যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি স্বাধীনতা হারাচ্ছে?

গাজায় গণহত্যা বন্ধে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ
ছবি: এএফপি

ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধ শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্রের আইভি লিগ-ভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রশাসন, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন। আমরা ৭ অক্টোবরের পর থেকে আজ ১৩ ডিসেম্বর  পর্যন্ত সময়কে কয়েকটা পর্বে ভাগ করতে পারি।

প্রথম পর্বে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, শিক্ষক ও ছাত্রদের বক্তৃতা-বিবৃতি, পাল্টাবিবৃতি দিতে দেখেছি। পরের পর্বগুলোয় মিছিল-সমাবেশ, আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের হয়রানি ও দিন কয়েক আগে হার্ভার্ড, ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া ও ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) তিন প্রেসিডেন্টকে কংগ্রেস সদস্য এলিস স্টিফানিকের জেরার মুখে পড়তে দেখি।

সবশেষ খবর হলো, ইহুদি শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ইস্যুতে ‘যথেষ্ট জোরালো’ অবস্থান নিতে না পারার অভিযোগে ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার প্রেসিডেন্ট লিজ ম্যাগিলকে পদত্যাগ করেছেন। একই অভিযোগে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ক্লডিন গে ও স্যালি কর্নব্লাথের পদত্যাগের দাবি উঠছে।

তবে এই সবকিছুকে ছাপিয়ে আইভি লিগ-ভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো এখন নতুন এক প্রশ্নের মুখোমুখি। তা হলো, কোনো এক বা একাধিক গোষ্ঠীর দাবিতে প্রেসিডেন্টকে পদত্যাগে বাধ্য করার এই রীতি কি যুক্তরাষ্ট্রের একাডেমিক ফ্রিডমকে (শিক্ষাব্যবস্থার স্বাধীনতা) বাধাগ্রস্ত করতে চলেছে?

এই প্রশ্নের অবতারণার কারণ যুক্তরাষ্ট্রের ‘অভিজাত’ এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ইসরায়েলপন্থী ধনকুবেরদের বিপুল অনুদান আছে। পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট দুই দলের রাজনীতিবিদদের পেছনেও ইসরায়েলপন্থীদের বিনিয়োগ আছে।

আমরা অনেকেই আমেরিকান ইসরায়েল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির (আইপ্যাক) কথা শুনেছি। এই কমিটির কাজই হলো ইসরায়েলপন্থী নীতি ও আইন প্রণয়নে রাজনীতিকদের উদ্বুদ্ধ করা।

আরও পড়ুন

কয়েক দিন আগেই দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, ‘অ্যাজ ফিউরি ইরাপ্টস ওভার ক্যাম্পাস অ্যান্টিসেমিটিজম, কনজারভেটিভস সিজ দ্য মোমেন্ট’ নামে একটি প্রতিবেদন ছেপেছে।

তারা লিখেছে, রক্ষণশীলেরা অনেক দিন ধরে মার্কিন ভোটারদের বলার চেষ্টা করে আসছিলেন যে উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোয় বিপ্লবী ভাবধারার প্রতি যে অনুরাগ, তা শুধু ভুল নয়, বিপজ্জনকও।

টাইমস মনে করছে, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে এই রক্ষণশীলেরা হালে পানি পেয়েছে। তাদের সঙ্গে গলা মিলিয়েছেন কিছু ডেমোক্র্যাটও।

ফলে, ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধকে কেন্দ্র করে নানা জটিল মেরুকরণের মধ্যে আরেকটি ধারা স্পষ্ট হচ্ছে। তা হলো একদিকে ইসরায়েলের প্রতি সংবেদনশীল ধনকুবের ইহুদি, কংগ্রেস ও হোয়াইট হাউসের ইসরায়েলপন্থী কজন, ছাত্রছাত্রীদের একাংশ, অন্যদিকে শিক্ষাব্যবস্থার স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী।

শেষ পর্যন্ত এই স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা বুঝতে আরও কিছুটা সময় প্রয়োজন।

আইভি লিগভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় কোনগুলো, কি হচ্ছে সেখানে?

যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থায় ব্রাউন, কলাম্বিয়া, কর্নেল, ডার্টমাউথ, হার্ভার্ড, পেনসিলভানিয়া, প্রিন্সটন ও ইয়েল—জাঁদরেল এই আটটি প্রতিষ্ঠান আইভি লিগ-ভুক্ত।

প্রতিষ্ঠানগুলোকে আইভি লিগ-ভুক্ত কেন বলা হয়, তার সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যাখ্যা নেই। এর সঙ্গে খেলাধুলার একটা যোগ থাকতে পারে। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ফুটবলে খুবই শক্তিশালী এবং অ্যাথলেটিক কনফারেন্সে মিলিত হতো। ১৯৩৭ সালে নিউইয়র্ক হেরাল্ড প্রথম এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আইভি লিগ-ভুক্ত বলে উল্লেখ করে।

অনেকে আবার আইভি গাছের সঙ্গে সম্পর্ক খোঁজার চেষ্টা করেন। সে যা-ই হোক, যুক্তরাষ্ট্রে আইভি লিগ খুব হেলাফেলার বিষয় নয়। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী কোন ইস্যুতে কী করছেন বা কী বলছেন, তার দিকে নজর থাকে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের।

বলা চলে, এই দফায় তর্ক-বিতর্কের সূচনা হয় হার্ভার্ড থেকে। ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর হার্ভার্ডে ছাত্রদের একাধিক সংগঠন একটি বিবৃতি প্রকাশ করে। ওই বিবৃতিতে ছাত্রছাত্রীরা হামাসের এই হামলার জন্য এককভাবে ইসরায়েলকে দায়ী করে।

পরবর্তী সময়ে অবশ্য ছাত্রসংগঠনগুলোর একজন মুখপাত্র নতুন আরেকটি বিবৃতিতে জানায়, তারা বেসামরিক জনগণের ওপর হামলার বিরুদ্ধে, এমন হামলা নিন্দনীয়। এই জনগণ ফিলিস্তিনি, ইসরায়েলি বা যে-ই জাতিগোষ্ঠীরই হোক না কেন।

তাদের এই বিবৃতিতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। দ্রুতই একটি পক্ষ ইহুদিবিদ্বেষী হিসেবে চিহ্নিত করে ওই সব ছাত্রছাত্রীকে। ক্যাম্পাসে একটি ট্রাকে ডিজিটাল বিলবোর্ড স্থাপন করে ওই সব ছাত্রছাত্রীর নাম, পরিচয় ও ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ করতে থাকে। অনেক ছাত্রছাত্রী তাদের স্বাক্ষর প্রত্যাহার করে নেয়।

হার্ভার্ড প্রেসিডেন্ট ক্লডিন গে ওই বিবৃতি প্রকাশের তিন দিন পর পাল্টা একটি বিবৃতিতে উল্লেখ করেন যে, হামাসের সন্ত্রাসী হামলা একটা অত্যন্ত ঘৃণিত কাজ এবং কিছু ছাত্রসংগঠনের এই বক্তব্যই হার্ভার্ডের প্রকৃত অবস্থান নয়।

বিবৃতি পাল্টাবিবৃতি, পক্ষে-বিপক্ষে মিছিল-সমাবেশ বিতর্কের ঢেউ গিয়ে পড়ে প্রায় সব প্রতিষ্ঠানে। সবচেয়ে বেশি বিতর্ক হয় একটি স্লোগান ঘিরে, আর তা হলো ‘ফ্রম দ্য রিভার টু দ্য সি/প্যালেস্টাইন উইল বি ফ্রি’। ইহুদি ও মুসলিম দুই ধর্মের ছাত্রছাত্রীরাই নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের কথা জানায়।

ব্রাউন ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিনা প্যাক্সসন ১০ অক্টোবর মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসা কোথায় পাওয়া যাবে, সেই তথ্য জানিয়ে বিবৃতি প্রকাশ করেন। এই বিবৃতির মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট ইসরায়েলের অ্যাপারথেইড রেজিমের পক্ষাবলম্বন করছেন বলে কঠোর সমালোচনা করে ব্রাউন স্টুডেন্টস ফর জাস্টিস ইন প্যালেস্টাইন। তারা আরও বলে, ইসরায়েল রাষ্ট্র ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলি বেসামরিক জনগণের দুর্দশার জন্য দায়ী।

হামাসের হামলার প্রতিবাদে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসরায়েলের সমর্থনে বিক্ষোভ
ছবি: রয়টার্স

অন্যদিকে ব্রাউন স্টুডেন্টস ফর ইসরায়েল জানায় যে তারা সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ইসরায়েলের পক্ষে দাঁড়াবে। ৮ নভেম্বর ক্যাম্পাসে অবস্থান ধর্মঘট প্রত্যাহারে রাজি না হওয়ায় পুলিশ ব্রাউন স্টুডেন্টস ফর জাস্টিস ইন প্যালেস্টাইন এবং ব্রাউনইউ জিউস ফর সিজ ফায়ার নাউ-এর ২০ ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়।

কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯ অক্টোবর কলাম্বিয়া স্টুডেন্টস ফর জাস্টিস ইন প্যালেস্টাইন একটি খোলা চিঠিতে জানায়, ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে যুদ্ধের অপরিহার্য অংশ হলো প্রতিরোধ। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও ফিলিস্তিনিরা দখলদার ঔপনিবেশিকদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পেরেছে। এই দখলদারদের যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবছর সামরিক সহায়তা হিসেবে বিলিয়ন ডলার দিয়ে থাকে।

গত ১০ নভেম্বর ক্যাম্পাস নিরাপত্তাবিষয়ক বিশেষ কমিটির চেয়ার জেরাল্ড রসবার্গ স্টুডেন্টস ফর জাস্টিস ইন প্যালেস্টাইন ও জিউইস ভয়েসেস ফর পিস-এর সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোসেফ মাসাদকে সন্ত্রাসবাদে সমর্থন দেওয়ার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়।

কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক রাসেল রিকফোর্ডও একই কারণে অভিযুক্ত হয়েছেন। কর্নেলে একজন ছাত্রকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। প্যাট্রিক দাই নামের এক ছাত্র ইহুদি ছাত্রদের হত্যার হুমকি দিয়ে পোস্ট দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন

ডার্টমাউথ কলেজে ইহুদি ছাত্রদের সংগঠন হিলেল অ্যাট ডার্টমাউথ এবং রোর হাবাড সেন্টার অ্যাট ডার্টমাউথ মোমবাতি প্রজ্বালন কর্মসূচি পালন করে। অন্যদিকে প্যালেস্টাইন সলিডারিটি কোয়ালিশন এবং আল নুর গাজায় নিহত ফিলিস্তিনিদের জন্য শোক ও স্মরণসভায় জমায়েত হয়। ডার্টমাউথের ছাত্রছাত্রীরা অ্যাপারথেইড থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আহ্বান জানান।

২৭ অক্টোবর এই কলেজের দুজন ছাত্রকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। ডার্টমাউথ স্টুডেন্ট গভর্নমেন্ট অযথা উত্তেজনা সৃষ্টির অভিযোগ আনে পুলিশের বিরুদ্ধে। ৩০ অক্টোবর ছাত্রছাত্রীরা মুক্তির মিছিল করে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ জানায় এবং অ্যাপারথেইডের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের দাবি করে।

ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার প্রেসিডেন্ট লিজ ম্যাগিল হামাসের হামলার নিন্দা জানিয়ে দু-দুটো বিবৃতি দেন এই হামলা নিয়ে। ইসরায়েলে হামাসের হামলার আগে গত সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত এক সাহিত্যসভার প্রসঙ্গটি আবার আলোচনায় নিয়ে আসেন কেউ কেউ। অনুষ্ঠানটি ছিল প্যালেস্টাইন রাইটার্স লিটারেচার ফেস্টিভ্যাল।

১২ সেপ্টেম্বরেই প্রেসিডেন্টের অফিস বিবৃতি দিয়ে জানিয়ে রেখেছিল, অংশগ্রহণকারীদের কারও কারও ইহুদি বিদ্বেষের প্রমাণ আছে। বিশ্ববিদ্যালয় এই বিদ্বেষ অনুমোদন করে না। তবে বিশ্ববিদ্যালয় মতপ্রকাশ ও স্বাধীনভাবে মতবিনিময়কে জোরালো সমর্থন জানায়।

এই সম্মেলনের আগেই বিলিয়নিয়ার দাতা রোনাল্ড লডার পেন প্রেসিডেন্ট ম্যাগিলকে এই উৎসব বাতিলের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, এই সভা পেনের সম্মানের ওপর আঘাত, যে ক্ষত শুকাতে অনেক সময় লাগবে।

ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও কড়া ভাষায় ইসরায়েলে হামাসের হামলার নিন্দা জানায়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক যারিনা গ্রেওয়ালের একটি টুইট নিয়ে বিতর্ক সৃষ্ট হয়। তিনি বলেন ইসরায়েল একটি খুনে, গণহত্যাকারী ঔপনিবেশিক শক্তি এবং ফিলিস্তিনিদের সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে এটি প্রতিহত করার অধিকার আছে।

হার্ভার্ড প্রেসিডেন্ট ক্লডিন গে
ছবি: রয়টার্স

৬ নভেম্বর ইয়েলের শিক্ষকেরা ‘গাজা আন্ডার সিজ’ (অবরুদ্ধ গাজা) নামে একটি সভা আয়োজন করেন। কয়েকজন ছাত্রছাত্রী অভিযোগ করেন, ওই সভায় সবাইকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। বিশেষ করে ইহুদিদের ধর্মীয় চিহ্ন আছে এমন ছাত্রছাত্রীদের।

ইয়েল ডেইলি নিউজ জানাচ্ছে, ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রেস হপার কলেজের বাইরে ফিলিস্তিনের মৃত্যু হোক এমন কথা লেখা ছিল। এর উত্তরে কর্তৃপক্ষ বলেছে, আমাদের পরস্পরের পরস্পরকে সহ্য করে নিতে হবে।

প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টোফার এইজগ্রুবার বিবৃতিকে নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেন। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের পক্ষাবলম্বী ছাত্রসংগঠনগুলোও জমায়েত হয়। তবে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তুলনায় প্রতিবাদের ধরন ছিল শান্ত।

হামাসের হামলার আগে মার্কিন রিপ্রেজেন্টেটিভ জশ গোথেইমার বিশ্ববিদ্যালয়টির একটি কোর্স নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। কোর্সটির নাম ‘দ্য হিলিং হিউম্যানিটিজ: ডিকলোনাইজিং ট্রমা স্টাডিজ ফ্রম গ্লোবাল সাউথ’।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে ধরনের প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি

হার্ভার্ডের কয়েকটি ছাত্রসংগঠনের বিবৃতির প্রেক্ষাপটে প্রথম ধাক্কায় হার্ভার্ডের সাবেক প্রেসিডেন্ট ল্যারি সামার্স বলেন, সন্ত্রাসী হামলার পক্ষে হার্ভার্ডের ছাত্রছাত্রীদের বিবেকবর্জিত অবস্থান তাঁকে পীড়া দিচ্ছে।

তবে হার্ভার্ডের সাবেক এক ছাত্র,  ধনকুবের ও হেজ ফান্ড সিইও বিল অ্যাকমেন প্রথম দিন থেকে এক্স হ্যান্ডেলে ধারাবাহিকভাবে পোস্ট করে ইসরায়েলপন্থীদের পক্ষে জনমত গঠন করে যেতে থাকেন।

তিনি বিবৃতিদাতা ছাত্রছাত্রীদের নাম প্রকাশ ও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান। এই ছাত্রছাত্রীরা যেন কোথাও চাকরি না পায় সেই দাবিও তোলেন। সবশেষ ক্লডিন গের পদত্যাগের দাবি জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদকে চিঠি দেন। তাঁর সঙ্গে সুর মেলান আরও অনেকে।

দ্রুতই আমরা দেখতে পাই , ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যারা খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করছিলেন, প্রতিষ্ঠানগুলো তাঁদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। একটু দেরিতে হলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শৃঙ্খলা বিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে বেশ কয়েকজন ছাত্রছাত্রীর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। ইসরায়েলপন্থী ধনকুবেরদের অনেকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তহবিল প্রত্যাহার করে নেয়।

আরও পড়ুন
ফ্রম দ্য রিভার টু দ্য সি— এই স্লোগান নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা বিতর্ক। ফিলিস্তিনের সমর্থনে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ।
ছবি: এএফপি

এর প্রথম শিকার হয় কর্নেল ইউনিভার্সিটি, হার্ভার্ড ও ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া। সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা যাঁরা দেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ভিক্টোরিয়াস সিক্রেটের বিলিয়নিয়ার লেসলি ওয়েক্সনার এবং তাঁর স্ত্রী আবিগাইল।

দ্য ওয়েক্সনার ফাউন্ডেশন বিবৃতি দিয়ে জানায়, তাঁদের ইসরায়েলি ফেলোদের অনেকেই প্রান্তিক ও পরিত্যক্তবোধ করছেন। বয়কট, ডাইভেস্ট, স্যাংশন (বিডিএস) নামের অপর একটি আন্দোলন থেকে ইসরায়েলের ওপর নিষেধাজ্ঞা দাবি করা হচ্ছে। এসবই তাদের বিরক্তির কারণ।

ইহুদি ছাত্ররা অনিরাপদ বোধ করছে—এমন অভিযোগ তুলে কংগ্রেস শুনানিতে ডাকে হার্ভার্ড, ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া ও এমআইটির প্রেসিডেন্টকে। তাঁরা জেরার মুখে মাপা মাপা কথা বলে ব্যাপক বিতর্কের মুখে পড়েন। পত্রপত্রিকাগুলো ফলাও করে এই খবর ছাপে। পেন প্রেসিডেন্ট ম্যাগিলের সঙ্গে কংগ্রেস সদস্য এলিস স্টেফানিকের কথোপকথন ছিল এমন—
কংগ্রেস ওম্যান এলিস স্টেফানিক: মিস ম্যাগিল, ইহুদিদের গণহত্যার ডাক দেওয়া কি পেনের আইন বা আচরণবিধি বিরোধী? হ্যাঁ নাকি না?

ম্যাগিল: এই ভাষ্য যদি আচার-আচরণে প্রকাশ পায়, তাহলে তা হয়রানি বলে গণ্য হবে।

স্টেফানিক: আমি নির্দিষ্টভাবে জানতে চাই, ইহুদিদের গণহত্যার ডাক দেওয়া কি হয়রানি বলে গণ্য হবে?

ম্যাগিল: এটা যদি নির্দিষ্ট কাউকে উদ্দেশ করে বলা হয়, কঠোর বা ব্যাপকভাবে তাহলে এটা হয়রানি হবে।

স্টেফানিক: তার মানে জবাব হলো, ‘হ্যাঁ’

ম্যাগিল: এটা প্রেক্ষাপটের ওপর নির্ভর করছে।

স্টেফানিক: প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ইহুদিদের গণহত্যার ডাক দেওয়া হয়রানি বলে গণ্য হবে না? আমি আপনাকে খুব সহজ একটা প্রশ্ন করছি। তার মানে আপনি আপনার সাক্ষ্যে হ্যাঁ উচ্চারণ করবেন না? হ্যাঁ নাকি না?

ম্যাগিল: এই ভাষ্য যদি আচরণে পরিণত হয়, তাহলে এটা হয়রানি বলে গণ্য হবে। সে ক্ষেত্রে জবাব হলো হ্যাঁ।

স্টেফানিক: আচরণ বলতে কি বোঝাচ্ছেন? গণহত্যা ঘটানো? ভাষ্য হয়রানি বলে গণ্য হবে না? এটা অগ্রহণযোগ্য। আমি আপনাকে আর একটা সুযোগ দিচ্ছে। সারা বিশ্ব আপনাকে দেখছে। ইহুদিদের গণহত্যার ডাক দেওয়া কি পেনের আইন বা আচরণবিধি বিরোধী? হ্যাঁ নাকি না?

ম্যাগিল: এটা হয়রানি বলে গণ্য হতে পারে।

অপর দুই প্রেসিডেন্ট ক্লডিন গে এবং স্যালি কর্নব্লাথের কথোপকথনও ছিল একই ধাঁচের। এলিস স্টেফানিকসহ ৭০ জন এবং হোয়াইট হাউস প্রতিনিধি তাঁদের পদত্যাগের দাবি তোলেন। শুরু থেকেই এমআইটির প্রেসিডেন্ট স্যালি কর্নব্লাথের পাশে দাঁড়িয়েছিল পর্ষদ। কিন্তু লিজ ম্যাগিল পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ক্লডিন গে আরও সুস্পষ্ট অবস্থান নিতে না পারার ব্যর্থতা শিকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। এলিস স্টেফানিক এক্স হ্যান্ডলে লেখেন, একজন গেল, রইল বাকি দুই। তাঁর এই টুইট শেয়ার করেন অনেকে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বাধীনতা কি হুমকির মুখে?

দাতাদের তহবিল প্রত্যাহার, রাজনীতিকদের হুমকি-ধামকি, প্রেসিডেন্টদের পদত্যাগ দাবির প্রেক্ষাপটে দু’ ধরনের চ্যালেঞ্জের কথা বলেছেন পর্যবেক্ষকেরা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি দীর্ঘ মেয়াদে টিকে থাকতে পারবে? তারা কি শিক্ষা ও গবেষণা খাতে আগের মতোই স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে? না চাপের মুখে নতি স্বীকার করবে?  

সংবাদপত্রগুলো জানায়, বড় দাতাদের এই অবস্থানের দরুন স্বল্পমেয়াদে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুব একটা সমস্যায় পড়বে না। তবে দীর্ঘ মেয়াদে ঝুঁকিতে পড়তে পারে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলে মূলত দাতাদের অর্থে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এই অনুদানের পরিমাণ আরও বেড়েছে। বলা হয়ে থাকে যুক্তরাষ্ট্রে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর পরই সবচেয়ে বেশি অনুদান পেয়ে থাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো।

আরও পড়ুন

এই দাতারা অর্থছাড়ের সঙ্গে কিছু অগ্রাধিকার ঠিক করে দেয়। যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো, গবেষণা, ক্যাম্পাসে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, খেলাধুলা, বৃত্তি এবং দরিদ্র ছাত্রদের আর্থিক সহায়তা ইত্যাদি। গত বছর হার্ভার্ডের ৫ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয়ের ৪৫ শতাংশ এসেছে মহানুভব ব্যক্তিদের কাছ থেকে।

ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভানিয়ার প্রেসিডেন্ট চাপের মুখে পদত্যাগ করেছেন। এমআইটির প্রেসিডেন্ট স্যালি কর্নব্লাথের মতো হার্ভার্ডের প্রেসিডেন্ট ক্লডিন গে পরিচালনা পর্ষদ হার্ভার্ড করপোরেশনের পূর্ণ সমর্থন পেয়েছেন।

গত মঙ্গলবার হার্ভার্ডের ৩৮৬ বছরের ইতিহাসে  প্রথম আফ্রিকান আমেরিকান নারী প্রেসিডেন্টের পক্ষে থাকার ঘোষণা দেয় করপোরেশন।

এক বিবৃতিতে তারা বলেছে, ‘হার্ভার্ডে আমরা মুক্ত আলোচনা ও অ্যাকাডেমিক ফ্রিডমকে সমর্থন করি। আমরা সবাই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আমাদের ছাত্রছাত্রীদের প্রতি সহিংসতা ও শ্রেণিকক্ষের কাজ ব্যাহত করা কোনোভাবেই সহ্য করা হবে না। হার্ভার্ডের উদ্দেশ্য হলো, জ্ঞান, গবেষণা ও আবিষ্কারের মাধ্যমে গভীরতম সামাজিক ইস্যুর মোকাবিলা করা ও গঠনমূলক আলোচনা করা। আমরা বিশ্বাস করি ক্লডিন গে এই কাজকে এগিয়ে নিতে নেতৃত্ব দেবেন।’

তারপরও সংশয় কিন্তু থেকেই গেল। ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভানিয়ার প্রেসিডেন্ট লিজ ম্যাগিলের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অফ ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান স্কট বকও পদত্যাগ করেছেন।

নতুন প্রেসিডেন্ট কি চাপমুক্তভাবে কাজ করতে পারবেন? সব ছাত্রছাত্রীর জন্য নিরাপদ ক্যাম্পাস নিশ্চিত করা কি সম্ভব হবে? মুক্তমত ও পথের চর্চার সুযোগ কি অক্ষুণ্ন থাকবে নাকি অর্থ ও রক্ষণশীল রাজনীতির কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে প্রতিষ্ঠানগুলোকে?

  • শেখ সাবিহা আলম প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক