যেখানে নিরাপদে ঘুরে বেড়ান শিকারিরা

ফাঁদ পেতে পাখি শিকার করে নিয়ে যাচ্ছেন এক ব্যক্তি। গত শনিবার রংপুর শহরতলির চিলারঝার এলাকায়
ছবি: মঈনুল ইসলাম

‘ভাই, আইজ তো নদীতে বন্দুক নিয়া পাখিশিকারি নামছিল। হাঁস মারছে।’—তিস্তাপার থেকে একজন ফোন দিয়ে জানালেন এ কথা। পরিযায়ী পাখিগুলো আসা শুরু করতে না করতেই নির্মম পাখিশিকারিরা নেমে পড়েছেন। তিস্তায় দেখলাম, বেশ কিছু গিরিয়া হাঁস এসেছে। পরদিনই মন খারাপ করা এ খবর।

এখনই যদি এ অবস্থা হয়, তাহলে সামনে শিকারিদের হাতে পাখিদের কী হবে, তা অনুমান করা যাচ্ছে। সরকার গত বছর এয়ারগান ব্যবহার ও বহন নিষিদ্ধ করে। এরপরও এয়ারগান নিয়ে পাখি শিকার চলছে। এখন এয়ারগান যেহেতু নিষিদ্ধ, সরকারের উচিত সেগুলো তার আওতায় নেওয়া। তাহলে শিকারিরা আর এয়ারগান দিয়ে পাখি শিকার করতে পারবেন না।

গত বছর তিস্তা নদী থেকে একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি পাখি শিকার করেছিলেন। রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে মুঠোফোনে জানালে তিনি তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। ওই শিকারি থানায় বন্দুক জমা দিয়ে রক্ষা পেয়েছিলেন। এ ঘটনার পর গঙ্গাচড়ার আরেক শিকারি বলেছেন, তিনিও আর পাখি শিকারে যাবেন না।

কদিন আগে রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার জায়গীরহাটে গিয়েছিলাম। আমাদের সহকর্মী রুহুল আমিন জানান, সেখানে তিনি একটি চকচকে কাস্তেচরা পাখি দেখেছেন। কজন আলোকচিত্রী মিলে ছবি তুলতে গেলাম। কাস্তেচরা না পেয়ে পাশের গুরগুরী নদীসংলগ্ন বিলে যাই। স্থানীয় লোকজন জানালেন, ওই নদীতে নিয়মিত কয়েকজন পাখি শিকার করেন।

তাঁদের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে গেলাম সেই শিকারিদের বাড়িতে। একজনকে পেয়েও গেলাম। প্রতিদিন কয়েকটি বক শিকার করেন একেকজন। বাঁশের একটি লম্বা ঝাঁপি বানিয়েছেন। ওই ঝাঁপি কলাপাতা দিয়ে ঢেকে ফেলেন। পাশে একটি খুঁটিতে একটি বক বসিয়ে রাখেন। মাথার ওপর যে খাঁচা তৈরি করেন, সেখানে এসে বক বসলেই হাত দিয়ে ধরেন। আমরা ওই খাঁচা তাঁকে দিয়ে ভেঙে ফেলি। বুঝিয়ে আসি, এসব পাখি শিকার করা আইনত নিষিদ্ধ।

এর মধ্যে জানতে পারলাম, রংপুর শহরের অদূরেই বাজারের এক হোটেলে পাখির মাংস বিক্রি হয়। প্রতিদিন কয়েকটি পাখি জবাই হয় সেখানে। জীবন্ত পাখিও বিক্রি হয়। পাখির মাংসের দোকান হিসেবে দোকানির পরিচিতি রয়েছে। শহর থেকে অনেকেই দোকানটিতে যান পাখির মাংস খেতে। সম্প্রতি পাখির আলোকচিত্রী প্রকৌশলী ফজলুল হকসহ গেলাম সেই বাজারে। কোড়া বা জলমোরগ, ঘুঘু পাখি দেখলাম ওই দোকানে খাঁচার ভেতর। কোড়ার দাম চাওয়া হচ্ছে ৮০০ টাকা।

দোকানের ফ্রিজে দেখলাম কয়েক প্রজাতির পাখির মাংস। পাতিসরালি, ঘুঘু এবং কয়েক প্রকারের বকের মাংস। দোকানি বলছিলেন, নিশিবকের মাংস খুব সুস্বাদু। নিশিবক সব সময়ই পাওয়া যায় সেখানে। তিনি আরও জানালেন, তাঁকে যাঁরা পাখি দেন, পাখি শিকার করাই তাঁদের পেশা।

নীলফামারীর ডালিয়া, দিনাজপুরের পার্বতীপুর, লালমনিরহাট, রংপুরের জায়গীরহাটসহ বিভিন্ন এলাকার মোট সাতটি শিকারি দলের সদস্যরা তাঁকে পাখি এনে দেন। সারা দিন কেবল পাখি শিকার করেন ওই শিকারিরা। স্থানীয়ভাবে ‘পান-বিড়ি-সিগারেট’ পাখি নামে পরিচিত দুর্লভ শেখ ফরিদ পাখির মাংসও পাওয়া যায় দোকানটিতে। দোকানির ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি প্রায় ২০ বছর ধরে পাখির মাংস বিক্রি করেন। প্রতিদিন গড়ে পাঁচটি পাখি মেরে থাকলে তিনি ৩০ হাজারের বেশি পাখির ‘খুনি’। বিষয়টি আমরা বন বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসনকে জানিয়েছি।

কদিন আগে রংপুরের লালবাগ বাজারে একজন দেখলাম দুটি টিয়া নিয়ে যাচ্ছিলেন। টিয়া পাখি দুটি ছেড়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলেও তিনি ছাড়তে নারাজ। পরে তাঁকে থানায় নিয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে তিনি পাখি দুটি ছেড়ে দেন। এর কদিন পরই শহরের জাহাজ কোম্পানির মোড়ে রিকশায় এক ভদ্রলোক দুটি টিয়া নিয়ে যাচ্ছিলেন।

তাঁদের দাঁড় করে পাখি ছেড়ে দেওয়ার কথা বললে তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য বলে নিজের পরিচয় দেন। তখন আমরা বন বিভাগে খবর দিলে তিনিও পাখি দুটি ছেড়ে দেন। হাটে-বাজারে, পথে-ঘাটে আমরা কাউকে পাখি ধরে রাখতে দেখলে ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করি। এর আগেও এমন ঘটনা অনেক ঘটেছে। কিন্তু সামষ্টিকভাবে সচেতনতা জরুরি।

আরও পড়ুন

রংপুর শহরেই একটি নিম্নাঞ্চলে কয়েকটি কালিম পাখি বাস করে। প্রতিবছর ওই কালিম পাখির বাচ্চাগুলো পার্শ্ববর্তী বাড়ির এক লোক শিকার করে খান। আমরা ওই ব্যক্তিকে বুঝিয়েছি, এই পাখিগুলো দিন দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে। এগুলো শিকার করা দণ্ডনীয় অপরাধ। সেখানকার কয়েকজনকে বলে এসেছিলাম, কেউ কালিম শিকার করলে যাতে খবর দেয়। এ বছর দেখলাম, ওই বাড়ির লোকজন এবার কালিমের বাচ্চা শিকার করেননি।

নভেম্বর থেকে মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত নদী-বিলে প্রচুর পরিযায়ী পাখি আসবে। সেগুলোর জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। কেউ পাখি শিকার করছেন জানলে নাগরিকদেরও উচিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানো। পরিবেশবাদী স্থানীয় কোনো সংগঠন থাকলে, তাদেরও জানানো যেতে পারে। এ ব্যাপারে এলাকায় এলাকায় সামাজিক সংগঠন গড়ে তোলা প্রয়োজন।

আমরা পাখির নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছি। নিরাপদে ঘুরে বেড়ান শিকারিরা। পাখির আবাস দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। অসংখ্য প্রজাতির পাখি বিলুপ্ত হয়েছে, অনেকগুলো বিলুপ্তির পথে। পরিবেশের জন্য এ পাখিগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা মানুষের স্বার্থেও অত্যাবশ্যক। ব্যক্তি-রাষ্ট্র সবারই দায়িত্ব পাখির নিরাপদ বাসস্থান নিশ্চিত করা।

  • তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক