনামলের ফিলিস্তিনি রাজনীতিক ও অনেক বছর ধরে জেরুজালেমের মেয়রের দায়িত্ব পালন করা নেতা ইউসুফ আল খালিদি ওই সময় যথার্থভাবেই আসন্ন উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামের বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।

জায়নবাদের রাজনৈতিক জনক থিওডর হার্জেলকে হুঁশিয়ারি দিয়ে আল খালিদি বলেছিলেন, ফিলিস্তিনি জনগণ কখনোই ইহুদিদের উপনিবেশ ও জায়নবাদীদের ‘প্রভু হওয়ার’ আকাঙ্ক্ষার কাছে মাথা নত করবে না, বরং অবিচলভাবে তারা প্রতিরোধ করে যাবে। পরে ঠিক তা-ই হয়েছে। বহুবার ইসরায়েলের আগ্রাসন হয়েছে এবং প্রতিবারই ফিলিস্তিনিরা প্রতিরোধ করেছে।

ফিলিস্তিনিরা জর্ডান নদী থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত জনসংখ্যার দিক থেকে অনেক বেশি হওয়া সত্ত্বেও তারা তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। তারা ইসরায়েলি শাসনের কবলে রয়েছে। একের পর এক তাদের ভূমি দখল করে নেওয়া হচ্ছে।

বর্তমানে গাজার ওপর যে হামলা চলছে, সেদিকেই বিশ্বের দৃষ্টি ঘুরিয়ে রেখে পশ্চিম তীরে অবৈধ দখলদারি বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু এর মধ্যেও ফিলিস্তিনিরা প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। ফিলিস্তিনিরা জানে, এটি ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যকার যুদ্ধ নয়; বরং এটি ফিলিস্তিনের আদিবাসীদের ভিটেমাটি থেকে উৎখাত করার লক্ষ্যে বসতি স্থাপনকারী-ঔপনিবেশিক সহিংসতার ধারাবাহিকতা।

মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত আকারে অনূদিত

  • এমিলি বাদারিন মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি, ঔপনিবেশিকতা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একজন গবেষক