১৩ জুন ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের নতুন যুদ্ধ শুরু করার মধ্য দিয়ে ভয়াবহ বিপর্যয়ের সূচনা করেছে। এ যুদ্ধে কেউই লাভবান হবে না, এমনকি ইসরায়েলের সরকারও। কিন্তু বহু মানুষের জীবনে দুর্ভোগ নেমে আসবে। দুই দেশের পাল্টাপাল্টি আক্রমণে এরই মধ্যে বহু হতাহত হয়েছেন।
দুর্ভাগ্যজনক সত্য হলো, মধ্যপ্রাচ্যে আগে এ ধরনের সামরিক পদক্ষেপ যে ব্যর্থ হয়েছে, সেই শিক্ষা পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন এ যুদ্ধকে পূর্বপ্রতিরোধমূলক (সম্ভাব্য আক্রমণ ঠেকাতে আগে থেকেই আক্রমণ করা) যুদ্ধ হিসেবে ব্র্যান্ডিং করেছেন। তেহরান যাতে পারমাণবিক অস্ত্র উৎপাদন করতে না পারে, সেটা ঠেকাতেই এ হামলা। এটা করার মধ্য দিয়ে নেতানিয়াহু আবার সেই একই কৌশলগত ভুলের পুনরাবৃত্তি করলেন, যা এর আগে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার করেছিলেন।
মধ্যপ্রাচ্যের আকাশজুড়ে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র ছুটে বেড়াচ্ছে এবং ইরানের সামরিক ঘাঁটি ও নেতাদের ওপর প্রাণঘাতী হামলা চালাচ্ছে। ইসরায়েলের এই আক্রমণ সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বকে আরও বিপজ্জনক জায়গায় পরিণত করল।
যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের নেতৃত্বে ইরাক আগ্রাসনের পুনরাবৃত্তি। ইরানে ইসরায়েলের উসকানিমূলক হামলাটি এরই মধ্যে অস্থিতিশীল হয়ে ওঠা মধ্যপ্রাচ্যে নতুন মাত্রা যোগ করবে।
নেতানিয়াহু দাবি করেছেন, তাঁর আক্রমণের উদ্দেশ্য হলো ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা ধ্বংস করে দেওয়া। এ পর্যন্ত ইসরায়েলি সেনাবাহিনী তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে। এ হামলায় ইরানের নাতানজ, ইস্পাহান ও ফরদো পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে নানা মাত্রার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে এ হামলায় ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি প্রকৃতপক্ষে থেমে যাবে, এমন সম্ভাবনা খুবই কম। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী সেটা ভালো করেই জানেন।
ইরান খুব জেনেবুঝেই তাদের নাতানজ পারমাণবিক স্থাপনাটি মাটির অনেক গভীরে নির্মাণ করেছে। কেবল শক্তিশালী বাংকার-বিধ্বংসী বোমা ছাড়া সেটা ধ্বংস করা সম্ভব নয়। ইসরায়েলের সেই সক্ষমতা নেই। এ ধরনের বোমা উৎপাদনের সক্ষমতা আছে যুক্তরাষ্ট্রের।
যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরেই ইসরায়েলকে এ ধরনের অস্ত্র সরবরাহ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে। এমনকি ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন, যারা বরাবরই ইসরায়েলি নেতাদের ও কর্মকর্তাদের প্রশ্রয় দিয়ে এসেছে, তেল আবিবকে তারা ষ্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে, এ অস্ত্র সরবরাহ করা হবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের প্রতিক্রিয়া দেখে এখনো পুরোপুরি স্পষ্ট নয় যে ওয়াশিংটন এ হামলার বিষয়ে আগে থেকে কতটা জানত। প্রথম দিকে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর এ হামলাকে ইসরায়েলের ‘একতরফা’ অভিযান বলে উল্লেখ করে নিজেদের দূরত্ব বজায় রাখে। কিন্তু এর কিছুক্ষণ পরই ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেন, তিনি এ হামলার ব্যাপারে পুরোপুরি জানতেন।
ইরানে শাসকেরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছে, ইসরায়েলের আগ্রাসন ঠেকাতে পারমাণবিক বোমা প্রয়োজন। বর্তমান বাস্তবতায় ইরানে পারমাণবিক বোমা তৈরির ব্যাপারে যাদের মধ্যে সন্দেহ ছিল, সেটা এখন আর থাকবে না। মধ্যপ্রচ্যের অন্য দেশগুলো, যেখানে তেহরানের স্বার্থ ও প্রভাব ক্রমশও কমে যাচ্ছিল, নেতানিয়াহুর এই আগ্রাসন সেসব জায়গায় ইরানি মিত্রদের মধ্যে নতুন প্রাণের জোয়ার তৈরি করবে।
এ হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা ও অনুমোদনের ব্যাপারটি এখনো একটি বড় প্রশ্ন হিসেবে রয়ে গেছে। তবে এটা নিশ্চিত, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে তেহরানের সঙ্গে পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে চলমান কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে একটি নতুন চুক্তির যে ক্ষীণ আশাবাদ জন্ম হয়েছিল, এ হামলার মধ্য দিয়ে সেটা পুরোপুরি শেষ হয়ে গেল। এটা স্বল্প মেয়াদে নেতানিয়াহুর জন্য একটি বিজয়।
কিন্তু ইরানের বিরুদ্ধে আরও পদক্ষেপ নেওয়ার সম্ভাবনাটি অনেকটাই নির্ভর করছে এই সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রকে কতটা টেনে আনা যাচ্ছে, তার ওপর। এটি তেল আবিবের জন্য একটি বড় জুয়া খেলা। কারণ, ট্রাম্পের উপদেষ্টাদের শীর্ষস্থানীয় অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপমূলক নীতির সমালোচক। এমনকি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেও যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপমূলক নীতি থেকে সরে আসাকে তাঁর রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে তুলে ধরেছেন।
ইসরায়েলের এ হামলা ইতিমধ্যেই ট্রাম্পের অন্যান্য স্বার্থের ক্ষতি করছে। এর কারণ হলো বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়ে যাচ্ছে। উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বড় ধরনের অবনতি হতে পারে। তার কারণ হলো, এ সংঘাত হরমুজ প্রণালি দিয়ে জাহাজ চলাচলে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে, যা উপসাগরীয় দেশগুলোর অর্থনীতির জন্য বড় ক্ষতির কারণ।
আবার যদি দেখা যায়, ইসরায়েল বিজয়ের পথে এগোচ্ছে, তাহলে ট্রাম্প নিঃসন্দেহে এটিকে নিজের কৃতিত্ব হিসেবে দাবি করবেন। কিন্তু নেতানিয়াহুর কৌশল যদি ক্রমশ এমন দিকে এগোয়, যেখানে তিনি ওয়াশিংটনকে আরেকটি মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধে টেনে আনতে চান, তাহলে ট্রাম্প অবশ্যই নেতানিয়াহুর প্রতি ব্যাপক ক্ষুব্ধ হবেন।
দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি হামলার যে বর্তমান পরিস্থিতি, তাতে ইসরায়েল যদি আন্তর্জাতিক নিয়ম লঙ্ঘন করে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার না করে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা ছাড়া ইরানে আর কোনো কৌশলগত অগ্রগতি অর্জন করা সম্ভব নয়।
নেতানিয়াহুর ঘোষিত দ্বিতীয় লক্ষ্য হচ্ছে ইরানের বর্তমান সরকারকে উৎখাত করা। সেটাও নাগালের বাইরে বলে মনে হচ্ছে।
ইরানের শীর্ষ সামরিক কমান্ডারদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে হত্যা করেছে ইসরায়েল। ইরানি জনগণকে তারা খোলাখুলিভাবে ইরান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু ইসরায়েলের একতরফা আগ্রাসন তেল আবিবের প্রতি ইরানিদের ক্ষোভ বাড়াবে।
আঞ্চলিক অন্য দেশগুলো, যেখানে তেহরানের প্রভাব ক্রমে কমে যাচ্ছিল, সেখানে নেতানিয়াহুর এ পদক্ষেপ আবারও ইরানের পুরোনো জোটগুলোকে নতুন প্রাণ দান করার ঝুঁকি তৈরি করেছে।
ইরানে শাসকেরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছে, ইসরায়েলের আগ্রাসন ঠেকাতে পারমাণবিক বোমা প্রয়োজন। বর্তমান বাস্তবতায় ইরানে পারমাণবিক বোমা তৈরির ব্যাপারে যাদের মধ্যে সন্দেহ ছিল, সেটা এখন আর থাকবে না। মধ্যপ্রচ্যের অন্য দেশগুলো, যেখানে তেহরানের স্বার্থ ও প্রভাব ক্রমশও কমে যাচ্ছিল, নেতানিয়াহুর এই আগ্রাসন সেসব জায়গায় ইরানি মিত্রদের মধ্যে নতুন প্রাণের জোয়ার তৈরি করবে।
তেহরানের রাজনৈতিক পরিবেশকে অস্থিতিশীল করতে ইসরায়েল যদি সফলও হয়, তাতেও মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আসবে না। ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর যা ঘটেছিল, তা থেকেই শিক্ষা নিতে হবে। এ ঘটনার পর সেখানে চরমপন্থার ব্যাপক উত্থান ঘটে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১০-এর দশকে ইসলামিক স্টেটের (আইএসআইএল বা আইএসআইএস) উত্থান ঘটে, যারা গোটা অঞ্চলজুড়ে সন্ত্রাস চালায়।
তেহরানে একটি অনুগত সরকারকে মসৃণভাবে ক্ষমতায় আনার কোনো সুযোগ ইসরায়েলের সামনে নেই। দেশ দুটির মধ্যে সরাসরি সীমানা না থাকায় ইরান দখল করে সেই চেষ্টা করা একেবারেই অসম্ভব। ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকেও এমন কোনো প্রচেষ্টাকে সমর্থন দেওয়া কল্পনা করাও কঠিন। কারণ, এতে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর হামলার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যাবে।
অন্যভাবে বলা যায়, নেতানিয়াহুর এই হামলাগুলো ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বিলম্বিত করা ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দেশটির আলোচনার পথ রুদ্ধ করার মতো কিছু স্বল্প মেয়াদি কিছু কৌশলগত সাফল্য এনে দিতে পারে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এটি ইসরায়েলের জন্য কৌশলগত বিপর্যয় ডেকে আনবে।
● ম্যাক্সিমিলিয়ান হেস ফরেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের একজন ফেলো
আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত