পোল্যান্ডে ড্রোন পাঠিয়ে ন্যাটোকে কী বার্তা দিলেন পুতিন

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনফাইল ছবি : রয়টার্স

পোল্যান্ডের আকাশসীমায় একগুচ্ছ ড্রোন পাঠিয়েছে রাশিয়া। এর মধ্য দিয়ে ন্যাটোর সামরিক প্রতিক্রিয়া ও উত্তেজনা বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও ইউক্রেনকে অস্ত্র ও নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দিতে ইউরোপের রাজনৈতিক সদিচ্ছা কতটা আছে, তা পরীক্ষা করল রাশিয়া।

সময়টি একেবারেই কাকতালীয় নয়। মাত্র এক সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের নেতৃত্বে ২৬টি দেশ ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য একটি ‘স্বেচ্ছাসেবী জোট’ গঠনের ঘোষণা দেয়। জোটটি গঠনের উদ্দেশ্য হচ্ছে যুদ্ধবিরতির পর ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

এদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় শান্তিচুক্তির প্রচেষ্টাকে উপেক্ষা করে ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে রাতের বেলা হামলা আরও জোরদার করেছেন। তিনি পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, ইউক্রেনে ইউরোপীয় সেনাদের উপস্থিতি তিনি মেনে নেবেন না।

রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, পোল্যান্ডের কোনো লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানোর অভিপ্রায় তাদের ছিল না। কিন্তু ১৯টি ড্রোন পাঠানোর ঘটনাকে পশ্চিমা দেশগুলোর রাজনৈতিক সদিচ্ছা পরীক্ষা করার কৌশল হিসেবে দেখছেন অনেকে। কেননা এমন এক সময়ে ড্রোন পাঠানো হয়েছে, যখন ট্রাম্পের অস্থিরমতি নেতৃত্বের কারণে ইউক্রেনকে সমর্থন দেওয়ার ক্ষেত্রে ইউরোপ যুক্তরাষ্ট্রের ওপর কতটা ভরসা করতে পারবে, তা নিয়ে সংশয় আছে।

আবার অনেকে মনে করছেন, রাশিয়ার অভিপ্রায় হলো ইউরোপের জনগণের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে যুদ্ধবিরোধী জনমতকে উসকে দেওয়া। কেননা জনগণের ক্ষোভ কাজে লাগাতে পারবে জনতুষ্টিবাদী সরকারগুলো।

আরও পড়ুন

রুশ ড্রোন ভূপাতিত করতে পোল্যান্ডের বিমানবাহিনীকে সহায়তায় জন্য এগিয়ে আসে ন্যাটোর বেশ কয়েকটি দেশ। এর মধ্যে ছিল ইতালির রাডার বিমান, নেদারল্যান্ডসের যুদ্ধবিমান ও জার্মানির প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা।

২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার সর্বাত্মক আগ্রাসন শুরুর পর ন্যাটোর সদস্য কোনো রাষ্ট্রের আকাশসীমা লঙ্ঘনের ঘটনা এটাই প্রথম নয়। কিন্তু এবারের ঘটনাটি ছিল সবচেয়ে বড়। লক্ষ্যবস্তু ছিল এমন একটি দেশ, যেটি পশ্চিমা অস্ত্র সরবরাহের প্রধান ঘাঁটি। এর আগে রাশিয়ার ড্রোন লাটভিয়া ও লিথুয়ানিয়ায় গিয়ে পড়েছিল, তাতে জীবন ও সম্পদের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ২০২২ সালে ইউক্রেনের একটি প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ভুল পথে গিয়ে পোল্যান্ডে আঘাত করেছিল, তাতে দুজন পোলিশ নাগরিক নিহত হয়েছিলেন।

রাশিয়ার যুদ্ধবিমান ও নৌযানও প্রায়ই বাল্টিক, উত্তর সাগর ও কৃষ্ণসাগর অঞ্চলের আকাশসীমা ও জলসীমার একেবারে কাছাকাছি চলে আসে, কখনো কখনো ভেতরেও ঢুকে পড়ে। এ নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে ন্যাটোর দেশগুলোর বিড়াল-ইঁদুর খেলা চলে।

যাহোক, ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পর এই প্রথমবার ন্যাটোর কোনো সদস্যরাষ্ট্রের আকাশসীমায় ঢোকা রুশ ড্রোন ভূপাতিত করতে হলো। পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ডোনাল্ড টাস্ক সংসদে এক ভাষণে বলেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এ পরিস্থিতি আমাদের খোলাখুলি সংঘাতের সবচেয়ে কাছাকাছি জায়গায় নিয়ে গেছে।’

পোল্যান্ডের আকাশসীমায় রুশ ড্রোন প্রবেশের এ ঘটনাকে ইউরোপীয় নেতাদের অবশ্যই কাজে লাগাতে হবে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর চাপ বাড়াতে হবে, যাতে ইউক্রেনের জন্য ইউরোপের নেতৃত্বাধীন ‘নিরাপত্তা নিশ্চিতের বাহিনীকে’ সমর্থন দেন।

ঘটনার পর পোল্যান্ড ন্যাটোর চতুর্থ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়। এই অনুচ্ছেদে বলা আছে, কোনো সদস্যরাষ্ট্র যদি মনে করে তার ভৌগোলিক অখণ্ডতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা বা নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে, তখন তারা পরামর্শ বৈঠকের আহ্বান জানাতে পারে। ব্রাসেলসে বৈঠকের পর এক বিবৃতিতে ন্যাটোর মহাসচিব মার্ক রুতে জানান, জোটের সদস্যরা পোল্যান্ডের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং রাশিয়ার ‘বেপরোয়া আচরণের’ নিন্দা জানিয়েছে।

ইউরোপীয় কমিশনের সভাপতি উরসুলা ভন ডার লেন এ ঘটনায় সরাসরি পুতিনকেই দায়ী করেছেন। ইউরোপীয় পার্লামেন্টে ‘স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন’ ভাষণে শেষ মুহূর্তে যোগ করা মন্তব্যে তিনি বলেন, ‘আজ আমরা পোল্যান্ড ও ইউরোপের আকাশসীমায় ১০টির বেশি রুশ ড্রোনের বেপরোয়া ও নজিরবিহীন অনুপ্রবেশ দেখলাম। পোল্যান্ডের সঙ্গে ইউরোপ সম্পূর্ণ সংহতি প্রকাশ করছে। এখানে পুতিনের বার্তা স্পষ্ট, আমাদের প্রতিক্রিয়াও স্পষ্ট হতে হবে।’

আরও পড়ুন

পোল্যান্ডের আকাশসীমায় রুশ ড্রোন প্রবেশের এ ঘটনাকে ইউরোপীয় নেতাদের অবশ্যই কাজে লাগাতে হবে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর চাপ বাড়াতে হবে, যাতে ইউক্রেনের জন্য ইউরোপের নেতৃত্বাধীন ‘নিরাপত্তা নিশ্চিতের বাহিনীকে’ সমর্থন দেন।

রুশ হুমকি মোকাবিলায় ইউরোপের সামরিক সক্ষমতা বাড়ানোর যৌক্তিকতাও নতুন করে হাজির হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, ন্যাটোর সদস্যদেশগুলো পোল্যান্ডের আকাশ প্রতিরক্ষা জোরদার করতে যুদ্ধবিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা পাঠাতে পারে।

রাশিয়ার হামলা ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড মোকাবিলায় ন্যাটোর প্রতিক্রিয়া কতটা কঠোর হওয়া উচিত, তা নিয়েও বিস্তর আলোচনা দরকার। নর্ডিক ও বাল্টিক দেশগুলো চাইছে কঠোর অবস্থান। তাদের প্রস্তাব, রুশ যুদ্ধবিমান আকাশসীমায় ঢুকলেই ন্যাটোর টহল বিমানকে গুলি করার অনুমতি দিতে হবে। তারা চায় ইউরোপীয় ও মার্কিন মিত্ররা ইউক্রেনকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করুক এবং ইউক্রেন যেন রাশিয়ার অনেক ভেতরে হামলা চালাতে পারে, এমন স্বাধীনতা দেওয়া হোক।

এদিকে ইউক্রেন চায় ন্যাটোর দেশগুলো যেন তাদের নিজ নিজ ভূখণ্ড থেকেই ইউক্রেনের আকাশে ঢোকা রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করে দেয়। কিন্তু জার্মানি, ইতালি ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো মিত্রদেশ বিষয়টি নিয়ে তুলনামূলকভাবে সতর্ক। কারণ, এতে সংঘাত আরও বেড়ে যেতে পারে।
তবু পুতিন যেভাবে ইউক্রেন ও ইউরোপীয় মিত্রদের উসকানি দিচ্ছেন, পশ্চিমাদের এখনই মস্কোকে স্পষ্ট বার্তা দেওয়া দরকার।

পল টেইলর, ইউরোপিয়ান পলিসি সেন্টারের জ্যেষ্ঠ ভিজিটিং ফেলো

দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত