সংবিধান, এসজিডিজি ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শরিকানা

‘রাষ্ট্রের যথাযথ মনোযোগের অভাব পাহাড় ও সমতলের জাতিগোষ্ঠীদের অস্তিত্ব ক্রমেই সঙ্গীন করে তুলছে।’

স্থানিক বাস্তবতায় স্বতন্ত্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের বসবাস একেবারে প্রান্তে, যা তাদের কেন্দ্রের মনোযোগবঞ্চিত রেখেছে। এমন নেতিবাচকতার ধারা আসলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির সময়কার নয়। ১৯৭২ সালের ২৯ জানুয়ারিতে যখন পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি প্রতিনিধিদল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে, তিনি প্রতিনিধিদলকে তাদের জীবন–জীবিকা ও কর্মসংস্থানের বিষয়ে একগুচ্ছ আশ্বাস দিয়েছিলেন, সেগুলোর মধ্যে ছিল—সরকারি চাকরিতে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করা হবে, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের ঐতিহ্য ও কৃষ্টি যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে ভূমির অধিকার নিশ্চিত করা হবে।

বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জাতিগত-ভাষাগত বৈচিত্র্য, ধর্মনিরপেক্ষতা, সহনশীলতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের নাগরিক সাম্যতার ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এ অর্থবহ আশ্বাস একটি ইতিবাচক ঐতিহাসিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করে। তবে তাঁর এ আশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পারেনি মুজিবোত্তর বাংলাদেশ। সময় বদলেছে, সঙ্গে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের জন্য দরদের পারদও নেমে গেছে তলানিতে।

বহু বছরের তিক্ততার নিরসনে ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকার পার্বত্য চুক্তির মধ্য দিয়ে পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার বাতাবরণ তৈরির পদক্ষেপ নেয়। তারপরও অসন্তোষ অশান্তির উদ্‌গিরণ হয় কিছুদিন পরপরই। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের জন্য ক্রমসংকুচিত কর্মসংস্থান একটি উন্নয়নকামী সমাজের অন্যতম প্রতিবন্ধকতা। আর সেটি যদি হয় নীতি কাঠামোর নিষ্পেষণে, তাহলে এর শিকার হওয়া জনগোষ্ঠীর ভরসার জায়গা থাকে না।

পার্বত্য অঞ্চলের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের কিছু প্রশাসনিক কর্তৃত্ব রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন-১৯৯৮ এবং ২০০০ সালের চাকরির প্রবিধান অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত অধিবাসীদের কর্মসংস্থান নিশ্চিতকল্পে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগে পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানকে প্রধান করে নিয়োগ কমিটি করার বিধান রয়েছে। যেটি সমন্বয়ের একটি লক্ষণীয় আন্তরিক দৃষ্টান্ত বলে গণ্য করা হয়।

কিন্তু সাম্প্রতিক (২০১৯) এক সংশোধনীতে পার্বত্য তিন জেলায় আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যানের পরিবর্তে প্রতি জেলার ডেপুটি কমিশনারকে নিয়োগ কমিটির প্রধান করার বিধান করা হয়, যেটি উচ্চ আদালতে রিটের মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। কথিত সংশোধনী অসাবধানতাবশত হয়েছে বলা যাবে না, কারণ, এর আগেও ২০১২–১৩ সালে দুবারের সংশোধনীতে তিন পার্বত্য জেলার ক্ষেত্রে নিয়োগ কমিটির সভাপতি হিসেবে পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের উপস্থিতি নিশ্চিতের বিধান সংরক্ষিত ছিল।

নিয়োগ কমিটির সভাপতি যদি ডেপুটি কমিশনারকে রাখা হয়, সে ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান বিবেচনায় তিন পার্বত্য জেলার অধিবাসীগণ আরও পিছিয়ে পড়বে। অ্যাফারমেটিভ বা পজিটিভ অ্যাকশন (পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীকে কিছু বাড়তি সুবিধা) নামে কল্যাণকামী রাষ্ট্র যে ইতিবাচক প্রণোদনা দিয়ে থাকে, তার গরিমায় কালিমা পড়বে।

বহুমাত্রিক ভিন্নতা সত্ত্বেও পার্বত্য ও সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য মূলধারার উন্নয়ন পরিকল্পনা রূপরেখা মানা কতটা যৌক্তিক—এ প্রশ্নে উত্তরহীন থাকা বাঞ্ছনীয় নয়। নীতি কাঠামোতে বহুমাত্রিকতা ও বৈচিত্র্যের সন্নিবেশ ঘটানো খুব বেশি দরকার। চাকমা সার্কেলপ্রধান রাজা দেবাশীষ রায়ের মতে, উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় থাকা বাংলাদেশে আদিবাসীদের পিছিয়ে থাকার কারণ রাষ্ট্রীয় নীতিমালা প্রণয়নে আদিবাসীদের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় না নেওয়া (প্রথম আলো)। আমরা উন্নয়ন প্রক্রিয়ার যত বৈচিত্র্য ও বহুমাত্রিকতার অনুশীলন করতে পারব, আমাদের দেশ তত সমৃদ্ধ ও টেকসই হবে।

এমডিজির পর বাংলাদেশ এসডিজি বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ। এসডিজির মর্মবাণী হলো—কেউ পেছনে পড়ে থাকবে না। যারা পিছিয়ে আছে, তাদের উন্নয়নের মাধ্যমে মূল ধারায় নিয়ে আসতে হবে। সেই বিবেচনায় পিছিয়ে থাকার কারণ নির্ধারণ গুরুত্বপূর্ণ। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতির জন্য বিশ্লেষিত তথ্য, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও লিঙ্গভিত্তিক তথ্য প্রয়োজন, যার ঘাটতি রয়েছে প্রকটভাবে।

এসডিজি বাস্তবায়নে এই বিভাজিত পরিসংখ্যান প্রয়োজন সবার আগে। সবার জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করতে আমরা সাংবিধানিকভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ। খুব ন্যায্যভাবে আমাদের সংবিধানের মৌলিক অধিকার অংশের (তৃতীয় ভাগের) ২৭ অনুচ্ছেদে লেখা আছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’

আর ২৮ (৪) অনুচ্ছেদের ম্যান্ডেট, ‘...নাগরিকদের যেকোনো অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।’ পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক মানুষের অধিকার নিশ্চিতকল্পে উচ্চ আদালতে রিটের ক্ষেত্রে দাবি নিশ্চিতকরণে এক অত্যাবশকীয় অস্ত্র এ প্রাণদায়ী অনুচ্ছেদটি।

রাষ্ট্রের যথাযথ মনোযোগের অভাব পাহাড় ও সমতলের জাতিগোষ্ঠীদের অস্তিত্ব ক্রমেই সঙ্গীন করে তুলছে। এক খসড়া হিসাব মতে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর কমপক্ষে ১০টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী বিলীন হয়েছে, এর সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গেছে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, লোকায়ত জ্ঞান ও ইতিহাস। অথচ ১৯৭১-এর আদমশুমারি অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৫০টির বেশি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অবস্থান ছিল পাহাড় ও সমতল মিলিয়ে এবং তাদের ভাষার সংখ্যা ৩২। আদিবাসীদের প্রতি কাঠামোগত বৈরিতা জারি থাকলে এসব স্বল্প জনসংখ্যার জাতিগোষ্ঠী অস্তিত্বহীন হতে খুব বেশি সময় লাগবে না।

সরকারি জরিপে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের (পার্বত্য ও সমতলে) ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর যথাযথ সংখ্যাতাত্ত্বিক হিসাব পরিপূর্ণভাবে পাওয়া যায় না। যার অভাবে বিভিন্ন জাতীয় উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়নে তাদের উন্নয়ন চাহিদা চিহ্নিত করা সম্ভব হচ্ছে না। দেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য একটি বিশেষায়িত জরিপ পরিচালনা করা জরুরি, যাতে কর্মসংস্থানভিত্তিক চাহিদা নিরুপণ করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যায়।

একটি কার্যকর সমন্বয়কামী বৈষম্যবিরোধী আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে চিরন্তন সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সরকারের মানবিক অবস্থান পরিষ্কার করা প্রয়োজন। না হলে ‘হিতের প্রচেষ্টায় অহিতের জন্ম’ হতে পারে—অমর্ত্য সেনের এ সতর্কবাণী সত্য বলে প্রতিভাত হতে পারে। এই আপ্ত সত্য ভুলে গেলে চলবে না, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় কর্মসংস্থান নিশ্চিতকল্পে সুযোগের পৌনঃপুনিক সংস্থান রাষ্ট্রের সাংবিধানিক কর্তব্য।

পৃথিবীব্যাপী বিরাজমান সামাজিক ও রাষ্ট্রিক যে কাঠামোগত বৈষম্য আছে, সব কটিকে একত্রে ‘কাঠামোগত সহিংসতা’ বলে উল্লেখ করেছেন নামজাদা মেডিকেল অ্যানথ্রোপলজিস্ট পল ফারমার। প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠীগুলো নানা সময়ে এমন কাঠামোগত বৈষম্যের আবডালে কাঠামোগত সহিংসতার শিকার হয়।

মিলেনিয়াম উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জন করে দেশ এখন টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) দিকে ছুটছে। এতে শরিকানা দিতে হবে সব ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোকে। কখনোই যেন মনে না হয় আমরা (মূলধারা) ও ওরা (ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলো) পরস্পর-সংযোগ ও সহানুভূতিরহিত দুটি ভিন্ন ধারা ভিন্ন জাতি; দুটি স্বতন্ত্র অঞ্চল বা উপগ্রহের বাসিন্দাদের মতো, পরস্পরের অভ্যাস, ভাবনা ও সংবেদনশীলতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ।

  • এম এম খালেকুজ্জামান আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট