চীন–সৌদি ঘনিষ্ঠতা, মধ্যপ্রাচ্যে কঠিন হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ

চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ও সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান

চীন ও সৌদি আরবের মধ্যে কত দ্রুতগতিতে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিকশিত হচ্ছে, তা নিয়ে যদি প্রমাণ দিতে বলা হয়, তাহলে গত মাসের দুটি ঘটনার দৃষ্টান্ত দেওয়াটা যথেষ্ট। প্রথমটি হলো, রিয়াদে অনুষ্ঠিত চীন-আরব ব্যবসা সম্মেলন। এই সম্মেলনে ৩০টির বেশি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে, আর্থিকভাবে এর পরিমাণ প্রায় ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

দ্বিতীয়টি হলো, চীনের তিয়ানজিন শহরে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম সম্মেলন। ‘গ্রীষ্মকালীন দাভোস’ নামে পরিচিতি পাওয়া এই সম্মেলনে সৌদি আরবের জ্যেষ্ঠ পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী, যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রীসহ সৌদি আরব তাদের ২৪ সদস্যের প্রতিনিধিদলকে সম্মেলনে পাঠায়। বড় কোনো চুক্তি না হলেও এটা স্পষ্ট যে এই সম্মেলনকে দুই দেশই তাদের অর্থনৈতিক সহযোগিতা গভীর করতে ব্যবহার করতে চেয়েছে।

কয়েক দশক ধরে চীন ও সৌদি আরবের অর্থনৈতিক সম্পর্ক শুধু অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের ওপর নির্ভরশীল থেকে গিয়েছিল। কিন্তু গত কয়েক বছর এই সম্পর্ক দ্রুত বৈচিত্র্যময় হচ্ছে। চীনের দিক থেকে যদি বিবেচনা করা যায়, তাহলে বিশুদ্ধ লেনদেনভিত্তিক সম্পর্কের চেয়েও এ সম্পর্ক আরও বড় কিছু। বেইজিংয়ের এই দৃষ্টিভঙ্গি সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চালচিত্রে বহুমুখী প্রভাব ফেলছে। মধ্যপ্রাচ্যে অর্থনৈতিকভাবে সম্পৃক্ত হতে এবং দীর্ঘ মেয়াদে অবস্থান করতে বেইজিং যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তাতে আশ্বস্ত হয়েছে ওই অঞ্চলের শক্তিগুলো। তারা মনে করছে, প্রতিশ্রুতি রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র যে ব্যর্থতা দেখিয়েছে এবং নিজেদের প্রভাব ধরে রাখতে গিয়ে বড় যেসব চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে, তার তুলনায় চীনের অবস্থান বিপরীত।

চীনকে তাদের সামর্থ্যের সবটা ঢেলে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। মধ্যপ্রাচ্যের শাসক ও জনগণের মন জয় করে নিতে যুক্তরাষ্ট্রের থেকে তারা যে ভালো কিছু করছে, সেটা দেখালেই চলবে।

 বেইজিং ও রিয়াদের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক ইতিমধ্যেই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। কয়েক বছর ধরে চীন সৌদি আরবের অপরিশোধিত তেলের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। গত দুই দশক মধ্যপ্রাচ্যে চীনের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য সহযোগী সৌদি আরব। আর ২০১৩ সাল থেকে সৌদি আরবের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার চীন। গত বছরের ডিসেম্বরে সি চিন পিংয়ের সৌদি আরব সফরের সময় দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কে যে বড় ধরনের রূপান্তর ঘটতে চলেছে, তার পরিষ্কার ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল। সে সফরে দুই দেশের সরকার ভবিষ্যৎ সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলো শনাক্ত করেছে। এর মধ্যে জ্বালানি, মোটরগাড়ি, সরবরাহ শৃঙ্খলা, যোগাযোগ, পরিবহন, খনি ও আর্থিক খাত রয়েছে।

বেইজিং তাদের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ এবং রিয়াদ তাদের সংস্কার কর্মসূচি ২০৩০-এর মধ্যে সমন্বয় সাধন কীভাবে করা যায়, সেই উদ্যোগ নিয়েছে। নতুন জ্বালানি সম্পদ যেমন সৌর, বায়ু ও জলবিদ্যুৎ এবং ডিজিটাল অর্থনীতি, পঞ্চম প্রজন্মের টেলিকম নেটওয়ার্ক—এসব ক্ষেত্রে পরস্পরকে সহযোগিতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

গত মাসে চীন-আরব ব্যবসা সম্মেলনে এর প্রতিফলন দেখা গেছে। এই সম্মেলনে ইলেকট্রিক গাড়ি নির্মাণে সৌদি আরবের বিনিয়োগবিষয়ক মন্ত্রী ও চীনের কার নির্মাতা কোম্পানি হিউম্যান হরাইজনের মধ্যে ৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। সৌদি আরবের তামার খনি উন্নয়নে চীনের ন্যাশনাল জিওলজিক্যাল অ্যান্ড মাইনিং কো–অপারেশনের সঙ্গে সৌদি এএসকে গ্রুপের ৫০০ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি হয়েছে। দুই দেশের ভবিষ্যৎ সহযোগিতার আরেকটি বড় ক্ষেত্র হলো পর্যটন। কোভিডের বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ার পর সৌদি আরব পর্যটনকে তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম মূল খাত হিসেবে দেখছে। এ খাতে এখন পর্যন্ত তারা ৮০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছে। চীন-আরব ব্যবসা সম্মেলনে দুই দেশের মধ্যে ট্রাভেল এজেন্সির মধ্যে ২৬টি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে।

গত দশকে চীনের কৌশলনীতি সৃজনশীল ও আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠে। সৌদি আরবের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্কে বৈচিত্র্য আনার ঘটনা এর একটি দৃষ্টান্ত। চীন শুধু মধ্যপ্রাচ্যের অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের প্রধান ক্রেতা হয়ে থাকতে চায়নি। এর পরিবর্তে নিজেদের পণ্য, শ্রমিক ও প্রযুক্তির বড় বাজার হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যকে গণ্য করছে বেইজিং। বিনিয়োগ ও দীর্ঘমেয়াদি সহযোগিতার মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর ভবিষ্যৎ অর্থনীতির সঙ্গে নিজেদেরকে বিজড়িত করেছে চীন।অর্থনৈতিক অংশীদার ও কূটনৈতিক ক্রীড়ানক হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে চীনের গ্রহণযোগ্যতা ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। এর ফলে ওয়াশিংটনের জন্যও চ্যালেঞ্জটা বড় হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে খুব সচেতনভাবে বেইজিং সম্পর্ক গভীর করতে মনোযোগী হওয়ায় ইউক্রেন, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের চেয়েও মধ্যপ্রাচ্যে ওয়াশিংটনের ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জটা কঠিন হয়ে পড়ছে।

চীনকে তাদের সামর্থ্যের সবটা ঢেলে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। মধ্যপ্রাচ্যের শাসক ও জনগণের মন জয় করে নিতে যুক্তরাষ্ট্রের থেকে তারা যে ভালো কিছু করছে, সেটা দেখালেই চলবে।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

ইয়ান সান ওয়াশিংটনের স্টিমসন সেন্টারের চীন বিষয়ে কর্মসূচির পরিচালক