উদার গণতন্ত্রের প্রতি মানুষ কতটা আস্থা হারিয়েছে?

উদার গণতন্ত্র কী? আমরা যেমনটা বুঝি, তা হলো, এটি জনগণের অধিকার, আইনের শাসন এবং নির্বাহী, আইনসভা এবং বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যের ওপর ভিত্তি করে একগুচ্ছ মতাদর্শ দ্বারা পরিচালিত জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত একটি সরকার।

গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারগুলোর মধ্যে কিছু সাংবিধানিক পার্থক্য রয়েছে। কিছু ব্রিটিশ মডেলের ওপর ভিত্তি করে ওয়েস্টমিনস্টার পার্লামেন্টারি টাইপ নামে পরিচিত, যেখানে একটি সরকার সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা দ্বারা পরিচালিত হয় এবং অন্যগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে, যেখানে সরকার একজন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি দ্বারা পরিচালিত হয় (পরোক্ষভাবে একটি ইলেক্টোরাল কলেজ সিস্টেমের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে)। তবে এই সব গণতন্ত্রের মূল উপাদান হলো নাগরিক অধিকারের সাংবিধানিক গ্যারান্টি, যা নাগরিকদের বাক্‌স্বাধীনতা, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, আইনের শাসন এবং তাঁদের প্রতিনিধি নির্বাচন করার অধিকারকে অন্তর্ভুক্ত করে।

সংবিধান দ্বারা প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান যেমন আইনসভা, নির্বাহী অফিস এবং বিচার বিভাগ নিশ্চিত করে যে এসব অধিকারের যেন কখনোই লঙ্ঘন না হয়। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের ভোটারদের এসব অধিকার নিশ্চিত করে।

আরও পড়ুন

এ কারণেই জনগণ প্রতি নির্বাচনী চক্রে তাদের প্রতিনিধি পরিবর্তন করে, কারণ তারা জানে যে সরকারের প্রতিটি পরিবর্তনের সঙ্গে তাদের অধিকারের পরিবর্তন হবে না। তবু কেন বিশ্বের গণতন্ত্রের ওপর একটি অশুভ মেঘ রয়েছে? কেন বিশ্বের অনেক জায়গায় গণতন্ত্রের ক্রমান্বয়ে ক্ষয় হচ্ছে? এর কারণ কি এই যে গণতন্ত্রগুলো তাদের সরকারের কাছ থেকে যা আশা করে, তা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে ব্যর্থ হচ্ছে? অথবা আমরা যেমন বুঝি, উদার গণতন্ত্রকে কিছু জায়গায় কিছু কর্তৃত্ববাদী ব্যক্তির হাতিয়ারে পরিণত করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে?

উইনস্টন চার্চিল বিখ্যাতভাবে বলেছিলেন, পাপ এবং দুঃখের এই বিশ্বে অনেক ধরনের সরকারের বিচার হয়েছে এবং বিচার করা হবে। কেউ ভান করে না যে গণতন্ত্র নিখুঁত বা সর্বজ্ঞ। প্রকৃতপক্ষে, এটি বলা হয়েছে যে গণতন্ত্র হলো সরকারের সবচেয়ে খারাপ রূপ, তবে অন্য সব সরকার ব্যতীত। প্রকৃতপক্ষে এটি একমাত্র সরকারব্যবস্থা, যা বেশির ভাগ জাতি তার ত্রুটি এবং অন্তর্নিহিত দুর্বলতা সত্ত্বেও পেতে চায়। গণতন্ত্র জনগণের জন্য যেসব উপকার বয়ে আনে, তার চেয়ে তার ত্রুটি অনেক বেশি। অগণতান্ত্রিক দেশের তুলনায় গণতান্ত্রিক শাসনে জনগণের অংশগ্রহণ বেশি থাকে, যার ফলে জনসাধারণের সেবার কাঠামো গঠন করা হয়, যা জনগণের কল্যাণের উন্নতি ঘটায়। তবু অভিজ্ঞতাগত প্রমাণ সত্ত্বেও আমরা বিশ্বব্যাপী এমন এক ঘটনার ঢেউ প্রত্যক্ষ করছি, যা ভবিষ্যতে উদার গণতন্ত্রের ক্ষয় হওয়ার সম্ভাবনাকে ইঙ্গিত করে।

ঘটনাগুলোর মধ্যে রয়েছে বেশ কিছু দেশে কর্তৃত্ববাদের উত্থান, যেখানে একসময় গণতান্ত্রিক অধিকার, বাক্‌স্বাধীনতা এবং অবাধ ভোটাধিকারের শক্তিশালী উপস্থিতি ছিল। এগুলো প্রায়শই লোকরঞ্জনবাদী নেতাদের আবির্ভাবের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে, যাঁরা বিচ্ছিন্নতাবাদ, চরম জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা এবং বিশ্ববাদবিরোধী মতাদর্শে বিশ্বাসী। তাঁরা তাঁদের জনগণকে চরমপন্থার একটি ঘূর্ণিতে নিয়ে যাচ্ছেন, যা বিশ্ব সম্পর্কে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিকে মিথ্যা বিশ্বাস এবং ভুল আদর্শের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এই নেতারা তাঁদের অনুসারীদের তাঁদের কথায় অন্ধবিশ্বাস‌‌ রাখতে বলছেন এবং অনেকেই তাঁদের ফাঁদে পড়ছেন।

এটা করতে গিয়ে এসব নেতা প্রথাগত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় বহুদলীয় গণতন্ত্রে এবং উদার গণতন্ত্রের জনগণের সেবা করার সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করছেন। অন্য কথায়, এসব নেতার উদ্দেশ্য হলো, বহুদলীয় নির্বাচন থেকে জনগণকে দূরে সরিয়ে দেওয়া যেখানে বহু রাজনৈতিক দল সুষ্ঠু ও ন্যায়সংগত পদ্ধতিতে নির্বাচনে অংশ নেয়। তাঁরা জনগণকে দেখাতে চান যে তাঁরা (ক্ষমতাসীন নেতা) একাই জনগণকে যা কষ্ট দেন, তার জন্য জাদুকরী ফর্মুলা দিতে পারবে। অতএব, তাঁরা এমন একটি কৌশল গ্রহণ করেন, যা একটি একক দল বা একক নেতার ওপর জোর দেয় যিনি দেশকে নেতৃত্ব দিতে পারেন এবং সেই কৌশল অর্জনের জন্য কাজ করেন।

আরও পড়ুন

রাজনীতিতে শত্রুর একটি ইমেজ আমদানি বা তৈরি করার চেয়ে ভালো আর কিছুই কাজ করে না যা মানুষকে তাদের দুঃখ বা দুর্ভাগ্যের একক কারণ হিসেবে দেখানো যেতে পারে। এটি অর্থনৈতিক দুর্দশা বা দুর্ভাগ্যের সময় খুব ভালো কাজ করে। এই কাল্পনিক শত্রুও ভালো কাজ করবে, যখন কোনো নেতার তাঁর ক্ষমতা স্থায়ী করার নিজস্ব উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকে। এক দশকের বেশি সময় আগে তথাকথিত বসন্ত বিদ্রোহের পর আরব দেশগুলোয় গণতান্ত্রিক আদর্শের দ্রুত বিলুপ্তির জন্য এ কৌশলকে আংশিকভাবে দায়ী করা যেতে পারে।

মিসর, তিউনিসিয়া এবং সিরিয়ার রাজনৈতিক দলগুলোর শিথিল জোটের মধ্যে ক্ষমতার জন্য অভ্যন্তরীণ কোন্দল ভেঙে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেনাবাহিনী এবং অন্যান্য শক্তিশালী সংস্থাগুলোর ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানগুলো পুনরায় একত্র হয় এবং তাদের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পায় দেশের কল্পিত শত্রুদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করে। এশিয়া এবং লাতিন আমেরিকার অন্যান্য গণতন্ত্রে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত কিছু নেতার ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি এবং ব্যর্থ অর্থনীতিতে সহায়তা করতে ব্যর্থতার ফলে এমন নেতাদের উত্থান ঘটে, যাঁরা অর্থনৈতিক অসুস্থতা থেকে দ্রুত মুক্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং জনগণ তাঁদের ক্ষমতায় ফিরিয়ে এনেছিলেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমরা এই দশকে এমন এক বাকসর্বস্ব নেতার উত্থান প্রত্যক্ষ করেছি যিনি অভিবাসনের বিরুদ্ধে তাঁর প্রচারাভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং অর্থনীতির প্রতি মানুষের হতাশাকে বর্ণবাদী রাজনীতির একটি নতুন দৃষ্টান্ত তৈরি করতে ব্যবহার করেছিলেন, যা মানুষকে এখন মোকাবিলা করতে হবে।

এই প্রবণতা ২০০৪ সালে ইউএনডিপির এক জরিপ দ্বারা সমর্থিত, যেখানে বেশির ভাগ মানুষ বলেছেন যে তাঁরা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের চেয়ে জনগণকে সহযোগিতা করার জন্য স্বৈরাচারী সরকারের নিশ্চয়তা পছন্দ করে, কারণ, নির্বাচিত নেতারা তাঁদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করেননি। সবচেয়ে সাম্প্রতিক উল্লেখযোগ্য দেশ ফিলিপাইন, যেখানে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত ব্যক্তি বিখ্যাত স্বৈরশাসক মার্কোসের পুত্র, যাঁর একতান্ত্রিক শাসন দেশকে পৃথিবীর অন্যতম দুর্নীতিপরায়ণ দেশে পরিণত করেছিল। হাঙ্গেরিতে ভিক্টর ওবান তাঁর দেশের নাগরিকদের অভিবাসীদের দ্বারা তাঁদের দেশে ‘আগ্রাসনের’ ভয় দেখিয়ে রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাঁর নির্বাচনে সফল হয়েছেন।

আমরা সবাই জানি যে তুরস্ক কীভাবে একটি উদার গণতন্ত্রে পরিণত হচ্ছে এবং এর রাষ্ট্রপতি তাঁর অভ্যন্তরীণ শত্রুদের কাছ থেকে তুরস্কের অখণ্ডতার জন্য হুমকির কথা বলছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমরা এই দশকে এমন এক বাকসর্বস্ব নেতার উত্থান প্রত্যক্ষ করেছি যিনি অভিবাসনের বিরুদ্ধে তাঁর প্রচারাভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং অর্থনীতির প্রতি মানুষের হতাশাকে বর্ণবাদী রাজনীতির একটি নতুন দৃষ্টান্ত তৈরি করতে ব্যবহার করেছিলেন, যা মানুষকে এখন মোকাবিলা করতে হবে।

এসব উদীয়মান প্রবণতা কি উদার গণতন্ত্রের সম্ভাব্য বিলুপ্তির ইঙ্গিত দেয়? মানুষ কি অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিকল্প হিসেবে কর্তৃত্ববাদী রাজনীতি গ্রহণ করতে ইচ্ছুক?
এখনো নয়। যেসব পরিস্থিতি জাতীয়তাবাদ বা বৈশ্বিকতাবিরোধী চরমপন্থার উত্থান ঘটায়, সেসব দেশে এই অনুভূতির পুনরাবৃত্তি এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অস্বীকৃতি বেশি দিন থাকে না। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও অনুশীলনের দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে এমন দেশগুলোয় যা পর্যায়ক্রমিক চাপের কাছে মাথা নত করে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এবং মানুষের সহনশীলতার সঙ্গে সঙ্গে এসব বেদনাদায়ক ঘটনাও চলে যায়। কিন্তু জনগণকে এ ধরনের শিকারি নেতাদের শিকার হওয়া থেকে নিজেদের রক্ষা করতে হবে এবং তাঁদেরকে তাঁদের দেশের নিয়ন্ত্রণ নিতে বাধা দিতে হবে।

উদার গণতন্ত্র থেকে কর্তৃত্ববাদের দিকে অগ্রসর হওয়া ঘটতে পারে যদি এর লক্ষণগুলো দ্রুত শনাক্ত করে তা দূর করার উদ্যোগ নেওয়া না হয়। এসব লক্ষণের মধ্যে রয়েছে নাগরিক অধিকারকে দমন করার প্রচেষ্টা, সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি পরিষেবাগুলোর রাজনীতিকরণ এবং আইনের শাসনকে অবজ্ঞা করা। কর্তৃত্ববাদ মানে সংবিধানের পরিবর্তনের মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক দেশের স্বৈরতন্ত্রে আনুষ্ঠানিক রূপান্তর নয়। এটি ধীরে ধীরে এবং গোপনে ঘটতে পারে একটি একক রাজনৈতিক দল কর্তৃক রাষ্ট্রযন্ত্র ও প্রতিষ্ঠানের ধীর গতিতে দখল এবং অন্যান্য রাজনৈতিক বিরোধীদের দমনের মাধ্যমে। লোকেরা যদি এসব লক্ষণ শনাক্ত না করেন এবং সময়মতো তাদের বিরোধিতা না করেন, তখন এটি ঘটতে পারে।

আমরা এখনো গণতন্ত্রের গান গাওয়ার পর্যায়ে নেই। বিশ্বের কিছু জায়গায় যা ঘটছে, তাতে আমাদের যথেষ্ট সতর্কতা দেওয়া উচিত যাতে বিশ্বের আমাদের অংশে এগুলো ঘটতে না পারে। আমেরিকান রাজনৈতিক কর্মী অ্যাবি হফম্যানের ভাষায়, গণতন্ত্র এমন কিছু নয় যা আপনি বিশ্বাস করেন বা এটা আপনার টুপি ঝোলানোর জায়গা, তবে এটি এমন কিছু যা আপনি মেনে চলেন। এটা করা বন্ধ করলে একটি দেশ ভেঙে পড়বে। তিনি আরও বলেন, আমরা গণতন্ত্রে অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারি আরও বেশি গণতন্ত্রের মাধ্যমে।

এসব কথা বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের প্রেক্ষিতে প্রযোজ্য। দেশের সরকারি এবং বিরোধী পক্ষের নেতারা সবাই বলছেন, তাঁরা অবাধ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী এবং সে অনুযায়ী তারা (সরকার) নির্বাচনপ্রক্রিয়া চালনা করবেন আর বিরোধী পক্ষ তুলে ধরেছেন সে প্রক্রিয়ার জন্য কিছু শর্ত। এই মতবিভেদের মধ্যে আমরা দেখছি, কিছু বিদেশি উদ্বেগ এবং পরামর্শ, যা অনেকটা অযাচিত হলেও অবাক হওয়ার মতো নয়। কারণ, আমাদের দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বৈদেশিক অনুপ্রবেশ নতুন কিছু নয়। যেটা নতুন বা যেটা শুভ লক্ষণ নয়, তা হচ্ছে আমাদের ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা, হিংস্রতা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি অবজ্ঞা।

যেসব দেশের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা কম, আইনের শাসন দুর্বল, সেসব দেশে গণতন্ত্র দুর্বল। আমাদের অযাচিত উপদেশ যাঁরা দিচ্ছেন, তাঁরা আমাদের গণতান্ত্রিক অবস্থান সম্পর্কে সন্দিহান। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের একই উপায়, দেশের ভেতর সত্যিকারভাবে গণতন্ত্র চর্চা, আইনের শাসন আনা আর প্রশাসনে নিরপেক্ষতা প্রণয়ন করা। তা না হলে আমরা বিদেশি উপদেষ্টাদের নিবৃত্ত করতে অক্ষম থাকব।

  • জিয়াউদ্দিন চৌধুরী সাবেক সরকারি কর্মকর্তা (সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান)