মিয়ানমারের জান্তাবিরোধীরা আন্তর্জাতিক সাহায্য পায় না কেন

রাজপথে টায়ার জ্বালিয়ে জান্তা সেনাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ। মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন শহরে
ফাইল ছবি: রয়টার্স

কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ সংঘাত কিংবা দুই দেশের মধ্যকার সংঘাত অনেক রকম রূপ নিতে পারে। সেসব সংঘাতের ধরন যা-ই হোক, তার সবই থাকে ক্ষমতাকেন্দ্রিক। এ কথা দুই বছর আগে মিয়ানমারের নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে বর্বরোচিত সামরিক অভ্যুত্থানের ক্ষেত্রে যেমন সত্য; একইভাবে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধের ক্ষেত্রেও তা সমানভাবে সত্য। তবে ইউক্রেনের দুরবস্থার খবর বৈশ্বিক সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হওয়ায় আক্রান্ত দেশটি শত শত কোটি ডলার মূল্যের সামরিক সরঞ্জাম ও অন্যান্য সহায়তা পেলেও নিজ দেশে পরাধীন মিয়ানমারবাসীর কথা বহির্বিশ্বের কাছে বহুলাংশে উপেক্ষিত থেকে গেছে এবং সামরিক বাহিনীর সঙ্গে লড়াইরত বেসামরিক বিরোধীরা খুব কমই সমর্থন পেয়েছেন।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সুনিশ্চিতভাবেই অভ্যুত্থানপ্রবণ অঞ্চল। প্রায় স্বৈরতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যের অপরিণত গণতন্ত্রের এবড়োখেবড়ো পথে থিতু হওয়ার আগে কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনকে সুদীর্ঘ ‘অভ্যুত্থান ‍যুগের’ ভার বইতে হয়েছে। ২০০৬ সাল থেকে দুবার জোরপূর্বক ক্ষমতা দখল দেখেছে থাইল্যান্ড। সামরিক বাহিনী ও রাজতন্ত্রের হাত থেকে ক্ষমতাকে মুক্ত করে আনতে দেশটিতে এখনো রাজনৈতিক দেনদরবার চলছে।

আরও পড়ুন

দেশটিতে প্রত্যক্ষ সামরিক শাসন সাংবিধানিক একনায়কত্বের পথ প্রসারিত করলেও ২০১১ সালে সেখানকার সামরিক জান্তা সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত হয় এবং নামসর্বস্ব বেসামরিক একটি সরকার গঠিত হয়। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে সামরিক শাসনের অবসান হওয়ার পরও ক্ষমতার মূল বিষয়গুলোর নিয়ন্ত্রণ জেনারেল থেইন সেইনের অধীন সেনাবাহিনীর হাতে থেকে যায়।

পরবর্তী দশকে রাজনৈতিক উন্মুক্ততা, অর্থনৈতিক সংস্কার ও উন্নয়নের পথে একটা দৃশ্যমান অর্জন দেখে মিয়ানমার। বিদেশি বিনিয়োগের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যে উন্নতি, বিভিন্ন দেশের দূতাবাস চালুর মধ্য দিয়ে অতীতের সামরিক শাসন থেকে দেশটির দৃশ্যত বেরিয়ে আসার ক্রমবর্ধমান প্রবণতা দেখা যায়।

২০১৫ ও ২০২০ সালের ধারাবাহিক দুই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বেসামরিক শক্তির ক্ষমতা পোক্ত হয়। সেনা-সমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির বিপরীতে অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) বিশাল ব্যবধানে জয়ী হয়। এর মধ্য দিয়ে দশকের পর দশক স্বৈরতন্ত্র ও নিরাশায় থাকা মিয়ানমারের জাতিগতভাবে বৈচিত্র্যপূর্ণ সমাজ, বিশেষত এর তরুণ অংশ আরও সমৃদ্ধ, গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের আলোকচ্ছটা খুঁজে পায়। তবে নির্বাচনের তিন মাসের কম সময়ের মধ্যে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশটির সামরিক বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ মিন অং হ্লাইং অভ্যুত্থান ঘটালে তাদের সে আশা বিলীন হয়ে যায়। যদিও মিয়ানমারের জনগণ এবার হাত গুটিয়ে বসে থাকেননি।

আরও পড়ুন

অভ্যুত্থানের পরপরই সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসেন লাখো বিক্ষোভকারী। এভাবে মাস পার হতে থাকলে সামরিক জান্তা ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে সামরিক আইন জারি করে। একই সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের ওপর নিরাপত্তা বাহিনীর দমন-পীড়ন শুরু হয়। জান্তাশাসিত সরকার প্রায় ৩ হাজার বেসামরিক জনগণকে হত্যা এবং প্রায় ১৭ হাজার জনকে গ্রেপ্তার করে বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে জানানো হয়। কিন্তু এরপরও গণপ্রতিরোধ অব্যাহত থাকে।

অভ্যুত্থানের কয়েক দিনের মধ্যে নির্বাচনে জয়ী এনএলডির রাজনীতিকদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটিতে যোগ দেন বিক্ষোভকারীরা। এ কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে ওই বছরের এপ্রিলে জাতীয় ঐক্যের সরকার (এনইউজি) গঠিত হয়, যার শরিক এনএলডি ও অন্যান্য দলের সদস্য এবং দলনিরপেক্ষ বিক্ষোভকারীরা। জাতীয় ঐক্য উপদেষ্টা পরিষদের সঙ্গে সংগতি রেখে কাজ করা এনইউজি বার্মিজসহ অন্য জাতিগোষ্ঠীর সদস্যদের নিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক একটি বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে প্রচার-প্রচারণা চালায়।

এদিকে জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনগুলো (ইএও), বিশেষত থাইল্যান্ড সীমান্তের কাছে কারেন বিদ্রোহী এবং উত্তরাঞ্চলে কাচিনরা মিয়ানমারের যুদ্ধক্লিষ্ট সেনাবাহিনীর সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া শুরু করে। ২০২১ সালের মে মাসে এনইউজির সশস্ত্র শাখা পিপলস ডিফেন্স ফোর্সের আত্মপ্রকাশ ঘটে, যাতে মিয়ানমারের তরুণ জনগোষ্ঠীর প্রতিরোধের উল্লেখযোগ্য বহিঃপ্রকাশ হয়।

অস্ত্রশস্ত্র, কামান কিংবা আকাশশক্তির দিক থেকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এখনো এগিয়ে। তবে মিয়ানমারের জনগণের সংকল্পবদ্ধ প্রতিরোধ জান্তাকে গোটা দেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে দেয়নি। দেশটির অর্ধেকের মতো এখন বিরোধী জোটের নিয়ন্ত্রণে।

পিডিএফের আঞ্চলিক মিলিশিয়াদের বেশির ভাগই তরুণ। পূর্বসূরিদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া স্বাধীনতা ছেড়ে দিতে নারাজ মিলিশিয়ারা গতানুগতিক, প্রায় স্থানীয়ভাবে তৈরি অস্ত্র দিয়ে জাতিগত বিদ্রোহীদের মতো সেনাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়।
কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা কিংবা আন্তর্জাতিক সমর্থন ছাড়াই পিডিএফ মিলিশিয়ারা ক্রমে সমন্বিতভাবে এবং দক্ষতার সঙ্গে তাদের গেরিলাকৌশল প্রয়োগ করে যাচ্ছে। একই সঙ্গে তারা বেছে বেছে গুপ্তহত্যাও শুরু করে দিয়েছে। সংগ্রামের পক্ষে ব্যাপক সমর্থন থাকায় তাদের দলও ভারী হচ্ছে। অন্যদিকে জাতিগত বিদ্রোহীরা তাদের চৌহদ্দির মধ্যে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।

অস্ত্রশস্ত্র, কামান কিংবা আকাশশক্তির দিক থেকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এখনো এগিয়ে। তবে মিয়ানমারের জনগণের সংকল্পবদ্ধ প্রতিরোধ জান্তাকে গোটা দেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে দেয়নি। দেশটির অর্ধেকের মতো এখন বিরোধী জোটের নিয়ন্ত্রণে।

মিয়ানমারের প্রাকৃতিক সম্পদ বিক্রি করে জোড়াতালি দিয়ে চালানো শাসনব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে পারে সেনাবাহিনী। বিপরীতে দেশটিতে চলমান গৃহযুদ্ধ অচলাবস্থায় পড়েছে। এখন পর্যন্ত মিয়ানমারের জনগণকে সহায়তায় তেমন কিছু করেনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। অথচ দেশটির জনগণ মানবিক সংকটে পড়েছেন, যা তাঁদের স্বৈরশাসনের সময়কার অন্ধকার দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।

মিয়ানমারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে, জানানো হয়েছে নিন্দাও। তবে একদিকে চীন জান্তাকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে রাশিয়া মিয়ানমারের সামরিক সরকারকে অস্ত্র সরবরাহ করছে। এমনকি আসিয়ানও (যার সদস্য মিয়ানমার) কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। শান্তিপূর্ণ সংলাপ আয়োজনে তেমন কিছু করতে পারেনি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোটটি।

এমন বাস্তবতায় নিজ জনগণের বিরুদ্ধে জান্তার অপরাধের কার্যকর সহযোগী হওয়ার পরিবর্তে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত জাতীয় ঐক্যের সরকার তথা এনইউজিকে স্বীকৃতি দেওয়া। রাজনৈতিক নেতৃত্বদানে সক্ষমতা এবং দেশে থাকা লোকজন ও প্রবাসীদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহের মধ্য দিয়ে এরই মধ্যে কার্যকর সরকার হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে এনইউজি।

  • স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
    ইংরেজি থেকে অনূদিত
    থিতিনান পংসুধিরাক থাইল্যান্ডের চুলালংকর্ন ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক এবং ইনস্টিটিউট অব সিকিউরিটি অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের ফেলো