অগ্নিকুণ্ডলীতে জীবনের কম্পাস

নদীও আজ দখল ও দূষণের শিকার
ফাইল ছবি

বন, জঙ্গল, রাস্তা, বাড়ির আঙিনার পাশে ক্ষুদ্রাকৃতি ইঁদুরের বা সাপের গর্ত, এমনকি সিঁদুর পোকার গর্তটুকুও আজ আর অবশিষ্ট নেই। গাড়া, গর্ত, পুকুর, দিঘি, জলাশয় সবই বন্ধ হয়ে গেছে। এখানে অল্প অল্প পানি ধারণক্ষমতা থেকে মাটি হারিয়েছে তার রস জোগানের সক্ষমতা। চৈত্র থেকে চরম পর্যায়ে গরম শুরু। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠে তা অসহনীয় পর্যায়ে আসে। ব্যাঙ ডেকে ডেকে গলা ফাটায়, তবু একরতি বৃষ্টির দেখা মেলে না। বৃষ্টি আসে না, মেঘও ডাকে না। গরম এমন পর্যায় যে জীবের জন্য প্রকৃতি হয়ে ওঠে বসবাসের ক্ষেত্রে নাভিশ্বাসের মতো। ছোট ছোট ডোবা–গর্ত যে জল ধরে রাখত, তা দিয়ে ভূগর্ভের জলের সঙ্গে ভূ-উপরি জলের এক যোগাযোগ সৃষ্টি হতো। আবার তা দিয়ে কীটপতঙ্গ, পোকামাকড়, তৃণলতা তৃষ্ণা মেটাতে পারত।

সব শুকিয়ে গেছে। পুড়তে পুড়তে মাটির বন্ড ভেঙে গেছে। জৈব পদার্থ না থাকায় মাটি আর গঠন হচ্ছে না। সবটুকু বালুতে মিশে উষ্ণতায় তা উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। সারা দিন বালু তাপ শোষণ করে, রাতে তা বিকিরণ করে, এতে প্রকৃতি সব সময় তাতিয়ে থাকছে। পাখি, পোকামাকড় জলের প্রয়োজনে তৃষ্ণা মেটাতে পারছে না। জলে অভাবে তাদের স্নানের প্রয়োজন মিটছে না। অর্থাৎ, পরিবেশে তারা টিকতে না পেরে বাধ্য হয়ে হারিয়েই যাচ্ছে। বলতে গেলে উষ্ণায়নের কারণে জীব পারছে না আহার আহরণ করতে, বসবাস করতে, প্রজনন করতে। পারছে না নির্ভয় ঘুমোতেও।

আমাদের দিয়েই ভাবলে দেখি, কানে জল গেলে আমরা সেই জল বের করতে কানের মধ্যে ওই পরিমাণ জল বাইরে থেকে কানের মধ্যে ঢুকিয়ে, তা বের করে থাকি। তা না হলে ভেতরের জল বের হয় না।

বাইরের জল ভেতরে গিয়ে টেনে আনে কানের ভেতরের আবদ্ধ জলকে। তদ্রূপ গাড়া–গর্তে যে জল জমা থাকে, তা সম্পর্ক রাখে ভূগর্ভের জলের সঙ্গে। ওপর-নিচ জলের এই চেইন আমাদের মাটিতে রস সম্পর্ক টিকিয়ে রাখে।

এখন সময় এসেছে, আপনারা যদি ভাবেন, বর্তমান প্রজন্ম আমাদের শেষ প্রজন্ম, আর কোনো ভবিষ্যৎ প্রজন্ম দরকার নেই, তাহলে বলব, মাটি, আবহাওয়া, প্রতিবেশ এবং পরিবেশ রক্ষার দরকার নেই। আর যদি ভাবেন, না, আমাদের ভবিষ্যৎ আছে। আছে পরপ্রজন্ম। তাদের জন্য বাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যাওয়া দরকার। তাহলে বলব, এক্ষুনি মাটি, আবহাওয়া, জলজ জীব, প্রতিবেশ এবং পরিবেশ রক্ষার করার শপথ নিন। মনে রাখতে হবে, আজকের সাহারা মরুভূমি, একসময় সাহারা ছিল, সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলায় ভরা।

কুষ্টিয়া জেলা শহরে ৩০ বছর আগেও প্রায় ৩০০ পুকুর-ডোবা ছিল। এই পুকুর-ডোবার জল ভূগর্ভের জলকে ধরে রাখত। এতে জীবের প্রয়োজনের জল, কৃষির জলের চাহিদা পূরণ হতো। প্রাকৃতিক জলের আকর্ষণ ঠিক থাকত। বাতাসে জলীয় বাষ্প প্রবাহিত হতো স্বাভাবিক নিয়মে। প্রকারান্তরে মেঘ হতো।

বর্ষণ হতো উষ্ণতা ঠিক থাকত। স্বাভাবিক থাকত পরিবেশ ও প্রকৃতির মৌলিক স্বভাবগুলো।

গ্রীষ্মপ্রধান দেশে উষ্ণতা মানুষের জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে প্রভাবিত হয়, যা একটি পরিবারে মানুষের জীবন থেকে সমাজ হয়ে রাষ্ট্রপর্যায়ে প্রভাব ফেলে। উষ্ণতা মানুষের শ্রমকে অস্থিতিশীল করে তোলে।

শরীরের স্বল্প সময়ের কায়িক শ্রমে ঘাম ঝরিয়ে ক্লান্ত করে তোলে। মানুষ জলশূন্যতায় অসুস্থ হয়। এতে তার শারীরিক অক্ষমতা বৈরী হয়। প্রভাব পরে কিডনিতে। আমাদের প্রধান শ্রমশীল অর্থনৈতিক সোর্স কৃষিশ্রমে এবং আমাদের শিল্পশ্রমে উৎপাদনশীলতায় বাধা দেয়। যে জন্য আমাদের ব্যবসা এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনায় নিত্যনতুন কৌশল গ্রহণ করতে হয়। হিমালয়ের পাদদেশের দেশগুলোয় উষ্ণতার কারণে ঝড়বৃষ্টি বাড়ে। সে কারণে বন্যা ও ভূমিধসের ঘটনা ঘটে।

এতে বাড়ে প্রাণহানিও। আবার পাহাড়-পর্বতের বরফ গলে গাছপালা উজাড় হয়। যে জন্য পলিবাহিত পানির ভাটমুখী গমনে সাগরে লোনাপানির উচ্চতা বৃদ্ধি পায়। নদীগুলোয় চর পড়ে, নদী মারা যায়। আবার এ ধারায় জলাশয়গুলো শুকিয়ে গিয়ে কর্মমুখী মানুষের জীবিকা নষ্ট হয়। গাঙ্গেয় অববাহিকা হয়ে গড়াই নদ, জীবন্ত ধারায় না থাকলে পরিবেশে স্বকীয়তা হারাতে বাধ্য হয়। নদী এ দেশে পরিবেশের হৃৎপিণ্ড। যার কারণে সৃষ্টি ও সৃজনশীল আমাদের সুন্দরবন। সুন্দরবন হলো দেশের শ্বাসনালি হিসেবে খ্যাত।

উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য মিথেন গ্যাস ভয়ংকর সক্রিয়। পশু ও প্রাণী, জীবাশ্ম জ্বালানি, কয়লা–গ্যাস, কৃষিখামারের ময়লা–আবর্জনা, ভাগাড়, এয়ারকন্ডিশনার, এয়ারকুলার, রেফ্রিজারেটর মিথেন সৃষ্টির মাধ্যম, যা পরিবেশ উষ্ণায়নে ভূমিকা রাখছে। উষ্ণতা বৃদ্ধিতে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসের চেয়ে মিথেন গ্যাস ৮০ গুণের চেয়েও বেশি ভূমিকা রাখে। উষ্ণায়নের কারণে মানুষের ফুসফুসে তীব্র প্রদাহ ও শ্বাসপ্রশ্বাসে জটিলতা তৈরি হয়। মানুষের শরীরের অক্সিজেনের মাত্রা কমিয়ে দেয়। কথায় জড়তার সৃষ্টি করে।

অতিরিক্ত গরমে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে। শরীর অসহ্য গরমে রক্তচাপ হঠাৎ ওঠানামার কম্পনে। হিটস্ট্রোক হচ্ছে। পেশি শুকিয়ে যাচ্ছে। রক্ত পাচ্ছে না মাত্রামতো অক্সিজেন। শরীরের অর্গানগুলো নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। মানুষসহ জীবেরা এগিয়ে যাচ্ছে কঠিন ও জটিল রোগের দিকে।

কুষ্টিয়া বাইপাস সড়ক করতে গিয়ে, শশ্মানযাত্রা ঘটেছে সাইবারি এবং টাকিমারি বিল নামে বিশাল জলাধারের। পক্ষান্তরে আমরা পেয়েছি শহরের বাইরে নির্ঝঞ্ঝাট যোগাযোগব্যবস্থা। কমেছে শহরের যানজট। কিন্তু এখন যেখানে শহর ছুঁয়ে ছয় বা আট লেনের মহাসড়ক হচ্ছে, তখন বাইপাস করে পরিবেশের স্পর্শকাতর এই জলাধারকে হত্যা করা কি প্রাসঙ্গিক ছিল! শুধু মজমপুর গেটে ওভার বা আন্ডারপাস রাস্তা করে কি সমস্যার সমাধান করা যেত না? কার, কতটা লাভের জন্য এই ইচ্ছাকৃত ক্ষতি।

এখন যার মাশুল গুনছি আমরা সবাই কিন্তু।

মানুষ সমস্যা এবং তার ভয়াবহতা জানছে। তারপরও সমাধানে সায় দিচ্ছে না তার সামান্য প্রাপ্তির লোভে। যুগে যুগে দেশে লোভের জন্য বৃহৎ স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে ব্যক্তি বড় হয়েছে। রক্ষক সব সময় যৎসামান্য পেয়ে নির্বোধ বানিয়েছে জাতিকে। এই গোষ্ঠী ব্রিটিশের সময় তাদের উপাসক ছিল, পাকিস্তানিদের সময় ছিল তাদের পদলেহী, স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় দেশবিরোধী রাজাকার, স্বাধীনের পর ধর্মান্ধ, দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর অর্থ পাচারকারী এবং দখলদার।

এদের রয়েছে পেশিশক্তি এবং এরা রাজনৈতিক বায়োস্কোপ দেখিয়ে নির্বিঘ্নে শত্রুতা করে আখের গোছায় দেশ ও জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে। এরা দুর্বল মানুষকে তাদের দুর্বল জায়গায় প্রথমে লোভ, পরে ভয় দেখিয়ে ডোবা, নালা, পুকুর, দিঘি রক্ষার সহযোগিতা করার নামে তা একসময় দখল করে নেয়। প্রতিবাদ করলে চোখ রাঙায়, আঘাত করে। এরা সবাই সংগঠিত এবং আইনকে নিজের দিকে ধাবিত করে অর্থ ও বিত্ত দিয়ে।

আরও পড়ুন

এখন সময় এসেছে, আপনারা যদি ভাবেন, বর্তমান প্রজন্ম আমাদের শেষ প্রজন্ম, আর কোনো ভবিষ্যৎ প্রজন্ম দরকার নেই, তাহলে বলব, মাটি, আবহাওয়া, প্রতিবেশ এবং পরিবেশ রক্ষার দরকার নেই। আর যদি ভাবেন, না, আমাদের ভবিষ্যৎ আছে। আছে পরপ্রজন্ম। তাদের জন্য বাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যাওয়া দরকার। তাহলে বলব, এক্ষুনি মাটি, আবহাওয়া, জলজ জীব, প্রতিবেশ এবং পরিবেশ রক্ষার করার শপথ নিন। মনে রাখতে হবে, আজকের সাহারা মরুভূমি, একসময় সাহারা ছিল, সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলায় ভরা। তা মরুভূমি হতে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল হাজার বছর ধরে। দেশের মাটি রসাল কর্দমাক্ত পলি আচ্ছাদিত। জীবন এবং প্রাণের জন্য তা শ্রেষ্ঠ উপযোগ। সে কারণে যতটা জল তার পরিপূরক ব্যবহার করা দরকার। সে জন্য জলাধারগুলোকে শেষ করে নয়, বরং তা রক্ষা করতে হবে। প্রথিতযশা গবেষক আবদুল্লাহ আলমুতী শরফুদ্দীন বলেছিলেন, ‘ছোট ছোট ডোবা–জলাশয় হলো তরল সোনার আধার।’

ভুলে গেলে চলবে না, আমরা সবাই এখন এক উষ্ণায়নের অগ্নিকুণ্ডলীতে বসবাস করছি। প্রকৃতি ও পরিবেশ মরুময় হওয়া শুধু সময়ের ব্যাপার। দখলদারকে প্রতিহত করে প্রকৃতি ও প্রতিবেশকে বাঁচাতেই হবে। তা না হলে ভয়াবহ বিপর্যয়, যা প্রতিরোধ করার সাধ্য কারও নেই।

  • গৌতম কুমার রায় গবেষক, উদ্ভাবক ও পরিবেশ ব্যক্তিত্ব