সৌদি আরব ও ইরান দুই পক্ষকেই কীভাবে কাছে রাখছে চীন?

সৌদি প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান ও চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং

যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা দাবি করেছে, সৌদি আরবের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিতে চীন সক্রিয়ভাবে সহায়তা দিচ্ছে। অবশ্য রিয়াদের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে খোলাসা করে কোনো বক্তব্য আসেনি। অনেক বিশ্লেষক প্রশ্ন তুলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষেত্রে চীন কি তার কৌশলগত লক্ষ্য পরিবর্তন করেছে?

তিনটি কারণে রিয়াদ এখন আন্তর্জাতিক অস্ত্রবাজার থেকে সরাসরি ক্ষেপণাস্ত্র না কিনে নিজেরাই তা তৈরি করতে চায়। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্কের টানাপোড়েন। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৮ সালে বাদশাহ সালমানকে সতর্ক করেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা ছাড়া তাঁর শাসন ‘দুই সপ্তাহও টিকবে না’।

ইরান–সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীদের হামলা সত্ত্বেও ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অগ্রসর প্রযুক্তির ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সৌদি আরবকে হস্তান্তর করবে না বলে জানিয়ে দেয়। এ ছাড়া তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর দেশ ওপেক প্লাস তেলের উৎপাদন না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ায় গত অক্টোবর মাসে জো বাইডেন বেশ কঠোর ভাষায় রিয়াদকে তিরস্কার করেন। এ ছাড়া ইসরায়েলের সামরিক আধিপত্য খর্ব হবে, সেই বিবেচনায় সৌদি আরবের কাছে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও প্রযুক্তি দিতে রাজি হয়নি ওয়াশিংটন।

দ্বিতীয়ত, খুব সুসজ্জিত সামরিক বাহিনী থাকা সত্ত্বেও সৌদি আরবের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা যে দুর্বল, তা দেশটির গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হুতির হামলার ঘটনায় স্পষ্ট হয়ে গেছে। তৃতীয়ত, সৌদি আরবের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইরান ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতায় অত্যন্ত শক্তিশালী।

সৌদি আরব এখন শুধু পশ্চিমা দেশ নয়, বিকল্প উৎস থেকেও অস্ত্র কিনতে চায়। বিদেশি শক্তির ওপর নির্ভরতাও কমিয়ে ফেলতে চায় দেশটি। এ কারণেই চীন এখন তাদের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৮৮ সালে চীন প্রথম তাদের ডিএফ-৩এ ক্ষেপণাস্ত্র সৌদি আরবকে দিয়েছিল। চীনের কাছ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র নেওয়ার এ তথ্য ২০১৪ সাল পর্যন্ত গোপন রেখেছিল দেশটি। ২০০৭ সালে সৌদি আরব চীনের কাছ থেকে ডিএফ-২১ ক্ষেপণাস্ত্র কিনেছে— সংবাদমাধ্যমে এমন খবর প্রকাশিত হওয়ার পরই রিয়াদ প্রথম এ তথ্য প্রকাশ্যে আনে।

সৌদি আরবকে চীনের ক্ষেপণাস্ত্র সহায়তা দেওয়ার বিষয়টিকে অনেক ইরানি বেইমানি হিসেবে মনে করতে পারেন। কিন্তু তেহরানের প্রত্যাশা হলো, পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে চীন যাতে অবৈরী সম্পর্ক বজায় রেখে চলে। এ ছাড়া ইরানের নীতিনির্ধারকেরা ভালো করেই নিজেদের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। চীন আগামী ২৫ বছর ইরানকে ৪০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের অঙ্গীকার করেছে।

দুই দেশের মধ্যকার সামরিক সহযোগিতা দেখে মনে হতে পারে, চীন হয়তো ইরানকে বাদ দিয়ে সৌদি আরবের দিকে ঝুঁকেছে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষেত্রে চীন যে ভারসাম্যমূলক নীতিতে এগোচ্ছে, সে বিষয়টি অনেকেই এড়িয়ে যাচ্ছেন। সৌদি আরবকে ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে চীনের জ্বালানি নিরাপত্তানীতির বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে চীনের নীতি খুব নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করলে দেখা যাবে বেইজিং ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে স্থিতাবস্থার পক্ষে।

পশ্চিমাদের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে সৌদি আরব আমদানি ও রপ্তানির ভিন্ন বাজার খুঁজছে। চীনে সেটাকেই কাজে লাগাচ্ছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘটনা সে কারণেই সৌদি আরবের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে সমর্থন দিয়ে চলেছে বেইজিং। ইরানকে বাদ দিয়ে সৌদি আরবকে বেছে নিচ্ছে চীন, এমন ধারণা ঠিক নয়; দুই দেশই বেইজিংয়ের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

সৌদি আরব এখন এশীয় মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করছে। এর মূলে রয়েছে জ্বালানির বাজার খোঁজার বিষয়টি। চীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় উৎপাদনকারী দেশ। বিশাল পরিমাণ জ্বালানির প্রয়োজন তাদের। রিয়াদের কাছ থেকেই সবচেয়ে বেশি জ্বালানি কেনে বেইজিং। সৌদি আরবের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদারও চীন। ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী, দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৮৭ বিলিয়ন ডলার।

আরও পড়ুন

অন্যদিকে সে বছর সৌদি আরবের কাছে যুক্তরাষ্ট্র ২৪৫ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ও প্রযুক্তি বিক্রি করে। ইরান মধ্যপ্রাচ্যে চীনের প্রধান কৌশলগত অংশীদার। সৌদি আরবকে ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি দেওয়া সত্ত্বেও সেই অবস্থান বদলে যাবে না। বেইজিংয়ের বেল্ট অ্যান্ড রোড মহাপরিকল্পনা সফল করতে গেলে ইরানকে প্রয়োজন। কেননা, মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের সন্ধিস্থল ইরান।

সৌদি আরবকে চীনের ক্ষেপণাস্ত্র সহায়তা দেওয়ার বিষয়টিকে অনেক ইরানি বেইমানি হিসেবে মনে করতে পারেন। কিন্তু তেহরানের প্রত্যাশা হলো, পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে চীন যাতে অবৈরী সম্পর্ক বজায় রেখে চলে। এ ছাড়া ইরানের নীতিনির্ধারকেরা ভালো করেই নিজেদের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। চীন আগামী ২৫ বছর ইরানকে ৪০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের অঙ্গীকার করেছে। তেহরান জোরালোভাবে পশ্চিমাবিরোধী এবং ওয়াশিংটনের প্রতি চূড়ান্ত অবিশ্বাস রয়েছে। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার প্রতিযোগিতায় তেহরান বেইজিংয়ের খুব নির্ভরযোগ্য মিত্র।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

  • মোহাম্মদ ওয়াসিম মাল্লা নয়াদিল্লিভিত্তিক গবেষণা সংস্থা মনোহর পারিকরের গবেষক