বাংলাদেশে হাতে গোনা জনপ্রিয় কিছু পর্যটনকেন্দ্র আছে—যার মধ্যে অন্যতম সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর এলাকা। দেশে নানা খেকোর মতো পাথরখেকোরও অভাব নেই। বহু বছর ধরে সাদাপাথর উত্তোলন করছে একশ্রেণির অসাধু ব্যক্তি। অবৈধভাবে পাথর তুলে বিক্রি আজ নতুন নয়। তবে সাদাপাথর খেয়ে একেবারে মাটি করে দেওয়ার ঘটনা খুব কমই ঘটেছে।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর দুই উপদেষ্টা সাদাপাথরের রাজ্যে ঘুরে বলেছিলেন, আর পাথর উত্তোলনে সরকার কোনো ইজারা দেবে না। সাংবাদিকদের কাছে বক্তব্য দেওয়া শেষ করার আগেই সেখানে কিছু মানুষ তাঁদের দুয়ো দেন। তাঁদের দাবি—পাথর তোলা বন্ধ করা যাবে না, তুলতে দিতে হবে। তাই তাঁরা উপদেষ্টাদের ‘ভুয়া ভুয়া’ বলে দুয়ো দেন, এমনকি আটকে দেন তাঁদের গাড়িবহর।
পাথর তোলার দাবিতে তাঁরা রাস্তা বন্ধ করেন, পর্যটকদের গাড়ি আটকান। সভা, সেমিনার—সবই তাঁরা করেছেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা এ নিয়ে কথা বলেছেন, পাথর কোয়ারি খুলে দেওয়ার ফজিলত তুলে ধরেছেন। বন্ধ থাকলে কী কী সমস্যা হবে, তা নিয়ে বিস্তর আলাপ দিয়েছেন।
অবৈধভাবে পাথর তোলা নিয়ে প্রথম আলো একাধিক প্রতিবেদন, মতামত, সম্পাদকীয় লিখেছে—কিন্তু কারও টনক নড়েনি। আজ যখন পাথর খেয়ে মাটি করে দিয়েছে, তখন সরকার, রাজনৈতিক দল, প্রশাসন, গণমাধ্যম ও সাধারণ মানুষের মুখে ‘গেল গেল’ রব উঠেছে। এই উন্মাদনা আর কিছুদিন আগে থেকে তুললে হয়তো আজ পাথর মাটি হয়ে যেত না, ভাঙা পর্যন্তই হয়তো সীমাবদ্ধ থাকত।
১২ আগস্ট একটি সেমিনারে পাথর লুটের বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘পাথর উত্তোলনে সর্বদলীয় ঐক্য দেখছি। একটি সুন্দর জিনিস কীভাবে হাতে ধরে অসুন্দর করতে হয়, সেটা শিখতে হলে বাংলাদেশে আসতে হবে। চোখের সামনে অপূর্ব সুন্দর একটি জায়গা—জাফলং—নষ্ট হতে দেখলাম, ধ্বংসলীলা দেখলাম।’
মাননীয় পরিবেশ উপদেষ্টার ঐক্যের কথা শুনে মাথায় এল ভিন্ন আলাপ। কয়েক মাস হলো দেশের সব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে একটি ঐক্যের কথা বলছে সরকার। তাদের নিয়ে দিনের পর দিন মিটিং হচ্ছে। এই ঐক্য দেশের ভালোর জন্য, জনগণের জন্য। কিন্তু এখনো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি অনেক দল। অথচ লুটপাটের জায়গায় সবাই ঐক্য করে ফেলেছে! লুটপাটের জন্য সব দল থেকে হুংকার আসে, কিন্তু দেশের ভালোর জন্য পদক্ষেপের হুংকার কম, সেখানে নীরব।
গত ৬ মে প্রথম আলোয় ‘পাথরখেকো চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিন’ শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিল—সিলেটের কোয়ারি, সংরক্ষিত অঞ্চল ও পর্যটনকেন্দ্র থেকে দেদার পাথর লুট বন্ধ করতে না পারা শুধু প্রশাসনের ব্যর্থতা ও নিষ্ক্রিয়তার প্রতিফলন নয়; সেখানকার প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্যও অশনিসংকেত। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাপনায় যে শিথিলতা তৈরি হয়েছিল, সেটাকেই সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করে একটি চক্র বেপরোয়াভাবে পাথর লুট শুরু করে। কিন্তু কে শোনে কার কথা!
এত লুটপাট, দুর্নীতি হচ্ছে—কোথাও তো রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছে লড়াই করছে না। শুধু নিজেদের উদরপূর্তির জন্যই কি ঐকমত্য হয়? এর জন্য কোনো ঐকমত্য কমিশনের প্রয়োজন পড়ে না। ইসলামী-অইসলামী, আস্তিক-নাস্তিক—সবাই এখানে একাকার। এখানে ধর্ম বা রাজনৈতিক কোনো বিরোধ নেই। লুটপাট করতে দাও—সবাই ঠিকঠাক। লুটপাটে বাগড়া দিলেই রাস্তা বন্ধ, আন্দোলন, বাগ্যুদ্ধ—আর কত কী!
সামাজিক মাধ্যমে একটি মিম ছড়িয়ে পড়েছে। মিমটিতে বাংলা সিনেমার প্রসঙ্গ টেনে আনা হয়েছে—আগে বাংলা সিনেমায় মারামারি শেষে পুলিশ এসে বলত, ‘আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না।’ তার আগেই নায়ক সবাইকে মেরে ফেলত। মারার পর পুলিশের এন্ট্রি হতো। নেটিজেনরা বলছেন, এখনকার অবস্থার সঙ্গে এই উদাহরণের মিল আছে।
আসুন, আলাপটা একটু ভিন্নভাবে করি। আমরা বিভিন্ন সময় দেখেছি—পাথর তোলার দায়ে এতজন আটক, এতজনের কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। কিন্তু যাদের আটক করা হয়, তারা কারা?
প্রথমেই মনে হতে পারে এরা পাথর লুটকারী। কিন্তু না—এরা লুটচক্রের হোতা নয়; অধিকাংশই শ্রমিক, যারা টাকার বিনিময়ে লুটেরাদের কাজ করে দেয় মাত্র। তাদের আটকালে পাথর তোলা বন্ধ হবে না—এটা জানা কথা।
এক শ্রমিক আটক হলে তখন অন্য শ্রমিক দিয়ে কাজ করায় লুটেরারা। এখন পর্যন্ত কোনো চক্রের হোতা আটকের কথা শোনা যায়নি। তাহলে কীভাবে বন্ধ হবে এই লুটপাট?
১২ আগস্ট বিএনপি পাথর লুটপাটের ঘটনায় কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাহাব উদ্দিনের পদ স্থগিত করেছে। তারা বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে—‘চাঁদাবাজি, দখলবাজিসহ বিএনপির নীতি ও আদর্শপরিপন্থী অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার সুস্পষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাহাব উদ্দিনের সব পদ স্থগিত করা হয়েছে।’
উনি যে পাথর লুটচক্র চালান, এটা কি আগে থেকে তাঁরা জানতেন না? আজ যখন এটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তখন তাঁর পদ স্থগিত করে কী লাভ হলো? এই কাজ আগে কেন করা হলো না? বা এমন কাজ আগে কেন করছে না রাজনৈতিক দলগুলো? রোগী মরার পর ডাক্তার হয়ে আবির্ভূত হয়ে কী লাভ! এমন পদ স্থগিত দিয়ে এ জাতি কী করিবে? সময় থাকতে সতর্ক না হলে কখনো ভালো কিছু আশা করা যায় না।
এত লুটপাট, দুর্নীতি হচ্ছে—কোথাও তো রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছে লড়াই করছে না। শুধু নিজেদের উদরপূর্তির জন্যই কি ঐকমত্য হয়? এর জন্য কোনো ঐকমত্য কমিশনের প্রয়োজন পড়ে না। ইসলামী-অইসলামী, আস্তিক-নাস্তিক—সবাই এখানে একাকার। এখানে ধর্ম বা রাজনৈতিক কোনো বিরোধ নেই। লুটপাট করতে দাও—সবাই ঠিকঠাক। লুটপাটে বাগড়া দিলেই রাস্তা বন্ধ, আন্দোলন, বাগ্যুদ্ধ—আর কত কী!
আজ সাদাপাথরের স্বর্গ মাটি হয়ে গেছে, কাল হয়তো অন্য কোনো জায়গা মাটি থেকে গর্তে পরিণত হবে। তাই এটা আটকাতে এখনই পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। শুধু শ্রমিকদের জেল-জরিমানা করে এসব আটকানো যাবে না। চক্রের হোতা, মূল হোতা এবং তাদের গডফাদার—যারা মদদদাতা—তাদের খুঁজে বের করতে হবে। আইনের আওতায় আনতে হবে। অন্যথায় পাথর, বালু, মাটি, গাছ—সব খেতেই থাকবে লুটেরারা। আর একে একে ধ্বংস হবে প্রকৃতি ও সৌন্দর্য।
গোলাম ওয়াদুদ প্রথম আলোর সহসম্পাদক
ইমেইল: [email protected]