ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ যেভাবে ইসরায়েলি ‘দখলদার বাহিনী’ হয়ে উঠেছে

ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা সংস্থার স্নাইপাররা গুলি করে তরুণ সাংবাদিক শাথা আল সাব্বাগকে হত্যা করেছবি: এএফপি

২৮ ডিসেম্বর একদল ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারী দখলকৃত পশ্চিম তীরের সিলওয়াদ শহরে ফিলিস্তিনি কৃষকদের ওপর হামলা করে।

ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, জলপাই বাগানের মধ্যে দুজন বয়স্ক ফিলিস্তিনি কৃষকের মুখ ও মাথা থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। তাঁদের গাড়ি ভেঙে ফেলা হয়, দুজনই মারাত্মকভাবে আহত হন।

পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারী ফিলিস্তিনিদের ওপর বর্বর হামলা বাড়ানোর প্রেক্ষাপটে এমন ঘটনা এখন নিত্যদিনের বিষয় হয়ে উঠেছে। আর এ ক্ষেত্রে ফিলিস্তিনিদের সুরক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই।

ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ দীর্ঘদিন ধরেই ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর নিরাপত্তা রক্ষার অস্ত্র হিসেবে কাজ করছে। তারা তাদের সময় ও সম্পদ নিজদের জনগণের বিরুদ্ধে অভিযানে উৎসর্গ করেছে।

২৯ ডিসেম্বর ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা সংস্থার স্নাইপাররা গুলি করে তরুণ সাংবাদিক শাথা আল সাব্বাগকে হত্যা করেন। ২১ বছর বয়সী সাহসী এই সাংবাদিক জেনিনের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের ভয়ানক অভিযানের ঘটনাগুলোর তথ্যপ্রমাণ জড়ো করেছিলেন।

মিডল ইস্ট আইকে তাঁর ভাই মুসাব আল-সাব্বাগ বলেন, ‘এটা পরিষ্কার যে আমার বোনের সঙ্গে তাঁর শিশুও ছিল। তা সত্ত্বেও আমার বোন যখন দরজা খুলে বাড়ির বাইরে বের হচ্ছিল, তখন স্নাইপার তাঁর মাথা লক্ষ্য করে গুলি করে।’

মারাত্মক অভিযান

কয়েক সপ্তাহ ধরে জেনিন শহরে অভিযান পরিচালনা করছে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ। জেরুজালেম থেকে ১০০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত জেনিন এখন একটি অশান্ত শহর। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ বলছে, ‘অপরাধী’ ও ‘সশস্ত্র জঙ্গি’ যারা জেনিনে ঘাঁটি গেড়েছে, তাদেরকে লক্ষ্য করে এই অভিযান পরিচালনা করছে।

ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে শুরু হওয়া এই মারাত্মক অভিযানে কমপক্ষে ১৬ জন নিহত হয়েছেন। আর এই হামলার বিরুদ্ধে যাঁরা প্রতিবাদ করছেন, তাঁদেরকে লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে। ৩ জানুয়ারি একজন বাবা ও তাঁর ছেলেকে হত্যা করা হয়।

আজকে ফিলিস্তিনিরা নিজেদেরকে আরও নাজুক অবস্থায় দেখতে পাচ্ছে। এটা শুধু ইসরায়েলের অপরাধমূলক সহিংস আক্রমণের কারণেই নয়, তাদের কাঙ্ক্ষিত নেতৃত্বের দিক থেকে আসা সহিংসতার কারণেও।

একদিকে গাজায় গণহত্যা চলছে, অন্যদিকে পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের হামলা রেকর্ডসংখ্যক বেড়েছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে প্রতিদিন গড়ে চারটি করে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে মারাত্মক হামলা, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি, সহিংস অভিযান এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ইসরায়েল তার সম্প্রসারণ পরিকল্পনা এগিয়ে নিচ্ছে।

ফিলিস্তিনিদের নির্মূল করতে ইসরায়েলি অভিযানে পশ্চিমারা শুধু নীরব নয়, তারা কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমর্থন দিয়ে চলেছে। এতে মার্কিন অর্থায়নপুষ্ট ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (পিএ) নিজের জনগণের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করে চলেছে।

ফিলিস্তিনের একজন কলাম লেখক আমাকে বলেছেন, প্রতিরোধী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন করে লেখা তার একটি কলামের নিচে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মন্তব্য লেখায় পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ।

পরিবেশ একটাই উদ্বেগজনক যে আমার কিছু সাংবাদিক বন্ধু ছদ্মনামে তাঁদের লেখা প্রকাশ করছে।

নতুন শত্রু

অনেক ফিলিস্তিনের জন্য পিএর অধীনে বাস করা ও কাজ করা কঠিন।কিন্তু কেউ কল্পনাতেও আনতে পারবেন না, হত্যা ও গ্রেপ্তার এমন মাত্রায় পৌঁছাতে পারে!

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, পিএ নতুন একটা শত্রু খুঁজে পেয়েছে। সেই শত্রু ইসরায়েলি বাহিনী অথবা অবৈধ বসতি স্থাপনকারী নয়।

একজন ফিলিস্তিনি আন্দোলনকর্মী আমাকে খুব অস্পষ্টভাবে বলেছে, ‘তারা (ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ) কোনো ধরনের প্রতিরোধকে সহ্য করতে রাজি নয়। পিএর অবস্থান নিয়ে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ও সমালোচক যে কাউকে তারা গ্রেপ্তার করছে।’

এর সবটাই ঘটছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের চাপে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পিএর বিরুদ্ধে অথবা তারা জেনিনে যা করছে, তার বিরুদ্ধে কেউ যদি কোনো পোস্ট দেয়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে তাঁদেরকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।’

এদিকে জেনিনের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ তাদেরকে যেভাবে চিত্রায়িত করছে, সেটাকে প্রত্যাখ্যান করছে। এবং তারা বলছে তাদের প্রতিরোধ একটা দখলদার সত্তার বিরুদ্ধে বৈধ প্রতিরোধ।

পিএ তাদের এই কর্মকাণ্ড নিয়ে যেটাই বলার চেষ্টা করুক না কেন, পিএর মূল সেক্যুলার দল ফাতাহর একজন নেতা আমাকে বলেছেন, ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে পিএ যে আচরণ করছে, তিনি মৌলিকভাবে তার বিরোধী।

তিনি বলেছেন, ‘ফিলিস্তিনি জনগণের কী হলো, কী না হলো, সেটা মোটেই ভাবে না পিএ। তারা কেবল ইসরায়েল ও আমেরিকাকে বোঝাতে চায় যে পশ্চিম তীরের নিরাপত্তা দিতে সক্ষম তারা।’

দখলদারির হাতিয়ার

গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অ্যাক্সিওসে একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জেনিনে পিএর অভিযানকে এর ভবিষ্যৎ অস্তিত্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হতে পারে। প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস হবু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে এটা বোঝাতে উদ্‌গ্রীব যে তিনি ফিলিস্তিনসংক্রান্ত বিষয়গুলো পরিচালনা করতে সক্ষম।

এখন পর্যন্ত ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ পিএর এই দমন–পীড়নকে স্বাগত জানিয়েছে। ইসরায়েলের টেলিভিশন চ্যানেল ক্যান এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এ আক্রমণকে উৎসাহিত করেছে।

ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এখন পশ্চিম তীর থেকে আল-জাজিরার সম্প্রচারও বন্ধ করে দিয়েছে।

এ সংকটজনক মুহূর্তে ইসরায়েল যখন গাজা, সিরিয়া, লেবানন ও ইয়েমেনে হামলা করে চলেছে, তখন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ তাদের কঠোর পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে ইসরায়েলি দখলদারির একটি অস্ত্র হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করছে।

  • লুবনা মাসরওয়া সাংবাদিক এবং মিডল ইস্ট আইর ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের ব্যুরো প্রধান

মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত