২০১৭ সালে যারা জাতীয় পর্যায়ে তৃতীয় স্থান অর্জন করেছিল, এখন তারা পাশের হাইস্কুলে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। ১৭ জনের মধ্যে ৭ জনের বিয়ে হয়েছে। ১০ নম্বর জার্সিধারী স্বরলিকা পারভীন, ১ নম্বর গোলরক্ষকসহ ৭ জন আর নেই। দুইজনের সন্তান হয়েছে। কথা হলো জান্নাতুল, তানজিলা তিথি, সুমাইয়া খাতুন, লাইজু, জামিয়া জুঁই, বিজলী লাইজু ও শিল্পীর সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী তাদের হাতে জনপ্রতি পাঁচ হাজার টাকা করে পুরস্কার দেন। আর প্রাইজমানি তারা পায় ৫০ হাজার টাকা। এলাকায় ফেরার পর, আর কোনো রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য পায়নি। কেউ খোঁজ রাখেননি। জেলা ক্রীড়া সংস্থা, মহিলা ক্রীড়া সংস্থা তাদের কোনো খোঁজ নেয়নি।
এখনো তারা খেলছে। যখন প্রতিযোগিতা থাকে, তখনই কেবল খেলে। তারা বলে, সারা বছর খেলতে চায়, উপযুক্ত প্রশিক্ষক চায়, খেলাধুলাকেই ক্যারিয়ার হিসেবে নিতে চায়। ফোনে স্বরলিকা বলেন, ‘আমার তো বিয়ে হয়ে গেছে। আমি তো পারব না, কিন্তু আমার বান্ধবীরা তো পারবে।’ এপাশে বুঝতে পাচ্ছিলাম, স্বরলিকা কাঁদছে...।
ভূরুঙ্গামারী উপজেলা সদরের বাগভাণ্ডার বিজিবি ক্যাম্প থেকে উত্তর দিকে পাথরডুবি। তারপর দুধকুমার ধরে ৩ কিলোমিটার গেলেই বাঁশজানি গ্রাম ও প্রাইমারি স্কুল। মোড়ে মোড়ে লোকজনকে বলতেই, দেখিয়ে দিচ্ছেন পথ। বোঝা গেল, এই স্কুলের সাফল্য নিয়ে তাঁদের গর্বও আছে। যখন সহযাত্রী হামিদুল ইসলামসহ পৌঁছালাম, তখন বিকেল পৌনে চারটা।
একই মাঠে দুটি স্কুল। একটি প্রাইমারি, আরেকটি হাইস্কুল। মেয়েরা খেলছে। রেফারির ভূমিকায় শিক্ষক বায়েজীদ হোসেন। যখন তারা ২০১৭ সালে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গোল্ডকাপে জাতীয় পর্যায়ে তৃতীয় হয়, তখন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ছিলেন খালেদা খাতুন। ম্যানেজার ছিলেন সহকারী শিক্ষক বায়েজীদ স্যার। এ বছরও তারা স্কুল জেলা পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। শুনলাম পেছনের গল্প।
সেসময়ের প্রধান শিক্ষক রফিকুল ইসলাম ২০১২ সালে টিম গঠন করার উদ্যোগ নেন। প্রশিক্ষণের দায়িত্ব দেন সহকারী শিক্ষক বায়েজীদ হোসেনকে। স্কুলে রেখে প্রশিক্ষণ দেন। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন এলাকাবাসীসহ শিক্ষা কর্মকর্তারা। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা মুকুল সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখেন। পরে তিনি বদলি হলে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নেন সহকারী শিক্ষক খালেদা খাতুন। অফিস সহকারী আতিকুর, জেলা থেকে মতিন ও সহকারী শিক্ষক পুরো প্রশিক্ষণে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি জানান, উপজেলার প্রত্যেক শিক্ষকের, এলাকাবাসীর অকুণ্ঠ সমর্থনে ২০১৭ সালে এই সাফল্য আসে।
বায়েজীদ হোসেন বলেন, ‘আমি ২০০৮ সালে যোগদান করি। নিজেও একজন খেলোয়াড় ছিলাম। খেলোয়াড়দের পেছনে একজন অভিভাবক লাগে। খেলোয়াড়দের বিয়ের কারণ হলো, জাতীয়ভাবে সেরা হওয়ার পর তারা কই যাবে? খেলোয়াড় হিসেবে যে ক্যারিয়ার গড়া যায়, জাতীয় টিমে খেলানোর সুযোগ আছে, এই স্বপ্নকে বাস্তব করার কেউ না থাকলে অভিভাবকেরা কী করবেন?’
নাগেশ্বরী কলেজ মাঠে মেয়েদের ফুটবল খেলা বন্ধের মিছিল প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় লোকজন জানান, এটি একটি পরিকল্পিত ঘটনা। চার থেকে পাঁচজন বখাটেকে দিয়ে জুয়ার আসর বসানো হয় মেয়ে ফুটবলারদের খেলা উপলক্ষে। তারপর তা দেখিয়ে খেলাই বন্ধের দাবি তোলা হয়। স্থানীয় লোকজন প্রশ্ন রাখেন, এলাকাবাসী খেলার বিপক্ষে থাকলে এত নারী ফুটবলার তৈরি হয় কী করে?
কিন্তু ওই টিমের সেরা খেলোয়াড়সহ সাতজনের বিয়ে সম্পর্কে বর্তমান প্রধান শিক্ষক বাদরে জাহান বলেন, করোনার আগে ঢাকায় একটি টিমে স্বরলিকা খেলতে যায়। হঠাৎ করোনায় সবকিছু থেমে গেলে স্বরলিকার বাবা তাকে বাড়ি নিয়ে আসেন। তারপর তাকে বিয়ে দেন। একই ঘটনা অন্য সাতজনেরও। ফুটবলার ও সংগঠক নোমি নোমান জানান, খেলোয়াড়, কোচ ও সংগঠকদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ছিল। অনুশীলন বন্ধ হয়ে গেলে মেয়েরা মাঠমুখী না থাকায় বাল্যবিবাহের শিকার হতে শুরু করে। কুড়িগ্রামের সন্তান, জাতীয় দলের সাবেক কৃতী ফুটবলার ও কোচ রেহেনা পারভীন বলেন, বিভিন্ন বয়সভিত্তিক দলগুলোকে জেলায় সক্রিয় করা গেলে এই মেয়েগুলোকে যুক্ত করা যেত। প্রতি গ্রুপের জন্য কোচ ও খেলোয়াড়দের বেতন-ভাতা দেওয়া গেলে এটা ঘটত না।
বছর দুয়েক আগে ঢাকাস্থ কুড়িগ্রাম সমিতির পক্ষ থেকে ২০ জন নারী ফুটবলারের মধ্যে ১টি করে ছাগল ও ৫টি করে গাছের চারা বিতরণ করা হয়েছিল। সংগঠনের সাবেক মহাসচিব সাইদুল আবেদীন লিখেছেন, কেমন আছেন সেখানকার ফুটবলাররা, জানতে ছুটে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখা হলো স্বরলিকা পারভীনের বাবার সঙ্গে। ছাগলটির ছানা হয়েছে, ৫টি গাছের ১টি বেঁচে আছে। কিছু ছবিও তুললাম। ঘরের ভেতর স্বরলিকার সাফল্যের মেডেল ক্রেস্ট ও কাপগুলো। স্বরলিকার কথা জিজ্ঞাসা করতেই প্রত্যুত্তরে সবকিছু জানা হলে মাথার ভেতরে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। একটা প্রতিভা এভাবে শেষ হয়ে গেল!
খেলা বন্ধের মিছিলের পেছনের রহস্য
নাগেশ্বরী কলেজ মাঠে মেয়েদের ফুটবল খেলা বন্ধের মিছিল প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় লোকজন জানান, এটি একটি পরিকল্পিত ঘটনা। চার থেকে পাঁচজন বখাটেকে দিয়ে জুয়ার আসর বসানো হয় মেয়ে ফুটবলারদের খেলা উপলক্ষে। তারপর তা দেখিয়ে খেলাই বন্ধের দাবি তোলা হয়। স্থানীয় লোকজন প্রশ্ন রাখেন, এলাকাবাসী খেলার বিপক্ষে থাকলে এত নারী ফুটবলার তৈরি হয় কী করে?
কী কাজ জেলা ক্রীড়া সংস্থার
২০১৭ সালে হ্যাটট্রিক কন্যা হিসেবে খ্যাতি পায় স্বরলিকা। দল সেমিফাইনালে হেরে তৃতীয় হলেও টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হয় সে। তার হাতে দেশসেরার পুরস্কার তুলে দেওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, সদ্য ভারত-বাংলাদেশ বিলুপ্ত ছিটমহলের বাংলাদেশিদের কাছে পাওয়া প্রথম উপহার হচ্ছে স্বরলিকা পারভীন। সেই উপহারের জন্য কী করেছে জেলা মহিলা ক্রীড়া সংস্থা, এটা জানতে চাওয়া হয় সাধারণ সম্পাদক রোকসানা বেগমের কাছে। তিনি বলেন, ‘করোনার কারণে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। আমরা মূলত হ্যান্ডবল ও ভলিবল নিয়ে কাজ করি। এ দুটি নিয়ে যতটা মাতামাতি করি, মেয়েদের ফুটবল ও ক্রিকেট নিয়ে কাজ করা হচ্ছে না। ফুটবল-ক্রিকেটের মেয়েরাই কিন্তু ভলিবল-হ্যান্ডবল খেলছে। আমরা মেয়েদের সঙ্গে আছি।’
বিধিবদ্ধ ক্রীড়া ক্যালেন্ডার নেই। বয়সভিত্তিক সূচি ও টুর্নামেন্ট কখন কার সঙ্গে, সেটা নেই। আগামী দিনের স্বপ্না, রুপনা চাকমারা কীভাবে তৈরি হবে, সেটা খতিয়ে দেখা দরকার। ঔপনিবেশিক আইনে অ-খেলোয়াড়েরা নেতৃত্বে থাকে।
প্রাকৃতিক জীবনী শক্তির জায়গায় টাকা
শহরের ছেলেমেয়েরা সৈনিক পদে জায়গা পায় না। তারা ফুটবলও খেলে না। অর্থাৎ, যেখানে শারীরিক শক্তির ব্যাপার আছে, সেখানে গ্রামের চেয়ে পিছিয়ে। সারা দেশে মাঠ কমে যাচ্ছে। স্কুলের প্রাচীরে মার্কেট ও মাঠগুলো হাটে পরিণত। যেখানে হাট নেই, সেখানে আবাদি জমি। কোথাও অপরিকল্পিত ভবন। বছর বছর শিক্ষার্থী বাড়ে, কিন্তু মাঠ ছোট হয়ে আসে। কিন্তু গ্রামে ধানখেতে, চরগুলোতে চাইলেই খেলাধুলা করা সম্ভব। কিন্তু শহর? শহরে সেই সুযোগ নেই। আমাদের জাতীয় গৌরব তাই গ্রামই জোগান দেয়—সাকিব আল হাসান থেকে বান্দরবানের রুপনা চাকমা পর্যন্ত। জেলা শহরে টাকা আসে আর বাবুদের পকেটে যায়। আর দুমুঠো ভাতের জন্য স্বরলিকারা হারিয়ে যায়। ফোনের ওপাশে কাঁদে।
নাহিদ হাসান লেখক ও সংগঠক
[email protected]