চীনের জিয়ামেনভিত্তিক ড্রোন নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান মুগিন লিমিটেড। কোম্পানিটি বলেছে, তাদের মনুষ্যবিহীন আকাশযান (ইউএবি) সামরিক কাজে ব্যবহারের জন্য নয়, সেগুলো মানবকল্যাণের কাজে ব্যবহারের জন্য তৈরি করা। বিবৃতিতে কোম্পানিটি জানিয়েছে, ‘আমরা আমাদের নির্মাণ করা ড্রোন সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের তীব্র নিন্দা জানায়। ইউক্রেন সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে আমরা রাশিয়া ও ইউক্রেন দুই দেশ থেকেই অর্ডার নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছি।’

ছিনদাও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক ঝাং ই সেই সব বিশ্লেষকের চেয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন, যাঁরা মনে করেন যে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এড়াতে চীন রাশিয়ার সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলছে। তিনি বলেন, ইউক্রেন সংকটকে কেন্দ্র করে ইউরোপীয় দেশগুলো প্রকৃতপক্ষে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, ইতালি এই তিন দেশ ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার ওপর জ্বালানি ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তার বিরোধিতা করেছে। এ ছাড়া চীন যদি কখনো রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে, তখনো আমেরিকা ও ইউরোপ তাদের চীনবিরোধী নীতি পাল্টাবে না।

ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর তথ্যমতে, ১১ মার্চ সকালে রাশিয়ার সেনাদের দখল করা এলাকা থেকে ইউক্রেনের দিকে একটি মুগিন-৫ ড্রোন উড়ে আসছিল। ড্রোনটিতে ২০ কেজির মতো বিস্ফোরক ছিল। ইউক্রেনের সেনারা সেটি একে-৪৭ রাইফেল দিয়ে গুলি করে ভূপাতিত করে। অস্ত্রবিশেষজ্ঞরা বলছেন, গোয়েন্দা ড্রোনে যেভাবে ক্যামেরা থাকে, সে রকম ক্যামেরা ড্রোনটিতে ছিল না এবং লক্ষ্যবস্তু অভিমুখী নয়; বরং উদ্দেশ্যবিহীনভাবে বিস্ফোরক বহন করছিল।

মুগিন-৫ ড্রোন আলিবাবা ড্রোন নামে পরিচিত। এ ড্রোনগুলো ই-কমার্সের বড় কোনো প্ল্যাটফর্মে ১২ হাজার ৯৯৮ দশমিক ৫২ ডলারে পাওয়া যাবে।

চীনের উদ্বেগ

সি চিন পিং ও পুতিনের এই বৈঠক মুগিন ড্রোন ভূপাতিত হওয়ার চেয়ে অনেক বড় একটি ঘটনার পরপরই ঘোষণা করা হয়। সেটি হলো, যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি করা এমকিউ-রিপার ড্রোন রাশিয়ার দুটি এসইউ-২৯ বিমানের মধ্যে ঠোকাঠুকির পর কৃষ্ণসাগরে বিধ্বস্ত হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী ৪২ সেকেন্ডের একটি অশ্রেণিভুক্ত ফুটেজ অবমুক্ত করে। তাতে দেখা যায়, রাশিয়ান একটি জেট বিমান ড্রোনটির ওপর জ্বালানি ছড়িয়ে দিচ্ছে। একেকটা এমকিউ রিপার-৯ ড্রোন তৈরিতে খরচ হয় ৩২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
এসব ঘটনায় গত সপ্তাহে ইউক্রেন ঘিরে উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠে। এরই মধ্যে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিন গ্যাং ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্র কুলেবাকে ফোন করেন। ইউক্রেন সংকট ঘিরে উত্তেজনা বাড়ায় তিনি বেইজিংয়ের উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, পরিস্থিতি সবার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

ছিন গ্যাং বলেন, সব পক্ষকেই শান্ত, যৌক্তিক ও সংযত থাকা উচিত এবং যত শিগগির সম্ভব, শান্তি আলোচনা শুরু করা উচিত। অস্ত্রবিরতি, যুদ্ধ বন্ধ, সংকট প্রশমন ও শান্তি পুনঃস্থাপনের জন্য চীন তার গঠনমূলক ভূমিকা অব্যাহত রাখবে।

এর আগে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বর্ষপূর্তিতে বেইজিং ১২ দফা শান্তি প্রস্তাব দেয়। উভয় পক্ষকে যুদ্ধবিরতি এবং সংঘাত রাজনৈতিকভাবে সমাধানের জন্য খোলাখুলি সংলাপের আহ্বান জানানো হয় সেই প্রস্তাবে।

এরই মধ্যে সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়েছে যে মস্কোতে পুতিনের সঙ্গে আলোচনা শেষে সি চিন পিং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলবেন। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ সফর সম্পর্কে বলেছেন, সি চিন পিং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এবং প্রধান আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বিষয়ে আলোচনা করবেন, যাতে দুই দেশের মধ্যে কৌশলগত সহযোগিতা ও বাস্তব সহযোগিতার ক্ষেত্র বিকশিত হয়।

চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গত শুক্রবার বলেন, এই সফর বন্ধুত্ব, সহযোগিতা ও শান্তির সফর। ইউক্রেন সংকটে চীন একটি বাস্তব ও ন্যায্য অবস্থান নেবে, শান্তি আলোচনার শুরুর ক্ষেত্রে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করবে চীন।

চীনের এ মুখপাত্র আরও বলেন, জোট নিরপেক্ষ, কারও সঙ্গে সংঘাত নয় এবং তৃতীয় পক্ষকে লক্ষ্যবস্তু না বানানো—এই তিন নীতির ওপর ভিত্তি করে দুই পক্ষ প্রকৃত বহুপক্ষীয়বাদ, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গণতন্ত্রায়ণ, একটি বহুমেরুর বিশ্বব্যবস্থা তৈরি, বৈশ্বিক সুশাসনের উন্নয়ন এবং বিশ্বের উন্নতি ও প্রগতিতে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
চীনের মুখপাত্র আরও বলেন, চীন-রাশিয়া সম্পর্ক খোলাখুলি সম্পর্ক। এই সম্পর্ক স্বচ্ছ এবং তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ ও জবরদস্তি হতে মুক্ত। অস্ত্র রপ্তানির ক্ষেত্রে চীন সব সময় বিচক্ষণ ও দায়িত্বশীল আচরণ করে আসছে এবং যেসব পণ্য দুই কাজে (সামরিক ও বেসামরিক) ব্যবহার করা হয়, সেগুলো রপ্তানির ক্ষেত্রে যথাযথ আইন ও নিয়মনীতি মেনে চলে।

চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন, যুক্তরাষ্ট্রের নাম উচ্চারণ না করেই বলেন, কিছু দেশ অস্ত্র সরবরাহ করে, একতরফা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ইউক্রেন পরিস্থিতিতে ইন্ধন জুগিয়ে চলেছে।

এদিকে রাশিয়ান সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, সি চিন ও পুতিন বৈঠকে বেশ কিছু দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর করা হবে। রাশিয়ায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত বলেছেন, বিশেষ করে বিশ্ব যখন অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে, সে সময়ে চীন-রাশিয়া সম্পর্ক অটলভাবে সামনে এগোনো উচিত। গত এক দশকে আন্তর্জাতিক পরিসরে ভিন্ন ভিন্ন যেসব অভিজ্ঞতা, তাতে চীন-রাশিয়া সমন্বিত কৌশলগত সম্পর্ক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে।

চীনের এ রাষ্ট্রদূত বলেন, দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক গত বছর ১৯০ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এ বছরের প্রথম দুই মাসে বাণিজ্যের পরিমাণ ৩৩ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলারের।

বিশ্লেষকেরা কী বলছেন?

ছিনদাও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক ঝাং ই সেই সব বিশ্লেষকের চেয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন, যাঁরা মনে করেন যে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এড়াতে চীন রাশিয়ার সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলছে। তিনি বলেন, ইউক্রেন সংকটকে কেন্দ্র করে ইউরোপীয় দেশগুলো প্রকৃতপক্ষে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, ইতালি এই তিন দেশ ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার ওপর জ্বালানি ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তার বিরোধিতা করেছে। এ ছাড়া চীন যদি কখনো রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে, তখনো আমেরিকা ও ইউরোপ তাদের চীনবিরোধী নীতি পাল্টাবে না।

ঝাং ই প্রশ্ন করেন, ‘রাশিয়ার সঙ্গে চীন যদি সম্পর্ক ছিন্ন করে, তার বিনিময়ে তারা কী পাবে?  চীনের প্রযুক্তি খাতে আরও বড় নিষেধাজ্ঞা অথবা ভৌগোলিক নিয়ন্ত্রণ কি অপেক্ষা করছে না? চীনের প্রতি ইউরোপ ও আমেরিকার আচরণ মস্কোর সঙ্গে বেইজিংয়ের সম্পর্ক কোথায় গড়াল, তার ওপর মোটেই নির্ভর করে না। সেটা স্বার্থ ও ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে। জার্মানির মতো দেশগুলো চীনের অর্থনৈতিক শক্তি দেখতে পাচ্ছে। এ কারণে তারা চীনের সঙ্গে বিরোধে জড়াবে না, তা নিশ্চিত করেছে। পশ্চিমকে খুশি করার জন্য রাশিয়ার সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ছিন্ন করার কোনো কারণ নেই।

জেফ পাও এশিয়া টাইমসের চীনবিষয়ক সম্পাদক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত